১৯৭১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি। সকাল ১০টা। ঢাকা স্টেডিয়ামে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম) প্রথম ও একমাত্র বাঙালি ক্রিকেটার হিসেবে পাকিস্তান দলের হয়ে বেসরকারি টেস্ট খেলতে নামলেন রকিবুল হাসান। প্রতিপক্ষ আন্তর্জাতিক একাদশ। করাচির আজমত রানাকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাটিংয়ে নামলেন ১৮ বছরের তরুণ রকিবুল। তখন একজন ফটোগ্রাফার প্রথম খেয়াল করলেন ভিন্ন এক ব্যাপার। ছুটে এলেন ছবি তুলতে। খানিকপরই স্টেডিয়ামজুড়ে খবর ছড়িয়ে পড়ল— ‘জয় বাংলা’ স্টিকার নিয়ে পাকিস্তানের হয়ে খেলছে একজন বাঙালি ছেলে।
খানিক পরে স্টেডিয়ামে থাকা প্রায় ১৫ হাজার দর্শক স্লোগান তুলল- জয় বাংলা। পাকিস্তানি প্রশাসনের কাছে সেই ঘটনা ছিল দেশদ্রোহীতার সামিল। যে কারণে পরবর্তীতে হুলিয়া জারি করেছিল পাকিস্তানি মিলিটারি। পরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হতেই রকিবুল ব্যাট ছেড়ে হাতে তুলে নেন অস্ত্র। দেখেছেন গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। ব্যাট-বল হাতে বয়ে নিয়ে গেছেন প্রতিভার ধারা।
সেই ব্যাটন এখন উত্তরসূরি মাশরাফী-সাকিব-তামিম-মুশফিকদের হাতে। রকিবুলের স্বপ্ন ছিল এমনই। তবে স্বাধীনতার আগে পাকিস্তানিদের কাছে যে বৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন, সেটি মনে পড়লে সিংহমূর্তি হয়ে ওঠেন ৬৫ বছর বয়সী এই সাবেক ক্রিকেটার।
’৭১ এর আগে উত্তাল সময় এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, ক্রিকেট, মুক্তিযুদ্ধ, বৈষম্য নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান, জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক, ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ, আন্তর্জাতিক ম্যাচ রেফারি, সাংবাদিক এবং মাঠে বাংলাদেশের হয়ে এক অভূতপূর্ব প্রতিবাদ গড়ে তোলা মহানায়ক রকিবুল হাসান।
রকিবুলের স্মৃতিকথায় সেই সময়: আমার জন্ম পুরনো ঢাকায়। ১৯৬৮ সালে মেট্রিক পাশ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। তখন থেকেই ক্রিকেটে নিয়মিত ছিলাম। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের একাদশে খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম, যখন ক্লাস টেনে পড়ি। তার আগ থেকেই প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ খেলি আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে। সে অবস্থায় করাচি, লাহারে খেলার সুযোগ এসেছিল। মোটামুটি ভাল খেলেছিলাম বলে ‘পূর্ব পাকিস্তানে’র অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে খেলেছি। বৈষম্যের শিকার তখন থেকেই হতে থাকি।
