বাংলা ভাষায় সর্বকালের অন্যতম জনপ্রিয় গান ‘বড় লোকের বেটি লো’! সত্তর দশকের এই গানটি আবারও সবার মুখে মুখে। তার কারণ, গানটি রিমিক্স করেছেন বলিউডের শিল্পী বাদশা। টি-সিরিজের ব্যানারে প্রকাশ পাওয়া ‘বাদশা ফিচারিং জ্যাকুলিন’-এর এই মিউজিক ভিডিও এখন ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে! প্রকাশের সাত দিনে যা দেখা হয়েছে সাড়ে ৭ কোটি বার! তবে গানটি নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে সেই প্রথম দিন থেকেই। কেন?
বাদশার বিরুদ্ধে অভিযোগ, বাংলার তুমুল জনপ্রিয় লোকসংগীত ‘গেন্দা ফুল’কে কেন্দ্র করে এই মিউজিক ভিডিও প্রকাশ পেলেও তাতে উপেক্ষা করা হয়েছে গানটির স্রষ্ঠা কবি ও গীতিকার রতন কাহারের নাম। আর এমন ঘটনার পর পশ্চিম বাংলার মানুষ, বিশেষ করে লোকগানের সমঝদারেরা সচেতন হয়ে উঠেন। প্রকৃত গীতিকারের প্রতি কৃতজ্ঞ স্বীকার না করায় সোশাল মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচিত হন বাদশা। প্রতিবাদে শামিল হন বাংলাদেশের মানুষ ও। কলকাতার বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি গুরুত্ব পায়। কিন্তু এই বিষয়ে প্রায় পঁচাশি বছর বয়সি কবি, গীতিকার রতন কাহার কী ভাবছেন?
এমনটা জানতেই রতন কাহারের খোঁজ শুরু। তাঁর সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিলেন আকাশবাণীর সিদ্ধার্থ মাইতি। বাংলাদেশ থেকে ফোন করায় আবেগটা বোঝা গেল বহু জনপ্রিয় লোক সংগীত স্রষ্ঠা রতন কাহারের। বললেন, ‘গানের জন্য বাংলাদেশ থেকে আমার সাথে
যোগাযোগ করছেন, এরচেয়ে বড় পাওয়া আমার এই শিল্পী জীবনে আর কী হতে পারে!’এরপর শুরু হলো আনুষ্ঠানিক কথপোকথন। বিশেষ গুরুত্ব পেল সাম্প্রতিক সময়ের ‘বড় লোকের বেটি লো’ গান প্রসঙ্গটি। যার কিছু অংশ চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের জন্য:
কেমন আছেন? আপনি সুস্থ আছেন তো?
ভালো আছি, সুস্থ ও আছি। কিন্তু বয়স হয়ে যাওয়ায় একটু তো ভুগতেই হয়।
এখন সময়ও তো ভাল না!
হ্যাঁ, করোনা আসছে। আমাদের এখানেতো সব লকডাউন। কেউ বের হতে পারে না।
যাইহোক, আপনার সঙ্গে যোগাযোগ মূলত শ্রোতাপ্রিয় গান ‘বড় লোকের বেটি লো’ নিয়ে কিছু কথা জানার ইচ্ছে থেকে?
হ্যাঁ, এটা নিয়েইতো সবাই শুধু একের পর এক ফোন করছে। রাত দিন শুধু ফোন আর ফোন।
নতুন করে বাদশা নামের যে শিল্পী আপনার লেখা গানটি করলেন, এ বিষয়ে আপনার থেকে কেউ অনুমতি নিয়েছিলো?
অনুমতি তো নেয় ই নাই। কেউ যোগাযোগ ই করে নাই। আর আমি তো এই গান সম্পর্কে কিছু জানতাম ই না। আমাকে একজন গানটি দেখালো।
গানটি দেখে, শুনে আপনার কেমন লাগলো?
