ঐতিহাসিক ৭ মার্চ নিয়েই লিখতে বসেছিলাম। এই দিনে মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির মুক্তি সনদ ঘোষণা করেছিলেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অলিখিত রূপরেখা জাতিকে সেদিন মুক্তির নেশায় উম্মাতাল করে তুলেছিল। তাই জাতীয় জীবনে এটিই আমার দৃষ্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন। কিন্তু এক বিপরীতমূখী ভাবনা আমাকে এমনভাবে তাড়িত করে চলেছে, বাধ্য হয়ে জাতির জনকের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় সোনার মানুষ গঠনে যারা অন্তরায় হয়ে উঠছে, সেসব লেবাসধারী শিক্ষিত দুর্বৃত্তরাই আমার লেখার প্রাধিকার হয়ে উঠলো।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, অনাচার আর অনৈতিকতার অভিযোগ নতুন নয়। স্বাধীনতা উত্তর কাল থেকেই অনিয়ম, অনাচার ছিল, সামরিক শাসনামলে রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক ছত্রছায়ায় পরীক্ষায় নকল প্রবণতা তো দুরারোগ্য ক্যান্সারের রূপ ধারন করেছিল। রাজনৈতিক দাপটের কাছে নিরুপায় হয়ে পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালনকারী অনেক সৎ, নীতিনিষ্ঠ ম্যাজিস্ট্রেটের অসহায় পায়চারী আর হাহাকারী আর্তনাদ দেখার দুর্ভাগ্যও আমাদের হয়েছিল। সর্ব নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তর অবধি অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের চিত্রও নতুন নয়।
গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে এসব দুরাচার বন্ধে কিছু প্রচেষ্টা ও চলমান ছিল। তবে রাজনৈতিক দৃঢ়তার অভাবে অনেক সময়ই তা আলোর মুখ দেখেনি। অতীতে প্রাথমিক থেকে কলেজ পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষা ব্যবস্থাপনা নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়নি। শিক্ষক সমাজে রাজনৈতিক আদর্শের ভিন্নতা থাকলেও প্রশাসনিক দায়িত্বশীল ক্ষমতাবান ভাইস চ্যান্সেলর আর তার সভাসদরা শিক্ষা আর গবেষণাকে অবহেলা করে ঘৃণ্য রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি আর বিত্তের মোহে পদ-পদবীকে এখনকার মতো এতোটা ন্যক্কারজনকভাবে কখনও ব্যবহার করেন নি।
অতি সম্প্রতি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডঃ নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর দেশী-বিদেশী গণমাধ্যমে যে সব সংবাদ বয়ে বেড়াচ্ছে তা আমাদের উচ্চশিক্ষার দীনতাকেই শুধু প্রকাশ করছে না, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার অদক্ষতায় ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে দেশেরও ভাবমূর্তিও। একজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসক হয়ে তেরোশ কর্ম দিবসের মধ্যে এগারোশ দিন অনুপস্থিত থেকে ও লক্ষ লক্ষ টাকা আপ্যায়ন বিল উত্তোলন করেন, এমন অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, কোন তুঘলকি আইনে তিনি এখনও ভাইস চ্যান্সেলর, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
অধ্যাপক কলিমুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, তিনি ভাইস চ্যান্সেলর হয়েও ডিন, বিভাগীয় প্রধানসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ আকড়ে রেখেছেন। চার সদস্যের একটি নিয়োগ বোর্ডে তিনি একাই তিন সদস্যের প্রতিনিধিত্ব করেছেন, বাকি একটির প্রতিনিধিত্ব করেছেন উনার গর্ভধারিণী মাতা। গল্প শুনে মনে হয়, এতো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নয়, এ যেনো গৃহভৃত্য নির্বাচনে মা-ছেলের খোশগল্প মাত্র!
গেলো সপ্তাহে ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক নাজমুল আ্হসান সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ওনার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগসমুহের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর মদদকে দায়ী করেছেন, মন্ত্রী, স্পিকারসহ প্রভাবশালীদের আবদার রক্ষা করেননি বলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনকে ব্যবহার করার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব উপস্থাপন করেছেন। জবাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সমস্ত অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে মঞ্জুরী কমিশনের মাধ্যমে তদন্তের কথা জানিয়েছেন। পরস্পরের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগে সংবাদ মাধ্যম যখন সত্য আহরণে ব্যতিব্যস্ত, উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত একমাত্র রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির বিবৃতিতে জাতি যেন হতাশার সাগরেই নিমজ্জিত হচ্ছে!!
ইউজিসি কর্তৃক সংবাদ মাধ্যমে সরবরাহকৃত তথ্য থেকে জানা যায়, ২১ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের বিরুদ্ধে নিয়োগে অনিয়ম, আর্থিক কেলেংকারী, উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থের নয় ছয়সহ নানা শিহরণ জাগানিয়া অভিযোগের তদন্ত চলমান। ইতিমধ্যে আটটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ভিসির বিরুদ্ধে জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। বেরোবি ভিসির বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতি ও প্রমাণিত। উচ্চ শিক্ষার এমন ভয়াবহ সংবাদে আমার মতো হাজারও প্রবাসী বাংলাদেশি আজ ভাবমূর্তির সংকটে নিপতিত। নকল গবেষণা পত্রে পিএইচডি, নকল মুক্তিযোদ্ধা সচিব এমন বীভৎস সব কেলেঙ্কারির যাঁতাকলে জাতি যখন হিমশিম, এমন সময় একের পর ভিসিদের কেলেংকারী দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার ভাবমূর্তিকে কিভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে সদাশয় সরকার ভেবে দেখেছেন কি?