তখন পাকিস্তান দলে রাখলেও ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি। ভাল খেলার সুবাদেও। পরবর্তীতে পাকিস্তান টিম ঢাকায় নিউজিল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচ খেলল। সেই টেস্টে আমাকে পাকিস্তান স্কোয়াডে রাখা হল। কিন্তু ম্যাচে আমাকে দ্বাদশ খেলোয়াড় করে রাখা হয়। বৈষম্যের ধারাবাহিকতা চলতেই থাকল। তবুও আমার স্বপ্ন ছিল পাকিস্তান দলে খেলার। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। অনেক লড়াই করতে হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তান একাদশে আমরা খুব ভাল টিম ছিলাম তখন। মরহুম জুয়েল (আব্দুল হালিম চৌধুরী) সেও একাদশে ছিলেন। আমরা একসঙ্গে রুমমেট হিসেবে থাকতাম সবসময়। আমরা উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান ছিলাম। তার জায়গাতেই পরে আমি পূর্ব পাকিস্তান একাদশে নিয়মিত খেলি। কিন্তু পাকিস্তান দলে আমাকে নিয়ে বৈষম্য চলতে থাকল।
১৯৭১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, ঢাকাতে একটি বেসরকারি টেস্ট ম্যাচের আয়োজন করা হয়। পাকিস্তান বনাম আন্তর্জাতিক একাদশ। সেই টেস্টে প্রথম বাঙালি হিসেবে আমি খেলার সুযোগ পাই। সেটা একটা ঐতিহাসিক ম্যাচ নানা কারণেই। আমার জীবনেরও স্মরণীয় ম্যাচ। তখন রাজনৈতিক অঙ্গন খুব উত্তাল। কারণ আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হয়ে গেছে। দুই পাকিস্তান মিলে এই নির্বাচনে মেজরিটি পেয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। প্রথমবারের মতো পাকিস্তানের প্রশাসনে বাঙালি যাওয়ার রাস্তা তৈরি।
তখন ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হয়েছি। ক্লাস শুরু হয়নি সেভাবে। রাজনৈতিক ডামাডোল চলছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা আমরা টের পাচ্ছি। ভুট্টো, ইয়াহিয়া; তাদের অধীনে মিলিটারি শাসন চলছে। তারা চিন্তাই করে নাই পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে আওয়ামী লীগ। তারা ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছিল। এটাকে কীভাবে ভঙ্গ করা যায়। যেটা বোঝার জ্ঞান আমাদের ছিল। ইন্টার পাশ করেছি, ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত না হলেও করতাম।
আমরা তখন শঙ্কিত ছিলাম। ভালভাবেই বুঝতাম কী হচ্ছে না হচ্ছে, কী হতে যাচ্ছে। সময়টাতেই ওই ক্রিকেট ম্যাচটা আয়োজন করা হয়। তখন পাকিস্তান টিমে আজমত রানা ও আমি ওপেন করেছি। দুই টিমই আমরা পূর্বাণী হোটেলে ছিলাম। আমাদের দলের অধিনায়ক ছিলেন সাঈদ আহমেদ। দিনটি ২৬ ফেব্রুয়ারি। অনেকেই জানে সেদিন আমি সাহসিকতার কী নজির দেখিয়েছিলাম। যেটা নিয়ে আজও গর্ববোধ করি।
পাকিস্তান টিমের খেলোয়াড়রা করাচি, লাহোর, রাওয়ালপিন্ডির। আমিই একমাত্র বাঙালি। আজমতের সঙ্গে ওপেন করবো। আগেরদিন পাকিস্তান টিমের সবাইকে ক্রীড়া সামগ্রী দেয়া হয়েছিল। ব্যাট, প্যাড, গ্লাভস। এখনকার মতো অত পেশাদারিত্ব না থাকলেও ক্রিকেট গিয়ারস দেয়া হত। সবাইকে ব্যাট দেয়া হয়েছে। সবার জন্য গ্রে নিকোলস ব্যাট। আমার ব্যক্তিগত ব্যাটটির ব্র্যান্ড ছিল গান অ্যান্ড মুর। গ্রে নিকোলসের লোগো লম্বা আকৃতির সেটা আমি জানতাম। গান অ্যান্ড মুরের লোগো সমতল। তখনই আমার মাথায় আসল ব্যাপারটা।
