বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প। এই শিল্পের ৮০ ভাগই নারী শ্রমিক। তাদের দুর্দশা অজানা নয়। ব্রিটিশ গণমাধ্যম ডেইলি মেইল অনলাইনের এক প্রতিবেদনেও সেই করুণ চিত্র ফুটে উঠে। বদ্ধ পরিবেশে, কঠোর শ্রমে তৈরি পোশাকগুলোর এক অংশ ব্রিটিশ স্কুলগুলোতে যাচ্ছে ইউনিফর্ম হিসেবে, অথচ এর শ্রমিকরা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারে না।
এই পোশাক শ্রমিকদের মজুরি দরিদ্র সীমার অনেক নিচে। অর্থের অভাবে অনেকেই সন্তানদের কাছে রাখতে পারেন না। টাকা বাঁচাতে বাচ্চাদের সাথে দেখাও হয় বছরে দুয়েকবার। দারিদ্রের কষাঘাতে সন্তানের ভবিষ্যত নষ্ট করার আক্ষেপও ঝরে পড়ে তাদের মুখে।
টেস্কো, আসডা, আল্ডির মতো শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করে বাংলাদেশের এই পোশাক শ্রমিকরা। এই মায়েরা চুক্তিভিত্তিতে ব্রিটিশ স্কুলের জন্য ইউনিফর্ম তৈরি করে। তপ্ত, বদ্ধ পরিবেশে কাজ করতে হয় তাদের। মজুরি পান প্রতি ঘন্টায় মাত্র ২৫ পেন্স (২৭.৬৭ টাকা)।
যুক্তরাজ্যে এই মাসে নতুন স্কুল বর্ষ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করা স্কুল পোশাক কেনার ধুম পড়েছে সেখানে।এমন সময়েই ডেইলি মেইল অনলাইনের এই তদন্ত প্রতিবেদন।
গাজিপুরের কয়েকটি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের সাথে কথা বলে ডেইলি মেইল। কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে মির্জাপুরের নাজ, আশুলিয়ার অনন্ত ফ্যাক্টরি এবং ডিআইআরডি কম্পোজিট টেক্সটাইলস ফ্যাক্টরি। নিজেদের কষ্টের বিবরণ দেন তারা। এদের সাথে কথা বলে এবং অনুসন্ধান শেষে কয়েকটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয় গণমাধ্যমটি।
তারা দেখতে পায়, এই মায়েরা পরিবার নিয়ে বস্তিতে একরুমের টিনের ঘরে থাকে। একজন মা বাড়তি আয়ের জন্য তার ছেলেকে (১৪) স্কুলে না পড়িয়ে টি স্টলে কাজে দিয়েছে। বদ্ধ অবস্থায় ১২ ঘন্টার শিফটে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় বলে অভিযোগ কর্মীদের। অনেক নারী জাতীয়ভাবে বাংলাদেশে নির্ধারিত নুন্যতম মজুরি পান, তা জীবন ধারণের জন্য তাদের প্রয়োজনের তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র।
নাজ ফ্যাক্টোরির একজন জানান, তাকে বৈধ নুন্যতম মজুরি ৫৩০০ টাকা দেয়া হয়। সময়মতো আসার প্রেক্ষীতে ৫০০ টাকা বোনাসও পান। ৬ দিনে, ৪৮ ঘন্টা সপ্তাহ ভিত্তিতে তাদের মূল বেতন নির্ধারিত, অর্থাৎ ঘন্টায় ২৭.৬৭ টাকা। অনেক শ্রমিকই অতিরিক্ত কাজ করেন বাড়তি আয়ের জন্য।
১০ বছরের এক মেয়ে সন্তানের মা অর্থাভাবে মেয়েকে স্কুলে পড়ানো বাদ দিয়েছেন। ইংল্যান্ডে একটি স্কুল শার্টের মূল্য এক কাপ কফির সমান, শুনে এই মা বিস্মিত। সস্তা মূল্যে পোশাক কেনা ব্রিটিশ অভিভাবকদের প্রতি তাদের কঠোর পরিশ্রম অনুধাবনের আহ্বান জানান তিনি। বলেন, কোম্পানিগুলো এই স্কার্ট, শার্টগুলোর জন্য একটু বেশি মূল্য ধরলেই আমাদের জীবনটা আরও ভালো হতো।
পোশাক শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা ল্যাবার বিহাইন্ড দ্য লেবেল-এর পলিসি ম্যানেজার ডোমিনিক মুলার বলেন, বাংলাদেশে নুন্যতম মজুরি জাতিসংঘের নির্ধারিত দরিদ্র সীমার চেয়েও অনেক কম।
আশুলিয়ার অনন্ত ফ্যাক্টরির মেশিন অপারেটর নাসরিন (৩০) ছেলে মান্নানকে (১৪) স্কুল থেকে বের করে এনে টি স্টলে কাজ করতে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমার মনে হয় আমি আমার সন্তানের জীবন নষ্ট করেছি। তারা যদি আমাকে আরও বেশি বেতন দিতো, আমি তাকে স্কুলে পাঠাতাম।
দ্য ডিআইআরডি কোম্পোজিট টেক্সটাইল ফ্যাক্টোরিতে মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করা শামিমের (৩০) স্ত্রী ও সন্তান (১২) রয়েছে। তার ছেলে থাকে গ্রামের বাড়িতে। তিনি বলেন, আমি ছেলেকে খুব মিস করি। আরেকটু বেশি আয় করলে তাকে আমার কাছেই রাখতাম।
মির্জাপুরের নাজ ফ্যাক্টোরিতে কাজ করা ঝুমা (ছদ্মনাম) ছেলেকে (৪) আত্মীয়দের কাছে রেখে স্বামীর সাথে এক রুমের এক জীর্ণ ঘরে থাকেন। ছেলের কাছে যেতে আসতে খরচ হয় ৬৭০ টাকা। তাই বছরে শুধু দুবার ছেলের সাথে দেখা করতে পারেন তিনি।
এক প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার বলেন, শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে চাইলেও তারা নিরুপায়। এখানে মার্কেট ধরার প্রতিযোগিতা যেমন তীব্র, তেমনি সাপ্লাই চেইনের প্রতিটি স্তরে খুচরা বিক্রেতারা সর্বনিম্ন মূল্যেই কিনতে চায়।