১৯৫৮ সালে ব্রজেন দাশ প্রথম বাঙালি হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে আমাদের গর্বিত করেছিলেন। এরপর বিক্রমপুরের ব্রজেন দাশ আরও ৫ বার মিলিয়ে মোট ৬ বার ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছিলেন। ঘটনাটি জানেন মার্কিন বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) এর এশিয়া অঞ্চলের প্রযোজক ব্রিটিশ সাংবাদিক বেকি হর্সব্রুগ। সাঁতারের সঙ্গে সাংবাদিকতার সম্পর্ক কি প্রশ্ন উঠতে পারে? সম্পর্ক, এই বেকি শখের সাঁতারু এবং সাঁতার প্রশিক্ষকও। প্রথম নারী এবং ব্রিটিশ হিসেবে ৪ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট টানা সাঁতরে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন ইতিহাসে। তবে তার সাঁতারের উদ্দেশ্য পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে সচেতনতা ও তহবিল সংগ্রহ।
পেশা সাংবাদিকতা হলেও শখে সাঁতার নিয়ে কাজ করেন তিনি। পেশাদার সাঁতারু না হলেও ছোটবেলা থেকে ইচ্ছার জোরে ও স্বল্প প্রশিক্ষণে সাঁতারে দক্ষতা অর্জন করেন ব্রিটিশ বেকি। তার মতে জীবন বাঁচানোর এই দক্ষতা অর্জন করলে খুব সহজে মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা সম্ভব। বেকির ভাষ্য, ‘আমি অতো বেশি দক্ষ নই। তবে আমার সাঁতারের প্রশিক্ষণ রয়েছে। মানুষকে সাঁতার শেখার সুযোগটা করে দেওয়া দরকার। অল্প প্রশিক্ষণ আর স্বল্প সময়ে সাঁতার শেখানো সম্ভব।’
চ্যানেল আই অনলাইনে এসেছিলেন বেকি। তার সঙ্গে আলাপনে উঠে আসে সাঁতার ভালোবাসা সাংবাদিকের এক মহৎ উদ্দেশ্যে।
‘ব্রজেন দাশ সম্পর্কে জানা আছে?’ হাসতে হাসতে শুরু করেন বেকি। ‘জানবনা মানে। অবশ্যই জানি। সে ৬ বার আমাদের ইংলিশ চ্যানেল পার হয়েছে আর আমি ৭ বার করব।’ পরমুহুর্তে বেকি বলেন, আরে দূর! আমি পানিতে ডোবার হার কমাতে সচেতনতা তৈরি করতে চাই। সে জন্যই সাঁতার। আমি প্রতিবছর এখানে আসতে চাই। আমার সারা বিশ্বের সাঁতারু বন্ধুদের নিয়ে আসতে চাই। যদি তোমরা সুযোগ দাও!’
অনানুষ্ঠানিকতায় শুরু হয়ে যায় আলাপন। আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘বাংলা চ্যানেলে সাঁতারের পেছনের গল্প জানতে চাওয়া হলে এপি সাংবাদিক বেকি বলতে শুরু করেন। ‘গতবার প্রথমবারের মত বাংলাদেশে এসেছিলাম সাঁতার প্রকল্পে সহায়তা করতে। চ্যারিটি ছিল সেটি। কিন্তু যখন প্রজেক্টটি শেষ হল হঠাৎ করেই জানতে পারি বাংলাদেশে প্রতি দিন ৫০ জন মারা যায় পানিতে ডুবে। ১-১৭ বছর বয়সী। বছরের হিসেবে এ সংখ্যা দাড়ায় প্রায় ১৮০০০। সংক্রামক রোগের বাইরে কোন কারণে এমন মৃত্যুর হারে বাংলাদেশে এটি সর্বাধিক। অথচ কারো এদিকে খেয়াল নেই। এটি প্রতিরোধ যোগ্য একটু সচেতন হলে। সাঁতারটা জানা থাকলে। তথ্যটি আমাকে চমকে দেয়। আমি সাঁতার ভালোবাসি, নিজে যোগ্যতার সঙ্গে সাঁতার শেখাই ফলে বিষয়টি নিয়ে তখনই চিন্তা শুরু করি। সিদ্ধান্ত নেই সাঁতার বিষয়ক কিছু প্রকল্প নিয়ে কাজ করব। পরে ফিরে যাই। কিন্তু বিষয়টি আমার মধ্যে ছিল। এ বিষয়ে নিজে কি করতে পারি, তথ্যগুলো কিভাবে ছড়ানো যায় ভাবতে থাকি। খোঁজখবর নেওয়া শুরু করি ইন্টারনেটে এখানকার সাঁতার সম্পর্কে। তখন এক ফেসবুক পেজে বাংলা চ্যানেলে সাঁতারের বিষয়টি জানতে পারি। আমার ভাবনাকে এর সঙ্গে সমন্বয় করার চিন্তা আসে। আমার আগে কোন ব্রিটিশ এখানে সাতার কাটেনি। আয়োজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এইতো।’ পরের প্রশ্ন থাকে বেকির জন্য, ‘আমরা জানি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা ছিল এই সাঁতারের উদ্দেশ্য। বাংলা চ্যানেল জয়ের পরবর্তী পরিকল্পনা কি?’ প্রশ্নের শেষ ভাগ ধরে হাসতে হাসতে বেকি বলেন, বাংলা চ্যানেল জয়ের কথা বলছ কেন আমি কেবল ম্যানেজ করেছি। জয় তো আগেই হয়েছে। তারপরেই প্রশ্নের আসল অংশের উত্তরে বলেন বেকি, আমার মূল উদ্দেশ্য প্রথমত এই তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া যে একটু সচেতন হলে ডুবে মৃত্যুর হার অনেক কমানো যায়। দ্বিতীয়ত, সাঁতার বিষয়ক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে মানুষকে পথ দেখানো।
অভিভূত স্বরে বেকি বলেন, আমার কথাগুলো মানুষের মাঝে এতটা সাড়া জাগাবে আমি চিন্তা করিনি।, অনেকে এসে জিজ্ঞাসা করেছে আমি কি করতে চাই, সহায়তার প্রস্তাব করেছে। তো এখন প্রথম ও মুখ্য কাজ মনে করি মানুষকে সচেতন করে তোলার বিষয়টি ছড়িয়ে দিতে যথাযথ পরিকল্পনা করা।
দৃঢ়তা মাখানো কণ্ঠে ব্রিটিশ সাংবাদিক-সাঁতারুর উত্তর, ‘এরজন্য সম্ভাব্য যা যা করতে হয় করব।’ আক্ষেপের স্বরে বেকি জানান, ব্রিটেনে বছরে ১৫ জন মারা যায় পানিতে ডুবে। সেখানে বাংলাদেশে সংখ্যাটি অনেক বেশি। ফলে অধিক মনোযোগ দাবী করে সব দিকে। সেটা পাচ্ছেনা। এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত বলে মনে করেন বেকি।
সাঁতারের প্রতি ভালোবাসার পেছনে একটি ব্যক্তিগত বেদনাও রয়েছে বেকির। তার বাবা-ভাই বেশ কয়েক বছর আগে মারা যান। সেই মানসিক যন্ত্রণাজাত চাপ ভুলতে সাঁতারের কাছে নিজেকে নিবেদিত করেন বেকি। তার মতে সাঁতার মানসিক সুস্থিরতা আনে। স্বস্তি দেয়।
পরবর্তীতে বাংলাদেশী মেয়েকে নিয়ে সাঁতারের ঘোষণা প্রসঙ্গে বেকি বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে বাংলাদেশ মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশ রক্ষণশীল । অথচ তাদের সাতার জানাটা জরুরী। আমার জন্য সাঁতার শেখাটা সহজ ছিল। সব জায়গায় সুইমিং পুল আছে। আমি যেখানে লন্ডনে থাকি সেখানে সুইমিং ক্লাব আছে। আমি বাংলা চ্যানেল পারি দিয়েছি যাতে বাংলাদেশের মেয়েরা বলতে পারে, সে পেরেছে আমিও পারব। অন্তত, আগামী প্রজন্মের কাছে উদাহরণ এবং অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে যেন থাকতে পারি সে ভাবনা থেকে আমি এমনটি চেয়েছি। আমার কাছে এটি নারীর ক্ষমতায়নের একটি অংশ বলে মনে হয়েছে।’
বাংলা চ্যানেল আগামীতে সাঁতারুদের আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে কিনা প্রশ্নে বেকির উত্তর, ‘আমার মনে হয় বাংলা চ্যানেল সম্পর্কে অনেকেই জানেননা। এটা জানাতে হবে। আমি একটি বিরাট সাঁতারু সম্প্রদায় এবং সামাজিক মাধ্যমের প্রতিনিধি। ইউরোপ আমেরিকায় প্রায় ৩০০০০ সাঁতারু আছে। যারা, হলিডে সুইমার। কিন্তু তাদের কারোরই এ বিষয়ে ধারণা ছিলনা আমার এখানে অংশগ্রহণের আগে। আমাকে দেখে অনেক যোগাযোগ করে বলেছে, দারুণতো। আমিও অংশ নিতে চাই। আগামী বছর তিন-চারজন ব্রিটিশ বাংলা চ্যানেলের সাঁতারে অংশ নেবে এটি নিশ্চিত।
বাংলাদেশের একটি বেসরকারি সংস্থা সিআইপিআরবি (সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এন্ড রিসার্চ)-এর জন্য তহবিল সংগ্রহের জন্য তিনি সাঁতরে বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন। তাকে সঙ্গে নিয়ে সাঁতারের বিষয়ে বড় পরিসরে কাজ করার কথা ভাবছে সংস্থাটি। বেকিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কাজটি করার জন্য।