বঙ্গবন্ধু তখন ছাত্র নেতাদের আভাস দিয়ে গেছেন ব্যাপারটা নিয়ে। তখন বাংলাদেশে গাড়িতে, দরজায় লাগানোর জন্য তিনকোনা একটা স্টিকার বের হয়। সেই স্টিকারটায় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র; লাল-সবুজের মধ্যে হলুদ আর উপরে ‘জয় বাংলা’ লেখা। তাৎক্ষণিভাবে সিদ্ধান্ত নিলাম ২৬ ফেব্রুয়ারি টেস্টে আমি একটা নীরব প্রতিবাদ করব। পাকিস্তানিদের যে টালবাহানা দেখতে পাচ্ছি। সন্দেহ করতে পারছিলাম কী হতে পারে। এখানে আমি কিছু একটা করতে পারলে বর্হিঃবিশ্বে এবং দেশের মধ্যে একটা ভাল আলোড়ন সৃষ্টি হবে।
ম্যাচের আগেরদিন শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল ও ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন আসল আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে। ওখানেই সিদ্ধান্ত হল সবুজ-লাল পতাকার উপরে ‘জয় বাংলা’ লেখা স্টিকার থাকবে। জালালকে দিয়ে আনিয়ে কামাল বলল স্টিকার লাগাতে। কারণটা হল- আমাদের নির্বাচনের প্রতীক ছিল নৌকা। ওরা খেলবে আইয়ুব খানের নির্বাচনী প্রতীক তলোয়ার চিহ্ন লাগানো ব্যাট দিয়ে। আমি এই সুযোগটা নিলাম। ‘জয় বাংলা’ আমাদের স্লোগান, স্বাধিকার প্রতীক। তখন বিভিন্ন বাড়িতে গাড়িতে বাড়ির দরজা লাগানো হতো ওই স্টিকার।
২৬ তারিখ, সকাল ১০টা। টস জিতে আমরা ব্যাটিংয়ে নামি। ১৫ হাজারের মতো দর্শক মাঠে। বেশ কয়েকটি স্টিল ক্যামেরায় ব্যাটিংয়ে নামার দৃশ্য ধারণ করা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরই সবাই বুঝতে পারল ঘটনাটা কী। সবার চোখ তখন আমার দিকে। এখনও কানে বাজে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে জেগে উঠেছিল পুরো স্টেডিয়াম। আমি মনে করি ‘জয় বাংলা’ একটা চেতনা, বাঙালির চেতনা। সেটাই জেগেছিল তখন।
ওই ছবিটা পরদিন পূর্ব পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে এসেছে। বিলেতের অনেক সংবাদমাধ্যমেও এসেছে। ওই দিনই দুপুরে লাঞ্চের সময় ড্রেসিংরুমে আমাকে শোকজ করা হল।
পাকিস্তান দলের ম্যানেজার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘এটা কী?’
আমি বললাম, ‘এটা একটা স্টিকার।’
আবার চুপ। একটু পরে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘রকিবুল, এখানে কী লেখা আছে?’
বললাম, ‘এখানে জয় বাংলা লেখা আছে।’
আমাকে তখন সে বোঝাতে বলল, ‘জয় বাংলা’ আসলে কী।
বোঝানোর জন্য বললাম, ‘জয় বাংলা মিনস ইস্ট পাকিস্তান জিন্দাবাদ।’
সে শুধু বলল, ‘ও আচ্ছা।’
১ মার্চ ছিল ম্যাচের চতুর্থ ও শেষদিন। সেদিন দুপুরের মধ্যে খবর আসল ৩ মার্চ যে অ্যাসেম্বলি বসার কথা ছিল, তদানীন্তন পাকিস্তানের সামরিক জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়া খান সেটা ভুট্টোর পরামর্শে বাতিল করেছেন। এটা শোনার পর মাঠের মধ্যে যেন স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে পড়ল। রেডিওতে সবাই খেলার ধারা বিবরণী শুনছিল। রেডিওতেই অ্যাসেম্বলি বাতিলের খবর আসল। চারদিকে প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেল। আমাদের মাঠ থেকে ড্রেসিংরুমে নিয়ে এল।
