চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

ব্র্যান্ড দিলেই হবে না, পেছনে একটা প্রমিজ দিতে হবে: সৈয়দ আলমগীর

সৈয়দ আলমগীর গেলো ১৯ বছর ধরে এসিআই লিমিটেডে কাজ করছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ সম্পন্ন করার পর একটি বহুজাতিক ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি মে ও বেকার লিমিটেডে তার কর্মজীবন শুরু করেন। যা বর্তমানে সানফি এভেন্টিস নামে পরিচিত। এসিআই এ যোগ দেয়ার আগে তিনি ছয় বছর যমুনা গ্রুপে গ্রুপ মার্কেটিং ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেন। তিনি বিভিন্ন কৌশলগত বিপণন কার্যক্রমে সফল অনেক ব্যান্ড তৈরি করেছেন। ১০০% হালাল সাবান এর উপর তার কাজ অনেক প্রশংসিত হয়েছে। বিশ্ব মার্কেটিংয়ের গুরু ডেভিট ফিলিপ কটলারের বইয়ে তার এই হালাল সাবান কনসেপ্ট গৃহীত হয়েছে।

ব্যবসা ও বিপণন কর্মে তিনি একজন সফল সৈয়দ আলমগীর ভোক্তাদের চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের নতুন ভোগ্যপণ্য বাজারে নিয়ে আসেন। পিওর ব্র্যান্ডের পণ্য সমূহ যেমন এসিআই পিওর লবণ, চাল, গম ও আটা ময়দা ইত্যাদি। এসিআই অ্যারোসল ও মশার কয়েল’কে বাজারে শক্তিশালী অবস্থানে উন্নয়ন করেছেন তিনি।

তার সাম্প্রতিক উদ্যোগ স্টাইলাস ব্রান্ডের মোবাইল ফোন ও স্পার্কল ব্রান্ডের ইলেকট্রনিক্স ও ইলেকট্রিক্যাল পণ্য যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছে। বাংলাদেশের জনসাধারণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন এসিআই এর এই মিশন অর্জনের লক্ষ্যে আলমগীর তার কার্যক্রমকে পরিচালনা করছেন। তার তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের শিল্প বাণিজ্যে নতুনমাত্রা যুক্ত করতে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান অনস্বীকার্য। এই বছর তিনি চ্যানেল আই ব্র্যান্ড ফোরাম এর মার্কেটিং সুপারস্টার অ্যাওয়ার্ড এ ভূষিত হয়েছেন। সম্প্রতি একান্ত সাক্ষাতকারে কথা বলেন সৈয়দ আলমগীর।

প্রশ্ন: বাংলাদেশের কনজ্যুমার ব্র্যান্ডিংয়ে আপনি একের পর এক ইনোভেটিভ আইডিয়া দিয়ে চলেছেন। এতো কাজের অনুপ্রেরণা কোথা থেকে আসে?
সৈয়দ আলমগীর: ৪০ বছর আমি এই দেশের মার্কেটে কাজ করছি এবং এই সময়ে অনেকগুলো ব্র্যান্ড দিয়েছি। আমি আইবিএ থেকে এমবিএ করার পরে একটি ওষুধ কোম্পানিতে যোগদান করি। তারপরে আমি এফএমসিজি’তে চলে আসি। এফএমসিজিতে অনেক দিন হয়েছে আমি অনেকগুলো ব্র্যান্ড দিয়েছি। আমার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হলো আমাদের ভোক্তা। শুধু একটি ব্র্যান্ড দিলেই হবে না। সেই ব্র্যান্ডের পেছনে একটা প্রমিজ দিত হবে। সেই ব্র্যান্ড নিয়ে অনেক কাজ করতে হবে এবং পরে আবার ব্যারোমিটার দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে যে, এই ব্র্যান্ডগুলো কাজে দিয়েছে কিনা? জনগণ কিনছে কিনা এবং জনগণ তা গ্রহণ করছে কিনা? তার সাসটেন অ্যাবেলিটি আছে কিনা?