এবং বাংলা চ্যানেল ইতিবৃত্ত: টেকনাফ বদর মোকাম থেকে থেকে সেন্টমার্টিন। দেড় দশক আগেও ১৪.৪ কি.মি দূরত্বের এই চ্যানেল মাছ ধরা ট্রলারে করে পাড়ি দিতে হতো। এখন বাহন জাহাজ। ২০০৬ সালে কিছু অভিযাত্রীর পরিকল্পনা ছিল একটু অন্যরকম। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপে যাবেন ট্রলারে করে নয়, সাঁতার কেটে। পরিকল্পনার নায়ক স্কুবা ডাইভার, চিত্রগ্রাহক এবং বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চারের অন্যতম গুরু মরহুম কাজী হামিদুল হক (১৯৪৯-২০১৩)।
প্রথমে অনেকেই অবাক হয়েছিলেন তাঁর কথায়। তবে তাঁর কথায় বিশ্বাস রেখেছিলেন তিন অদম্য তরুণ লিপটন সরকার, ফজলুল কবির সিনা, সালমান সাঈদ। এই সাঁতারের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেছিলেন।
১৪ জানুয়ারি ২০০৬। কাজী হামিদুল হকের নেতৃত্বে বিশাল সাগরে সকালে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিন তরুণ। সেই থেকে শুরু সাঁতারুদের স্বপ্নযাত্রা। বদর মোকাম থেকে সেন্টমার্টিন জেটি পর্যন্ত সমুদ্র চ্যানেলের নাম দেয়া হলো বাংলা চ্যানেল। ১১ বছর পেরিয়েছে এই ‘বাংলা চ্যানেল সাঁতার’। কাজী হামিদুল হকের প্রতিষ্ঠান এক্সট্রিম বাংলা’র সঙ্গে আয়োজনে আয়োজক হিসাবে যুক্ত হয়েছে এভারেস্ট একাডেমি, ষড়জ অ্যাডভেঞ্চারসহ আরও অনেক প্রতিষ্ঠান। আর প্রতিবছর এই বিজয়ে নাম লিখিয়েছেন অনেকেই। লিপটন সরকার এ পর্যন্ত ১০বার সাঁতরে পাড়ি দিয়েছেন বাংলা চ্যানেল। বাংলাদেশের প্রথম এভারেস্ট-জয়ী মুসা ইব্রাহীমও নাম লিখিয়েছে এই বাংলা চ্যানেল সাঁতারে। ২০১১ ও ২০১২ সালে তিনি সাঁতরে পাড়ি দিয়েছিলেন বাংলা চ্যানেল। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য হলেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যান মনিরুজ্জামান। তিনি ২০১২ সাল থেকে একাধারে চারবার পাড়ি দিয়েছেন এই চ্যানেল।
২০১২ সালে বদলে যায় বাংলা চ্যানেলের গতিপথ ও দূরত্ব। টেকনাফের শাহ পরীর ফিশারিজ জেটি থেকে (বিজিবি’র চৌকির পাশে) শুরু করে নাফ নদী হয়ে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিতে ১৬.১ কিলোমিটার দূরত্ব পাড়ি দেয়ার নিয়ম যুক্ত করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল সুইমিং ফেডারেশনের (FINA or Fédération internationale de notation; English: International Swimming Federation) নিয়ম অনুসারে মুক্ত জলাশয়ে ১০ মাইল বা ১৬.১ কিলোমিটার সাঁতার হলো মুক্ত জলাশয়ের ম্যারাথন সাঁতার।
এই বাংলা চ্যানেল ম্যারাথন সাঁতারে ২০১২ সালে যুক্ত হয়েছিলেন নেদারল্যান্ডের সাঁতারু ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী ভ্যান গুল মিলকো। তাকে সঙ্গী করে ২০১২ সালের ১৭ মার্চ বাংলা চ্যানেল পাড়ি দেন মুসা ইব্রাহীম, লিপটন সরকার এবং মনিরুজ্জামান। সে বছর থেকেই বাংলা চ্যানেল সাঁতারের নাম “ইন্টারন্যাশনাল ওপেন ওয়াটার লং ডিসটেন্স সুইমিং লিস্ট”ভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা আরও একবার গৌরবান্বিত হয়েছে।
এ পর্যন্ত প্রায় ১৭ জন পাড়ি দিয়েছেন এই বাংলা চ্যানেল। যার মধ্যে কোন নারীর নাম ছিলনা।