আমাদের বলল, অসুবিধা নেই। অবশ্য নিরাপত্তাও ছিল। তবে মানুষ খেপে গিয়েছিল। স্টেডিয়ামে তখন আগুন জ্বলছিল। আমাদের বলল, ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনীর ট্রাক আসবে। আমাদের সেখানে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমি না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবাই গেল। কিন্তু আমি আর তান্না গেলাম না। দ্বাদশ খেলোয়াড় ছিলেন আমাদের তানভীর মাজহার তান্না (বিসিবির সাবেক জেনারেল সেক্রেটারি)।
ম্যানেজারকে বোঝালাম, হোটেলে গিয়ে সবকিছু নিয়ে আসি। উনি আমাকে বললেন, তুমি তো এভাবে যেতে পারো না। কারণ, তুমি পাকিস্তান দলের খেলোয়াড়। যেতে হলে তোমাকে মুচলেকা দিয়ে যেতে হবে। মুচলেকা দিয়ে আমি ক্রিকেটের পোশাক ছেড়ে সাধারণ পোশাক পরে বের হলাম। পূর্বাণী হোটেলে গিয়ে আর ভেতরে ঢুকতে পারছিলাম না। কারণ, সেদিন সেখানে বঙ্গবন্ধুর একটা সভা ছিল। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকে ভরা হোটেল। আমি হোটেলের পেছন দিক দিয়ে ঢুকলাম। সিঁড়ি দিয়ে সাত তলায় গেলাম।
৪ মার্চ পাকিস্তানের অন্য খেলোয়াড়রা ফিরে গেল। কেউ গেল লাহোরে, কেউ গেল করাচি। সবাই তাদের শহরে চলে গেল। পাকিস্তানের কিংবদন্তি ক্রিকেটার জহির আব্বাস ঢাকা ছাড়ার আগে বলেছিলেন, করাচিতে দেখা হবে। ওই বছরের মে মাসে পাকিস্তান দলের ইংল্যান্ড সফরের কথা ছিল। সে ধরেই নিয়েছিল পাকিস্তান দলে যেহেতু খেলেছি সামনের সফরেও থাকব। করাচি থেকে লন্ডনের ফ্লাইট। ওই সিরিজে জহির আব্বাস ২৭৪ রানের একটা ইনিংস খেলেছিল। আমার যাওয়া হয়নি।
খেলার জন্য পরে কাগজপত্রও এসেছে। আমি যাইনি সে অন্য ইতিহাস। কারণ আমার নামে হুলিয়া জারি হয়েছিল। ঢাকা থেকে জহির আব্বাসকে বিদায় দেয়ার সময় বলেছিলাম, নেক্সট টাইম নতুন পাসপোর্ট নিয়ে করাচি যাব। মন থেকে কথাটা বেরিয়ে এসেছিল। আমি উচ্চতায় খাট ছিলাম বলে আমাকে ছোটু ডাকত, আদর করেই ডাকত। আজও দেখা হলে বলেন, ছোটু তুই জানতি তোরা স্বাধীন হয়ে যাবি। তোরা লড়াই করবি। জহির পলিটিক্যিাল লোক না। খুব ভাল মানুষ। বছর তিনেক আগে শেষ দেখা। আইসিসি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ঢাকা এসেছিল। আইসিসিতে যখন একটি কমিটিতে কাজ করেছি তখন দুবাই, লন্ডনে দেখা হত।
হোটেল ছাড়লাম ৬ মার্চ। আমার পরিবার তখন গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। তখন গেলাম ফুলবাড়িয়া রেলওয়ে কোয়ার্টারে, খালুর বাড়িতে। আসলে ব্যাটে স্টিকার লাগানোর কাজটা করেছিলাম একটা চেতনার জায়গা থেকে। পরোয়ানা জারি হয়েছিল। আমাকে দেশদ্রোহী ঘোষণা করা হয়েছিল। আমার বাড়ি লুট হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। সেটা পরে জানি। ২৭ মার্চ শহীদ মুশতাককে যখন গুলি করা হয়েছিল, তখন পুরান ঢাকা থেকে তাকে দেখতে গিয়ে হুলিয়ার কথা শুনি।
আমাকে হাতে ধরে ক্রিকেট শেখানো মুশতাককে (আজাদ বয়েজ ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা) কবরস্থ করে ফেরার সময় ফুটবলার দীপু ভাই বললেন, তুমি এখনও শহরে? তোমাকে তো মেরে ফেলবে। বললাম কেন?