প্রশ্ন: বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ট্রাস্ট?
সৈয়দ আলমগীর: হ্যাঁ। ট্রাস্ট। যখন আমি দেখলাম যে, মানুষ আমার কথাগুলো বিশ্বাস করেছে এবং আমার প্রডাক্ট ব্যাপকভাবে কিনছে। তখনই আমি আরও বেশি করে উৎসাহিত হয়েছি। এখনও যখনই আমি একটা প্রডাক্ট বাজারে দেই। মানুষ যখন তা আনন্দ চিত্তে গ্রহণ করে তখন সার্থকতা খুঁজে পাই।

প্রশ্ন: কনজ্যুমারদের রেসপন্সের উপরে মার্কেটিং টীমের উদ্দীপনা নির্ভর করে?
সৈয়দ আলমগীর: আমি সাধারণত তিনটি জিনিসের কথা বলি- প্রথমে কোয়ালিটি। কোয়ালিটির ব্যাপারে কোন ছাড় নাই। কোয়ালিটি মাস্ট বি ওয়ান নাম্বার। অন্যান্য দেশে কোয়ালিটির ব্যাপারে কোন কথা হয় না। প্রডাক্টের কোয়ালিটি থাকবেই। এই ব্যাপারে কোন কথা হবে না। কিন্তু বাংলাদেশে তা নয়। এখানে সব পণ্যই কোয়ালিটিফুল নয়। তাই বাংলাদেশে প্রোডাক্টের কোয়ালিটি মেইনটেইন করা খুব জরুরী। আরেকটা হলো- ফোকাস। আমি এটা কার জন্যে করছি সেই দিকে ফোকাস। আর তৃতীয় যেটা করি- ফর এ গ্রেটার কজ। আমি ছোট কাজের জন্যে কোন কিছু করি না।

প্রশ্ন: বিজনেস তো একদিনের জন্যে নয়?
সৈয়দ আলমগীর: অবশ্যই। একদিনের জন্যে নয়। আপনাকে একটা উদাহরণ দেই- আমি এসিআই লবণের উদাহরণ দেই। এসিআই লবণের কোয়ালিটি নিয়ে কেউ কোন কথা বলতে পারবে না। এটা শুধু বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান লবণই না। সারাবিশ্বের যে কোন ব্র্যান্ডের সাথে তুলনা করলে কোন অংশেই এই লবণ পিছিয়ে থাকবে না। দ্বিতীয় হলো- ফোকাস। উই আর ফোকাসিং ইন সার্টেন এরিয়া। এসিআই লবণ মেধা বিকাশে সহায়তা করে। বিকজ অব উই আর প্রসেস অব মেরিট ডেভলপমেন্ট। আমরা বলছি যে, বাচ্চাদের মেরিট দরকার- এন্ড উই একচুয়ালি ড্রিম অব এ মেরিটোরিয়াস বাংলাদেশ। আমরা মেরিটোরিয়াস বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি এটি হলো আমার-কজ লার্জার এরিয়া অব মাই কনসেট্রেশন। এখানে আমি একটা কজের জন্যে করছি এবং লার্জার কজের জন্যে করছি।

প্রশ্ন: সামাজিক দায়বদ্ধতার ব্যাপার আছে?
সৈয়দ আলমগীর: হ্যাঁ। তা তো বটেই। আবার আসেন আপনি- সাবানে। আমি একসময় শুরু করেছিলাম হালাল সাবান। কোয়ালিটি নাম্বার ওয়ান ছিলাম সাবানে। কোয়ালিটি নিয়ে কোন কথা হবে না। তারপরে এসেছি যে, অন্য সাবানগুলোতে এনিমেল ফ্যাট আছে। গরুর চর্বি এবং শুকরের চর্বি এই জাতীয় আছে। এখানে আমার কজ জানানো হলো। গ্রেটার কজ হলো- এই দেশটা মুসলমান এবং হিন্দুর দেশ। তাই এখানে হিন্দুরা গরুর এবং শুকরের চর্বি গ্রহণ করতে পারে না আর মুসলমানদের জন্যে শুকরের চর্বি হারাম। তাই এটা হলো গ্রেটার কজ। এইভাবে কোন কিছুই আমি ছোট কিছুর জন্যে করি না।

