পৃথিবীতে যখন তীব্র হানাহানি, মৃত্যুর তমসা, অন্ধ হিংসা এবং প্রেমহীনতা সর্বত্র বিরাজ করছিল আধ্যাত্মিকতার পরিবর্তে জাগতিকতা মানুষের হৃদয়কে আচ্ছন্ন করেছিল, পরিত্রাণের আশা যখন বিলীন হয়ে যাচ্ছিল মানব সভ্যতা থেকে; তখনই সর্বশক্তিমান পিতা পরমেশ্বর মানুষের মুক্তিদাতারূপে যীশুকে মানবরূপে এই পৃথিবীতে পাঠালেন।
দুই হাজার বছরেরও আগে এখনকার মতই পৃথিবীর মানুষ ভোগবাদ, দয়াহীনতা এবং নির্দয়তার শিকলে বাঁধা পড়েছিল। দরিদ্র এবং দুর্বলদের প্রতি নিষ্ঠুরতাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেয়া হতো। সৃষ্টির পর মানুষের পাপে পতন হলে দয়াময় পরমেশ্বর মানুষকে আবার স্বর্গে নেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যুগে যুগে বহু প্রবক্তাদের মাধ্যমে।
দাউদ বংশে মানব মুক্তিদাতা মসীহ বা খ্রিস্ট জন্ম নিবেন এ কথা যীশুর জন্মের বহু বছর আগে থেকেই বলা ছিল যেন মানুষ নিজেদের প্রস্তুত রাখতে পারে। তাই যখন যীশুর জন্মের সময় এল তখন দেখা গেল, খুবই কম সংখ্যক মানুষ প্রকৃত পরিত্রাতার সন্ধান পেল বর্তমান যুদেয়া অঞ্চলটি তখন রোমানদের অধীনে ছিল। যেরূশালেম নগরী শিকলাবদ্ধ ছিল রোমানদের কঠোর আইনে।
ইহুদীদের বার বার রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহের কারণে রোমানরা দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে পোষ্য ইহুদী নেতাদের দিয়ে শাসন করছিল সমগ্র ইহুদী জাতিকে। ইহুদীদের একটি অংশ পৌত্তলিকতার দোহাই দিয়ে রোমানদের তীব্র ঘৃণা করতো। তাই তারা আশা করছিল অতীতের মতই ঈশ্বর তাদের জন্য একজন মুক্তিদাতাকে প্রেরণ করবেন নির্যাতন থেকে মুক্তি দিতে।
তবে তাদের আশা ছিল, মসীহ বা খ্রিস্টই হবেন রাজনৈতিক মুক্তির প্রতীক। কিন্তু ঈশ্বর যে তাদের আরও স্থায়ী মঙ্গলের বিবেচনায় মানবরূপে নিজ সন্তানকেই পাঠাবেন প্রবক্তাদের বাণীর মাধ্যমে যা আগেই জানিয়েছিলেন, তার জন্য তারাও প্রস্তুত ছিল না।
তাই যীশু খ্রিস্টের জন্ম এভাবে হয়, তার মা মারীয়া দাউদ বংশের যোসেফের প্রতি বাগদত্তা হলে তারা একসঙ্গে থাকার আগে দেখা গেল, তিনি গর্ভবতী-পবিত্র আত্মার প্রভাবে। তার স্বামী যোসেফ ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন, আবার তাকে প্রকাশ্যে নিন্দার পাত্র করতে অনিচ্ছুক ছিলেন বলে তাকে গোপনেই ত্যাগ করার সঙ্কল্প নিলেন।
প্রভুর দূত তখন স্বপ্নে তাকে তখন দেখা দিয়ে বললেন,‘দাউদ সন্তান যোসেফ, তোমার স্ত্রী মারীয়াকে গ্রহণ করতে ভয় করো না, কেননা তার গর্ভে যা জন্মেছে, তা পবিত্র আত্মার প্রভাবেই হয়েছে। সে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করবে আর তার নাম রাখবে যীশু, কারণ তিনিই নিজ জনগণকে পাপ থেকে ত্রাণ করবেন।
এই সমস্ত ঘটনা বহু বছর আগে প্রবক্তাদের মধ্য দিয়ে উচ্চারিত প্রভুর এই বাণী পূর্ণ হয়, ‘দেখ, কুমারীটি গর্ভবতী হয়ে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করবে, আর লোকে তাকে ইম্মানুয়েল বলে ডাকবে।’ সেসময় রোম সম্রাট অগাস্টাস সিজারের একটা রাজাজ্ঞা জারি হল, যা অনুসারে সারা পৃথিবী জুড়ে লোক গণনা করা হবে।
এই প্রথম লোক কুল ও গোত্রের মানুষ হওয়ায় নিজের বাগদত্তা স্ত্রী মারীয়ার সঙ্গে নাম লেখানোর জন্য গালিলেয়ার নাজারেথ শহরে থেকে যুদেয়ার সেই দাউদ নগরী বেথলেহেমে গেলেন। মারীয়া তখন গর্ভবতী। তারা সেখানে থাকতেই মারীয়ার প্রসবকাল পূর্ণ হল। আর তিনি নিজ প্রথমজাত পুত্র প্রসব করলেন। কাপড়ে জড়িয়ে তিনি তাকে একটা যাব পাত্রে শুইয়ে রাখলেন।
কারণ পান্থশলা বা হোটেলে তাদের জন্য স্থান ছিল না। একই অঞ্চলে একদল রাখাল ছিল, যারা রাতে প্রহরে প্রহরে নিজ নিজ পাল পাহারা দিচ্ছিল। প্রভুর এক দূত কাছে এসে দাঁড়ালেন এবং প্রভুর গৌরব তাদের চারপাশে ঘিরে রাখলো।
