দরজায় কড়া নাড়ছে শীত। তাই গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত আর বাহারি ভর্তা খাওয়ার লোভ তো জাগতেই পারে। কিন্তু পরিবার ছেড়ে ঢাকায় আসা প্রায় ফাঁকা পকেটের ব্যাচেলরদের এই চাওয়া পূরণের জায়গার বড্ড অভাব।
তবে মন থেকে চাইলেই মিলে যায় সব। সেই চাওয়া থেকে একটু খোঁজ করতেই জানা গেলো সুলভ মূল্যে ঘরের ভাত-ভর্তার স্বাদ মিলছে হাতের নাগালেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গেট দিয়ে ঢুকতেই হাতের ডানে চোখে পড়লো বেশ সুশৃঙ্খল ছোটোখাটো একটি লাইন। হাতে স্টিলের থালা নিয়ে দাঁড়ানোদের পাতে প্রথমে গরম ভাত বেড়ে দিচ্ছেন জিন্স প্যান্ট-শার্ট আর ফ্ল্যাটক্যাপ পরা বেশ গোছানো একজন প্রৌঢ়। ভাতের থালা নিয়ে এগিয়ে গেলেই তাতে কয়েক পদের ভর্তা, শাক, চাটনি তুলে দিচ্ছেন পরিপাটি আরেকজন মানুষ।
থালা হাতে ভাত নেয়ার সময় বাদশা নামের এই প্রৌঢ়ের কাছ থেকেই শুনলাম তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। আর যিনি ভর্তা দিয়ে থালা সাজাচ্ছেন তিনি তাঁর স্ত্রী রানু। নিয়মিত খেতে আসা পুরোনো শিক্ষার্থীরা এই দু’জনকে ‘ভাই’ ‘ভাবী’ বলেই ডাকেন।
প্রায় ৩ বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এমন দেশী মেন্যুর বুফে ঘরানার আয়োজনটা শুরু করেছিলেন তারা। ছয় থেকে ৭ পদের ভর্তা, কয়েক রকমের শাক, নিরামিষ চচ্চড়ি দিয়েই আয়েশ করে পেট ভরানো যায় মাত্র ৩৫ টাকায়। ডিমভূনা আর গরু-মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খাওয়া যাবে ৭০ টাকার মধ্যেই।
প্রতিদিন দুপুরের আগেই নিজ হাতে রান্না করা ভাত-ভর্তা, কয়েকরকম তরকারি বয়ে এনে ভ্রাম্যমান দোকানটি সাজিয়ে তোলেন রানু ভাবী। কালোজিরা ভর্তাটা আরেকটু চাইতেই পাতে তুলে দিলেন হাসিমুখে। তার মুখে যেনো মা-খালাদের মতো খাইয়ে আনন্দ পাওয়ার তৃপ্তি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে শুরু করে শাহবাগ এলাকায় বেশ কিছু খাবারের দোকান থাকলেও এখানে তাই জটলাটা একটু বেশিই। দিনে দুই’শ থেকে আড়াই’শ প্লেট খাবার বিক্রি করেন বাদশা ‘ভাই’। ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়ির খাবার খাইয়ে যে টাকা পান তা দিয়েই তিন মেয়ের পড়ালেখা আর সংসার চালান দু’জনে।
ভাত খেতে আসাদের বেশির ভাগের কাঁধে-পিঠেই ব্যাগ। কেউ আবার সঙ্গের গিটারটিকে ঠেস দিয়ে রেখেছে বেঞ্চের সাথে। বোঝাই যায় এদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী।
এতো খাবার দোকান, ক্যান্টিন থাকতেও এখানে ভীড়ের কারণটা জানা গেলো খেতে আসা কয়েকজনের কাছ থেকে।
‘একেবারেই ঘরের স্বাদ পাই। ঢাকায় বাসা থাকলেও ক্লাস করতে ক্যাম্পাসে আসি সকাল-সকাল। তাই দুপুরে যখন প্রচণ্ড ক্ষুধা পায় তখন আধ প্লেট খিচুরি কিংবা ছোট্ট একটুকরো মুরগি আর পানির মতো ডাল দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছা করে না। তাই চলে আসি এখানে। বাহারি পদের জন্যই খেতে ইচ্ছা করে। পকেটে টাকা কম থাকলেও পেট ভরে যায় ভাত আর নানা স্বাদের ভর্তায়’।
বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এবং সস্তাতেই অনেক আইটেম পাওয়া যায় বলে পাবলিক লাইব্রেরি থেকে এখানে খেতে এসেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য বের হওয়া মিনহাজুল ইসলাম।
‘ভাবির রান্নাটা বেশ ভালো লাগে। নানা পদের ভর্তা-তরকারি দিয়ে একঘেয়ে খাবারের রুচি বদলানো যায়। আর খাবারের মানটাও অন্যান্য হোটেলের চেয়ে অনেক ভালো এবং দামেও সস্তা’।
চাটনি দিয়ে ভাত মাখতে-মাখতে একথাই বললেন ভাবির রান্নার ভক্ত হওয়া ফারহিন সোমা।
বিল চুকিয়ে চলে যাওয়ার সময় কাছে ডেকে বাদশা ভাই জিজ্ঞেস করলেন ‘দোকানটা বন্ধ হয়ে যাবে না তো?’
প্রশ্ন শুনে কিছুটা অবাক হয়ে কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘ উদ্যানের ভেতর গেটের কোণায় ভাত বিক্রি করি। প্রতিদিন প্রায় ছাত্রছাত্রীরা এখানে খেতে আসলেও এখান থেকে মাঝে মাঝে দোকান উঠিয়ে দেয়া হয়। অথচ এই ভ্যানটাই চালাচ্ছে আমাদের সংসার। খবরে দোকান চলছে জানলে আবার হয়তো বন্ধ করে দেয়া হবে’।
এমন ভয় নিয়েও এতো ছাত্র-ছাত্রীকে প্রতিদিন সুস্বাদু খাবার খাইয়ে যাচ্ছেন বাদশা ভাই ও রানু ভাবি।