প্রশ্ন: সেই হালাল কনসেপ্ট থেকে এখন সারাবিশ্বে প্রোডাক্টের গায়ে একশত ভাগ হালাল লেখা থাকে?
সৈয়দ আলমগীর: হ্যাঁ। সেই ট্রেন্ড এখন সারাবিশ্বে চলছে। হালাল কনসেপ্ট এখন দারুণ জনপ্রিয়। গেল সপ্তাহে আইএমডি বিজনেস স্কুল সুইজারল্যান্ডের চীফ আমাদের এখানে এসেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানকে বলা হয় ইউরোপের হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল। তিনিও এটার খুব প্রশংসা করেছেন যে, আপনার হালাল কনসেপ্ট অনেক সুন্দর হয়েছিল।

প্রশ্ন: লোকাল ব্র্যান্ড ছাড়াও মাল্টি ন্যাশনাল ব্র্যান্ডের সাথেও আপনাদেরকে প্রতিযোগিতা করতে হয়?
সৈয়দ আলমগীর: একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানীর এই সুযোগ থাকে যে, তার প্রোডাক্টের বহু দেশে প্রমোশন এন্ড মার্কেটিং হয়। আদার ওয়াইজ আমি কোন বড় ব্র্যান্ড বা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে বদার হই না। এর কারণ আমি জানি, আমার জ্ঞান প্রজ্ঞা আছে।যে কোন ইকুয়াল কোয়ালিটির প্রডাক্ট আমি তৈরি করতে পারবো। ১৮৯৫ সালে লাক্স সাবান বাজারে দেওয়া হয়েছে। একশো দেড়শো বছরের পুরনো সাবান। আমার সাবান দিয়ে ওই সাবানকে যদি আমি কমপিট করতে পারি তাহলে আমি অনেক কিছুই পারি? আপনি দেখেন আমার এরোসল। এখানে অনেক বিদেশী কোম্পানি আছে। কিন্তু ইনসেক্ট কিলার হিসেবে এসিআই এরোসল ৯৭ শতাংশ মার্কেট শেয়ার। এছাড়া এসিআই স্যাভলন এর ৮৮ শতাংশ মার্কেট শেয়ার আমাদের।

প্রশ্ন: সারাবিশ্বেই ন্যাচারাল হারবাল প্রডাক্টের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। এই ব্যাপারে এসিআই এর উদ্যোগ কি আছে?
সৈয়দ আলমগীর: আমাদের হারবাল প্রডাক্টের রেঞ্জ আছে- নিম ও চন্দন। এসিআই এখন বিলিয়ন ডলার কোম্পানি। আমাদের চন্দনের সাবান আছে। এই প্রডাক্টগুলো একেবারেই নিম ও চন্দনের নির্যাস থেকে তৈরি হয়। যা সুইজারল্যোন্ড থেকে আমদানি হয়। এসিআই এর সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখতে যেনোতেনো ভাবে নিম সাবান বাজারে দেওয়া হয় নাই।নিমের একটি হ্যান্ডওয়াশ আপনি ট্রাই করে দেখেন। এক্সিলেন্ট।চন্দনের সাবানও খুবই উন্নত মানের। আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি নিত্য প্রয়োজনীয় সব জিনিসই এসিআই এর আছে। আমাদের প্রডাক্ট ছাড়া কোন দোকান চালানো সম্ভব না।