রাখালরা ভীষণ ভয় পেল, কিন্তু সেই দূত তাদের বললেন, ‘ভয় পেয়ো না, কেননা দেখ, আমি তোমাদের এমন মহা আনন্দের শুভসংবাদ জানাচ্ছি, যে আনন্দ সমস্ত জনগণেরই হবে। আজ দাউদ নগরীতে তোমাদের জন্য এক ত্রাণকর্তা জন্মেছেন-তিনি খ্রিস্ট প্রভু। তোমাদের জন্য চিহ্ন এই, তোমরা কাপড়ে জড়ানো ও যাবপাত্রে শোয়ানো একটি শিশুকে পাবে।
আর হঠাৎ ঐ দূতের সঙ্গে স্বর্গীয় এক বিশাল দূতবাহিনী আবির্ভূত হয়ে এই বলে ঈশ্বরের প্রশংসা করতে লাগলো, ‘ঊর্ধ্বলোকে ঈশ্বরের গৌরব,এই পৃথবীতে তার প্রসন্নতারপাত্র মানুষের জন্য শান্তি!’ হেরোদ রাজার সময়ে যুদেয়ার বেথলেহেমে যীশুর জন্ম হওয়ার পর পূর্বদেশ থেকে কয়েকজন পণ্ডিত আকাশে এক উজ্জ্বল তারা দেখে পথ চিনে যেরূশালেমে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ইহুদীদের নবজাত রাজা কোথায়? আমরা পুবে তার জ্যোতিষ্ক দেখেছি, ও তার সামনে প্রণিপাত করতে এসেছি।’
একথা শুনে হেরোদ রাজা উদ্বিগ্ন হলেন, তার সঙ্গে সমগ্র যেরূশালেমও উদ্বিগ্ন হল। সকল ইহুদী যাজক ও জাতির শাস্ত্রজ্ঞদের ডেকে হেরোদ জানতে চাইলেন, সেই খ্রিস্টের কোথায় জন্মাবার কথা।
তারা তাকে বললেন, ‘যুদেয়ার বেথলেহেমে, কেননা প্রবক্তা যে কথা লিখেছিলেন, তা এই‘যুদা দেশের হে বেথলেহেম, যুদার জননেতাদের মধ্যে তুমি আদৌ হীনতম নও, কারণ তোমা থেকেই বের হবেন এক জননেতা, যিনি আমার জনগণ ইসরায়েলের প্রতিপালন করবেন।’
তখন হেরোদ গোপনে পণ্ডিতদের কাছে কোন সময়ে জ্যোতিষ্কটির উদয় হয়েছিল তা জেনে নিয়ে তাদের বেথলেহেমে পাঠিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আপনারা গিয়ে ভালোমতই শিশুটির খোঁজ নিন, খোঁজ পেলেই আমাকে সংবাদ দিন, যেন আমিও গিয়ে তার সমনে প্রণিপাত করতে পারি।’
পুবে তারা যে জ্যোতিষ্কটি দেখেছিলেন, তা তাদের আগে আগে চল, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই স্থানের কাছে এসে থামল যেখানে শিশুটি ছিলেন।
জ্যোতিষ্কটা দেখতে পেয়ে তারা মহা আনন্দে আনন্দিত হলেন। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে শিশুটিকে তার মা মারীয়ার সঙ্গে দেখতে পেলেন; তখন ভূমিষ্ঠ হয়ে তাঁর সামনে প্রণিপাত করলেন; পরে নিজেদের রত্নপেটিকা খুলে তাকে উপহার দিলেন সোনা, ধূপধুনো ও গন্ধনির্যাস। পরে যেন হেরোদ গোপন পরিকল্পনা করেছিল। স্বর্গদূতের আদেশ পেয়ে যোসেফ শিশুটিকে নিয়ে মিসরে পালিয়ে গেলেন এবং হেরোদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত মিসরেই শরনার্থী হয়ে থাকলেন।
‘আাঁধারে ছিল যে জাতি, পেল মহা জ্যোতিমৃত্যুচ্ছায়া কেটে গেল, দেখা দিল ভাতি।’ যীশু খ্রিস্ট সামসঙ্গীতের। যারা অন্ধকারে পথ চলত, যারা মৃত্যু উপত্যকায় বিচরণ করত তাদের উপর দেখা দিয়েছে এক মহা জ্যোতি, তারা আলোতে পথ চলবে। যীশু ঐশ সন্তান হবার পরও জগতের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী প্রাসাদ বা অট্টালিকায় ভূমিষ্ঠ হননি। আজকের দিনের যে কোনো সন্তান সম্ভবার অনিয়শ্চয়তার মতই মারীয়ার মানব পুত্র যীশকে জন্ম দিলেন গোশালায়।
দীন পরিবেশে গরীব বেশে তিনি জন্ম গ্রহণ করলেন। এটাই আমাদের আনন্দের কারণ যে আমরা ভঙ্গুর, সন্ত্রস্ত, বিচলিত, উদ্বিগ্ন হলেও আমাদের ভরসা তিনি। ঈশ্বর জগতকে এতই ভালবাসলেন যে নিজের একমাত্র সন্তানকে পরিত্রাণের জন্য দান করলেন, যেন আমরা ঈশ্বরেরই সন্তান হয়ে উঠতে পারি এবং আবার স্বর্গে তার সঙ্গে অনন্ত সুখে বাস করতে পারি।
মানব মুক্তির ইতিহাসে যীশু খ্রিস্টের জন্ম স্বর্গের শান্তি পৃথিবীতে ঝরে পড়া। তাই বড়দিন আননেদরই দিন, ঈশ্বরের গৌরব ও মহিমা প্রকাশেরই দিন।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)