উনি বললেন, তুমি ব্যাটে স্টিকার লাগিয়েছিলা বলে তোমাকে মেরে ফেলার নির্দেশ জারি হয়েছে।
তখন দীপু ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি এই খবর কোথায় পেয়েছেন?
উনি বললেন, পাকিস্তানের ফুটবলার ক্যাপ্টেন ইউনুস আমাকে খবর দিয়েছে যে ওর ব্যাটালিয়ান পাকিস্তান থেকে মুভ করছে।
তখন ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্র আমি। কিছুটা ভয় পেয়েছিলাম। বয়স কম, আবার সাহসও ছিল। ক্যাপ্টেন ইউনুস তখন ফুটবল খেলত ঢাকাতে। তখন তো ক্রিকেটার-ফুটবলারদের সঙ্গে দারুণ সখ্যতা ছিল। ক্রিকেট খেলা হলে ফুটবলাররা দেখতে যেত, আবার ফুটবল হলে ক্রিকেটাররা দেখতে যেত। তখন বাসা ছেড়ে আমাকে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলা হল। ২৮ মার্চ দেশের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার হাতুল গ্রামের দিকে রওনা হলাম।
চারদিন লাগল যেতে। মুধমতি, পদ্মা আমার কাজিন শহীদ মোতাহার উনি ছিলেন নেতৃত্বে। আমবাগানে যুদ্ধের ট্রেনিং চলল। শেখ শহিদুল ইসলাম (বঙ্গবন্ধুর ভাতিজা) আমাদের গ্রামে এসেছিলেন। ব্যাট ছেড়ে আমার হাতে তখন অস্ত্র। শহীদ ভাই, তাকে আগে থেকে চিনতাম। কারণ বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়েছিলাম। উনি আমাকে বললেন, ‘রকিবুল তুই কি স্বাধীন বাংলা বেতার শুনিস?’
বললাম, ‘শুনি।’
‘তুই কী জানিস স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল খেলতেছে কৃঞ্চনগর ও বিভিন্ন জায়গায়?’
পরে সামনের চেয়ারে বসিয়ে আমার কাছে জানতে চাইলেন, ‘এদেশ কি স্বাধীন হবে?’
বললাম, ‘হবে।’
বললেন, ‘কবে স্বাধীন হবে?’
বললাম, ‘জানি না। তবে হবে।’
আবার প্রশ্ন করলেন, ‘তখন কি ক্রিকেট খেলা থাকবে? রকিবুলরা কি খেলবে?’