প্রশ্ন: ব্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে আপনারা বাংলাদেশে অনেক জনপ্রিয় তারকা তৈরি করেছেন- এই সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
সৈয়দ আলমগীর: এখন নামকরা অনেক জনপ্রিয় তারকা প্রথমে আমার প্রডাক্টের মডেল হিসেবে কাজ করেছেন। তারমধ্যে দুই একজনের নাম বলতে পারি। নায়িকা পপিকে প্রথম অ্যারোমেটিকের হালাল সাবান বিজ্ঞাপনে আমি নিয়েছিলাম। তারপরে তিনি বার্জারে, ইউনিলিভারে গিয়েছেন তাকে আর পিছনে তাকাতে হয়নি। এই রকম অনেকজন আছেন যারা আমার সাথে শুরু করেছিলেন এবং তারা নিজেদের প্রতিভার কারণে নিজেদেরকে বড় তারকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমরা হয়তো ফার্স্ট তাকে একটু ফোকাস করেছি। এছাড়া টিভি চ্যানেলগুলোকে আমরা অনেক সাপোর্ট দিয়ে থাকি। নতুন চ্যানেলগুলো যখন আসে তখন আমরা তাদেরক হেল্প করি। এই কারণে মিডিয়ার সাথে এবং প্রেসের সাথে আমাদের ব্যবসায়িক এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনেক ভাল। আমি যখন হালাল সাবানের বিজ্ঞাপন তৈরি করি তার আগে কয়টা বিজ্ঞাপন দেখতেন আপনারা? খুবই কম। আমার দেখাদেখি আমার প্রতিযোগিরাও বিজ্ঞাপনে এসেছে তাদের টিকে থাকার জন্যে। এই কারণে এই সেক্টরও সম্প্রসারিত হয়েছে।

প্রশ্ন: এখন দুনিয়া সেলফোনের ভেতরে ঢুকে গেছে। এখন আপনারা প্রোডাক্ট ব্র্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে কী ভাবছেন?
সৈয়দ আলমগীর: এসিআই এর লক্ষ্য হলো মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্যে আমরা আমাদের নলেজ এবং সম্পদের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছি। মানুষের লাইফস্টাইলকে এনহ্যান্স করার জন্যে। আপনার জীবনযাত্রার মান কখন উন্নত হয়েছে? যখন আমি ময়লা লবণের মধ্যে সুন্দর পরিষ্কার লবণ দিয়েছি। আপনাকে ভাল চাল দিচ্ছি- যে চাল পরিষ্কার করার প্রয়োজন নেই। প্যাকেট কেটে চাল ব্যবহার করা যায়। আপনাকে ভাল মরিচ দিয়েছি। এখন আর চিন্তা নাই যে, মরিচে ভেজাল আছে কিনা? এইটাও তো জীবন যাত্রার মানের উন্নয়ন। হলুদের মধ্যে কাঠের গুঁড়া আছে কিনা এটা চিন্তা করারও দরকার নাই। সকাল থেকে রাতে ঘুমিয়ে যাবার সময় অবধি সব কিছু আমরা দিচ্ছি। তারপরেও এর মধ্যে কিছু গ্যাপ আছে সেই গ্যাপ আমরা খুঁজছি।

প্রশ্ন: এথিক্যাল বিজনেস প্রাকটিসের ক্ষেত্র সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
সৈয়দ আলমগীর: অনেকে শর্টকাট ব্যবসা করার চেষ্টা করে। কেউ শর্টকাট করে তার কোয়ালিটিতে, কেউ শর্টকাট করে তার টেকচারে, আবার কেউ করে অন্যভাবে। কিন্তু এগুলো টেকে না। কিন্তু এসিআই আমরা নিজেদের ভ্যালুজ’কে খুব মূল্যায়ন করি। সঠিকভাবে ট্যাক্স দেই। কোয়ালিটি আমাদের সফলতার প্রধান মন্ত্র।