নারী কণ্ঠে যখন একজন গানটি গাইলেন, সেই এতোটুকু ভালই ছিলো। কিন্তু পরে হিন্দি-ইংরেজি মিশিয়ে কী একটা করলো। এটা গান! কিন্তু কী করবো, আমি তো অসহায়। এই ‘বড় লোকের বেটি লো’ গানটির জন্য আমাকে বারবার দুঃখ পেতে হয়েছে।
কী রকম?
১৯৭২ সালে এই গানটি আমি নিজেই আকাশবাণীতে গেয়েছিলাম। তখনো গানটি লোকের মুখে এতোটা ছড়ায় নি। আমার মামাদের একটি গানের দল ছিলো, সেখানে গাইতাম। এই গানটিও সেই দলে গাইতাম, অনেকেই গাইতো। এখান থেকেই গানটি শুনে লিখে নেন স্বপ্না চক্রবর্তী। ১৯৭৬ সালের দিকে প্রথমবারের মতো তিনি ‘বড় লোকের বেটি লো’ গানটি রেকর্ড করেন। এরপরই এটি ছড়িয়ে যায় সবার মুখে মুখে। কিন্তু সেটাই ছিলো এই গান নিয়ে আমার প্রথম দুঃখ পাওয়া। কারণ, সেই গানটিতে গীতিকার হিসেবে আমার নাম দেয়া হয়নি। আমার নাম না লিখে গীতিকারের জায়গায় ‘প্রচলিত গান’ লেখা হয়।
আপনি প্রতিবাদ করেন নি?
করেছিলাম তো। সেই রেকর্ডিং যারা করেছিলো, কোম্পানির কাছে গিয়েছিলাম তখন। কিন্তু আমি তাদের বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। তারা আমাকে বিষয়টি মেনে নিতে বললো। জানালো- ‘যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে!’
একই ভুল বাদশা করলেন। কিন্তু এবার তো প্রেক্ষাপট ভিন্ন। গীতিকার হিসেবে আপনার নাম দেয় নি, অথচ এবার প্রতিবাদ করছে সাধারণ মানুষ। নিউজ ও হয়েছে অনেক। এরপরও কি সেই গান সংশ্লিষ্ট কেউ আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে?
না, কেউ যোগাযোগ করেনি। আর আমি চাইও না কারো যোগাযোগ। আমি শুধু আমার সৃষ্টির স্বীকৃতি চাই।
মঙ্গলবার (৩১ মার্চ) বাদশা বিবৃতি দিয়েছেন যে, তিনি জানতেন না এটা আপনার লেখা। লকডাউন শেষে আপনার সঙ্গে তিনি দেখা করতে চান এবং আর্থিক সাহায্য করার কথাও বলেছেন। আপনি জানেন?
না। এরকম কোনো তথ্য আমরা পাইনি, কেউ যোগাযোগ করেনি। আর আমি আর্থিক সহযোগিতা পাওয়ার আশায় নেই। জীবনে লোভ লালসার পিছু নেইনি, অর্থের পিছনেও ছুটিনি।
আর কোনো গান নিয়ে আপনার সঙ্গে এরকম হয়েছে?
না। আমার গান অনেকেই গেয়েছেন। পূর্ণচন্দ্র দাস বাউল থেকে শিলাজিৎ, অনেকেই গান নিয়েছেন। তারা প্রত্যেকে আমাকে সম্মান করেন, এবং পূর্ণ সম্মানিও দিয়েছেন।
আপনার বয়স প্রায় ৮৫। এই বয়সে এসেও কি গান বাঁধতে পারছেন?
পারবো না কেন! এটাতো আমার স্বভাব! স্বভাব কি আর এতো সহজে যায়? আর গান বাঁধা ছাড়া জীবনেতো আর কিছু শিখিও নি। এটা সত্য যে, আমার বয়স হয়েছে। হয়তো এজন্য গানের চর্চাটা আগের তুলনায় কম হচ্ছে। কিন্তু গানের সাথেই ছিলাম, আছি, থাকবো ও।