বললাম, ‘বেঁচে থাকলে খেলবে।’
তখন বললেন, ‘যুদ্ধ করতে হবে এবং বেঁচেও থাকতে হবে।’
আমাকে আরও বললেন, ‘তুমি সমরযুদ্ধে যাবা না। তুমি পরোক্ষভাবে যুদ্ধ করবা। উৎসাহ দিবা, মানুষকে জাগিয়ে তুলবা, ট্রেনিং করাবা।’
তিনি বললেন, বনগাঁও চলে যাবেন। গাইড মারফত চিঠি পাঠাবেন। সেটা আমি পেয়ে যাবো। পরে বললেন, ‘গাইডের সঙ্গে তুই চলে আসবি। তোর মাধ্যমে স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দল গঠিত হবে। ফুটবল দলের মতো ভারতের মাটিতে ক্রিকেট খেলে পুরো ভারতে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জানাতে হবে, প্রকাশ ঘটাতে হবে।’
আমি যেহেতু পাকিস্তান টিমের প্লেয়ার, আমার একটা গ্রহণযোগ্যতা থাকবে ভারতে। তো যেই কথা, সেই কাজ। ৮ দিন পর রাতের অন্ধকারে বড় ভাইকে নিয়ে গেলাম। কিছুদিন পর কলকাতা চলে গেলাম। ধর্মতলায় গিয়ে স্বাধীন বাংলা টিম করলাম। শীতকালে ক্রিকেট খেলা হয়। তখন ডিসেম্বর মাস। আমরা খেলতে নামার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে গেল। টিম তৈরি করে আমরা রেডি ছিলাম। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সঙ্গেই আমরা ক্রিকেটাররা ছিলাম।
যখন পেছন ফিরে তাকাই গর্ব লাগে। বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট খেলা হয়নি; সেটা মনে করে কষ্ট হয় না। ক্রিকেট জীবনে যে বৈষম্যের শিকার হয়েছিলাম, তা এককথায় বলা যাবে না। শুধু আমি না, আমার মতো জুয়েলও। বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট খেলতে পারিনি এটা তো ক্ষুদ্র ব্যাপার। আমাদের যে রাষ্ট্র হয়েছে, এটার চেয়ে তো বড় পাওয়া কিছু হতে পারে না।
২০১৮ সালে দাঁড়িয়ে গর্বে বুক ভরে যায়। ক্রিকেট খেলে ভুল করিনি। জীবনে গর্ব করার বড় জায়গা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক হলাম। দেশের ক্রিকেটকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অবদান রাখতে পেরেছিলাম কিছুটা। তাতেই আমার আনন্দ।
১৯৬৯-এ সাহসী প্রতিবাদ: ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের অনূর্ধ্ব-২৫ দল শ্রীলঙ্কা সফরে যাবে। সেই দলের হয়ে ক্যাম্প শুরু হয়েছে করাচিতে। পাকিস্তান ন্যাশনাল স্পোর্টস কাউন্সিল মাঠে টিলার উপরে বসে আমরা ক্রিকেটাররা চা-কফি খাচ্ছিলাম। ক্যাম্পে আরেক বাঙালি ক্রিকেটার সৈয়দ আশরাফুল হক ছিলেন। প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান কামরান রশিদ নামে তুখোড় এক ক্রিকেটার ছিল। এখন কানাডায় থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র। খুব বড় বড় কথা বলছিল। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে খারাপ একটা কথা বলল। গালি দিয়ে বলল, আইয়ুব খানের উচিত ছিল বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলা।
ওই কথা শুনে আমার ভেতরে আগুন জ্বলে উঠল। জাম্প করে ঘুষি মেরে টিলা থেকে ফেলে দিয়েছিলাম। আমার উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি, আর রশিদ ৬ ফুট উচ্চতার। পেশোয়ারের বালিখান সাহেবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আঁতাত ছিল। তার ভাতিজা মনজুরুল্লাহ আমার সঙ্গে যোগ দিল। দুজন মিলে মেরে রক্তাক্ত করলাম।
পরদিন আমাকে শোকজ করল ক্যাম্প কমানডেন্ট মেজর সুজাউদ্দিন। ট্রায়াল রুমে দুটা চেয়ার, একটা টেবিল। সামনে মেজর সুজাউদ্দিন বসা। আমাকে ডাকলেন। তাকে চিনতাম আগে থেকেই। পাকিস্তান টিমের বাঁহাতি স্পিনার ছিলেন। তো উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কত বড় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছ জান?’
ভদ্র ভাষাতেই তাকে বললাম, ‘মি. কমানডেন্ট স্যার। কামরান রশিদ আমাকে অমুক কথা বলেছে। আবার যদি সে একথা বলে তাকে আবার মারব।’
ওই কথাতেই উনি চলে গেলে। উনি বুঝে ফেলেন আমার সিংহমূর্তি দেখে। যাওয়ার আগে শুধু বললেন, ‘যাও যাও…।’