অনেক বিজ্ঞজন বলেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় ভিসি নিয়োগই এসব সমস্যার মূল কারণ। বিনয়ের সাথে বলতে চাই, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ, চেতনায় সমমনা, বিজ্ঞ গবেষক, নীতি নৈতিকতায় সমৃদ্ধ আদর্শিক শিক্ষকের কি এতোটা ই আকাল, দেশের একুশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ মসনদে কেলেঙ্কারিতে জর্জরিত লোভাতুর মানসিকতার লেবাসধারীদেরই বসাতে হবে?
স্বায়ত্বশাসিত নয় এমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিয়োগে একটি সুনির্দিষ্ট যাচাই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হয় বলেই জানি। পান্ডিত্য, গবেষণা, আনুগত্য, ব্যক্তিত্ব, সততা সবকিছুই যাচাই বাছাইয়ের আওতাধীন থাকে, সেই সাথে রাজনীতিক আর আমলাদের সংশ্লিষ্টতায় সুপারিশ প্রাপ্ত হয়ে বিবেচনার জন্য ফাইলটি সর্বোচ্চ নির্বাহীর কাছে প্রেরিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সমাজ ও জাতির বিবেক। আর উচ্চশিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য আলোকিত ব্যক্তিরাই এসব প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে থাকবেন সেটিই তো প্রত্যাশিত। ইউজিসি কর্তৃক গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদসমূহ কি এই প্রত্যাশার সংগে সংগতিপূর্ণ? যদি না হয়, তবে শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ভাবমূর্তি বিনষ্টে তথাকথিত বিতর্কিত ভিসিদের মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় জড়িত রাষ্ট্রিয় দায়িত্ব পালনকারী মহাশয়রা এর দায় এড়াতে পারেন কি?
অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সাথে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে দক্ষ মানবসম্পদের কোন বিকল্প নেই। আগামী দিনের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার এই সত্যটি শেখ হাসিনার সরকার সঠিকভাবে উপলব্ধি করেন বলেই জেলায় জেলায় আজ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যার শাসনামলে ৪২ টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, আরও পাঁচটি বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রকল্প চলমান। জাতিকে এগিয়ে নেয়ার সুদৃঢ় প্রত্যয় না থাকলে, শিক্ষাক্ষেত্রে এমন উন্নয়ন বিপ্লব সম্ভব ছিল কি?
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও আজ ভাবমূর্তির টানাপোড়েন চলছে। মাঝেমধ্যেই নৈতিক স্খলনের অভিযোগের সংবাদ জাতিকে আশাহত করছে। সাম্প্রতিক সামিয়া-মারজানের ঘটনা সংবাদ জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে? চৌর্যবৃত্তি আর আর শিকাগো জার্নালের ভূতুড়ে এলেক্স মার্টিন বিতর্কে দেশ সেরা বিদ্যাপীঠটিও আজ কলংকিত হচ্ছে। নতুন করে এক নামীদামি অধ্যাপকের চৌর্যবৃত্তির খবর গণমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। বেশ ক’বছর যাবত ক্যান্সারসম প্রশ্ন ফাঁসের ব্যাধিতে আক্রান্ত জাতি বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনির নেতৃত্বে রোগমুক্তির পথে থাকলেও বেরোবি বিতর্কে উনাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করার প্রচেষ্টা চলমান।
বিশ্ব বিখ্যাত সব সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্য আর উন্নয়ন নিয়ে শিরোনাম হচ্ছে। সুদক্ষ ক্রাইসিস ম্যানেজার শেখ হাসিনা আজ নেতৃত্বের রোল মডেল। বাংলাদেশের টাকা আজ পাকিস্তান, শ্রীলংকার চেয়ে দ্বিগুণ শক্তিশালী, ভারতের প্রায় সমকক্ষ। মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, শিশু-মাতৃমৃত্যু হার, নারীর ক্ষমতায়ন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, নিজস্ব অর্থায়নে মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়নসহ অর্থনীতির সকল সূচকেই যখন ঈর্ষণীয় সাফল্য, এমন সময়ে শিক্ষা আর গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের সর্বোচ্চ প্রশাসনের চমকপ্রদ নেতিবাচক সংবাদ শুধু বাংলাদেশ আর বাঙালি জাতিকে নয়, জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার শেষ ঠিকানা জাতির জনকের কন্যা আদর্শের মূর্ত প্রতীক শেখ হাসিনার ভাবমূর্তির জন্যও বুমেরাং হয়ে উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার নেতিবাচক ভাবমূর্তিতে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে শিক্ষা আর গবেষণায় আগ্রহী আমাদের ভবিষ্যত মেধাবী প্রজন্ম। তাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনার ভাবমূর্তি রক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের এখনই তো শ্রেষ্ঠ সময়!!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)