সবাই ভেবেছিলেন নির্বাচন শেষে শুক্রবারের সকাল ব্রিটেনের জন্য শুরু হবে অনেক বেশি রাজনৈতিক স্পষ্টতা নিয়ে। এর মাধ্যমে দেশটি মাত্র ১০ দিন পর শুরু হতে যাওয়া ব্রেক্সিট প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর প্রস্তুতি নিতে পারবে তারা। কিন্তু বিধিবাম!
যে মধ্যবর্তী সাধারণ নির্বাচন ব্রেক্সিট (ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বিদায় প্রক্রিয়া) পরিস্থিতিকে আরও দৃঢ় করার কথা ছিল, সেই নির্বাচনই এনে দিলো একটা ঝুলন্ত পার্লামেন্টের অনিশ্চিত গন্তব্য। এতে স্বাভাবিকভাবে মর্মাহত প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে, যিনি নিজের অবস্থানের পাশাপাশি দলের ভিতকেও নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দুর্বল করে ফেললেন।
নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারালেও নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের রক্ষণশীল পার্টি ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে নতুন সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন টেরেসা মে ও তার কনজার্ভেটিভ পার্টি। ডিইউপি’র পক্ষ থেকেও জানানো হয়েছে, টোরি চিফ হুইপ গ্যাভিন উইলিয়ামসনের সঙ্গে শনিবারের বৈঠকে সরকার গঠনের ব্যাপারে ইতিবাচক আলোচনাই হয়েছে।
তবে আসন্ন ব্রেক্সিট আলোচনার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার বদলে মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকা এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর কারণে টেরেসার ওপর ক্ষুব্ধ তার দলেরই লোকজন। এমনকি তাকে পদত্যাগ করার জন্যও বিভিন্ন দিক থেকে চাপ দেয়া হচ্ছে।
এরপরও তিনি যখন নিজেই ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছেন, সেক্ষেত্রে ডিইউপি’র সঙ্গে জোট করে সরকার গঠন ছাড়া এ মুহূর্তে আর কোনো উপায় নেই তার কাছে। আর এ বিষয়টি সামনের দিনগুলোতে কিংবা বছরজুড়ে ব্রিটিশ রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
৮ জুনের নির্বাচনের পর গঠিত নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে পার্লামেন্টে প্রতিটি ভোট এবং ইস্যুকে আলাদাভাবে বিবেচনা করতে হতে পারে। কিন্তু তা ডেকে আনতে পারে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা।
ভোটারদের কথা বাদ দিলেও দুই-তৃতীয়াংশ কনজারভেটিভ সদস্যই যেখানে টেরেসার পদত্যাগ দাবি করে তার বদলে বোরিস জনসনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছেন, সেখানে টেরেসা প্রধানমন্ত্রী হলে তার ওপর চাপ আরও বাড়বে।
যুক্তরাজ্যে সরকার গঠন প্রক্রিয়া
যুক্তরাজ্যে কোন দলের এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করতে হলে মোট ৬৫০ আসনের পার্লামেন্টে কমপক্ষে ৩২৬টি আসন প্রয়োজন। কিন্তু কনজার্ভেটিভ পার্টি ৮টি আসন কম পেয়ে সেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। তাই ডিইউপির এমপিদের সমর্থন পেলে কনজারভেটিভ দল সরকার গঠন করে পার্লামেন্টে বিল পাস করাতে পারবে।
পার্লামেন্টে ডিইউপির স্থায়ী সমর্থন নিশ্চিত করতে টেরেসা সরকারের জন্য সবচেয়ে সহজ উপায় ‘আস্থা ও সরবরাহ’ চুক্তি। এ চুক্তি অনুসারে, অনাস্থা ভোট এবং সরবরাহের (বাজেট) ইস্যুতে সরকারকে সমর্থন করবে ডিইউপি। বিনিময়ে দলটি তাদের কিছু নীতি বাস্তবায়নে সরকারের সমর্থন এবং সহায়তা নিতে পারবে। এ ধরনের চুক্তি বেশ শিথিল ধরনের হয়। এ কারণেই এমন চুক্তিবদ্ধ সরকারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত জোট সরকারের অনেক পার্থক্য।
যুক্তরাজ্যে সংখ্যালঘু সরকারের ভালোমন্দ
যুক্তরাজ্যে সংখ্যালঘু সরকার এবারই প্রথম নয়। টেরেসার আসন্ন সরকারেরও বছর দশেক আগে স্কটল্যান্ডে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির সংখ্যালঘু সরকার ছিল। এছাড়া ’৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াই সরকারের শেষ দিনগুলো চালান জন মেজর। অন্যদিকে জেমস ক্যালাঘান ও হ্যারল্ড উইলসন সংখ্যালঘু সরকার নিয়েই ’৭০-এর দশকের বড় একটা সময় ক্ষমতায় ছিলেন।
তবে এ জাতীয় সংখ্যালঘু সরকারের সীমাবদ্ধতা এবং দুর্বলতাও অনেক। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এরা পার্লামেন্টে যত কম সম্ভব বিল তোলে। তারপরও ক্ষমতা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যায়। তাই কনজার্ভেটিভ পার্টির সঙ্গে ডিইউপির চুক্তি হলেও সরকারের স্থায়ীত্ব ও স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে।
এ সম্পর্কে ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর গভর্নমেন্ট বলছে, সংখ্যালঘু সরকারের ক্ষমতার স্থায়ীত্ব এবং কাজ চালিয়ে যাওয়া ওই সরকারের মন্ত্রী, পার্লামেন্টের সদস্য ও গণমাধ্যমের চিন্তাধারার ওপর নির্ভর করে। এসব সরকারের ঠিকঠাক টিকে থাকার জন্য তাদের চিন্তাধারা বদলাতে হবে। একইসঙ্গে মন্ত্রীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার মনোভাব বাদ দিতে হবে এবং এর মধ্য দিয়ে কী অর্জন করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে বেশি বাস্তববাদী ও কম উচ্চাভিলাষী হতে হবে।
এছাড়া এমপিদের সমঝোতা ও ছাড় দেয়ার মানসিকতা রাখতে হবে বলে মনে করে এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে সরকারের সব হারকেই আস্থা হারানো হিসেবে না দেখানো হবে গণমাধ্যমের কাজ।
অন্তত ব্রেক্সিটের পুরো প্রক্রিয়াটি ঠিক সময়ে এগিয়ে নেয়ার জন্য এই সরকারকে এখন সবাই মিলে টিকিয়ে রাখা দরকার বলে মনে করে ব্রিটিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর গভর্নমেন্ট।