চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

ব্যবসায়ী-ছাত্র সংঘাতে সংসদীয় তদন্ত টিম প্রয়োজন

স্বদেশী আন্দোলনে কারা ছিলো? ছাত্ররাই। অসংখ্য ক্ষুধিরাম ও প্রীতিলতারা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল মানুষের জন্য। ১৯৫২ সালে ভাষার জন্য জীবন দিয়েছিল এই ছাত্ররাই। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাজপথে নেমে এসেছিল তারা। গুলি, বোমা, টিয়ার গ্যাসও তাদের পিছু হটাতে পারেনি। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনেও ছিল এদেশের ছাত্রসমাজ। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকদের রক্তচক্ষু তাদের পিছু হটাতে পারেনি। এরপর এলো ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান। আসাদের রক্তে রঞ্জিত হলো রাজপথ। পাকিস্তানী সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে দূর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে এই ছাত্র সমাজই। বাঙালীর প্রাণের দাবী ৬ দফাও পেশ করেছিল তারাই।

শুধু কি তাই? স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন করেছিল এদেশের ছাত্র সমাজ। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এদেশের ছাত্র সমাজ। ৩০লাখ শহীদ ও ২লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হল একটি স্বাধীন বাংলাদেশ।

সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও রাজপথে রক্ত ঢেলে দিয়েছিল বসুনিয়া, ফিরোজ, জাহাঙ্গীর সহ অসংখ্য ছাত্র। ছাত্রসমাজের রক্তের বিনিময়েই গড়ে উঠে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান। আর সে অভ্যুত্থানে পতন ঘটে সামরিক স্বৈরাচার হোসেইন মুহম্মদ এরশাদের। যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবীতে শাহবাগে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার মূলেও ছিলো ছাত্ররাই। এভাবে যুগে যুগে ছাত্ররাই বিভিন্ন প্রতিবাদ প্রতিরোধে সোচ্চার ভূমিকায় থেকে চলছে। কোন গণতান্ত্রিক লড়াই সংগ্রামে কোন ব্যবসায়ীরা ছিল এমন নজীর কি আছে কোথাও? সম্প্রতি নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের সাথে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের মাঝে এক সংঘাতের ঘটনা ঘটে গেল। আর সেই সংঘাতের জেরে ঢাকা কলেজ বন্ধের ঘোষনা এলো। যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে সাবেক ছাত্রনেতারা। সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই প্রশ্ন তুলছে সংঘাতের দায়ে ঢাকা কলেজ বন্ধ হলে নিউ মার্কেট কেন নয়?

এদিকে এই সংঘাতে একজন পথচারীর মৃত্যু হয়। মৃত ছেলেটির নাম নাহিদ। সে একটি কুরিয়ার কোম্পানির ডেলিভারী ম্যান হিসেবে কাজ করতো। এই মৃত্যুর দায় কে নেবে? এর দায় কি শিক্ষামন্ত্রী অথবা বাণিজ্যমন্ত্রী নেবেন? কেন এই দুই মন্ত্রী সংঘর্ষ শুরুর আগেই কোন ব্যবস্থা নিতে পারলো না? কেন আহত ছাত্রকে দেখতে যেতে হল মন্ত্রীকে। কেন সংঘর্ষ থামাতে যেতে পারলেন না তিনি। ঢাকা কলেজে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রসংগঠনগুলোর কোন কমিটি নেই। নেই ছাত্রসংসদ। তাই এ আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্র নেতৃত্বের কোন নিয়ন্ত্রন সক্ষমতাও নেই বলছেন অনেকে। এদিকে ঢাকা কলেজের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। ঢাকা কলেজের ছাত্ররা সংবাদ সম্মেলনে এডিসি ও ওসির প্রত্যাহারের দাবী জানাচ্ছে। কেন এমন এই অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। এডিসি, ওসির ভূমিকা কেন ছাত্রদের কাছে পক্ষপাত মনে হল?

সংবাদপত্রে খবর বেরোচ্ছে এই সংঘাতের পেছনে তৃতীয় পক্ষ রয়েছে। যারা এই সংঘাতকে উস্কে দিয়েছে। তবে কি ছাত্রদেরকে খেলার তুরুপ হিসাবে ব্যবহার করছে এই তৃতীয় পক্ষ। তারা চেষ্টা করছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অশান্ত করে তুলতে। আর এমনটি হলে সে চেষ্টা অনেকটা সফলও হয়েছে। ঢাকা কলেজ অশান্ত হয়েছে। ঢাকা কলেজের পক্ষ নিয়ে অশান্ত হয়ে উঠছে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও। আরেকটি বিষয় হল জাতীয়তাবাদী ছাত্র দল এমন অশান্ত সময়ে ক্যাম্পাসে মিছিল করে শো-ডাউন করেছে। তারা শো-ডাউনের জন্য এমন একটি সময়কেই কেন বেছে নিলো? এই প্রশ্নটাও ভাববার নয় কি? খবর বেরোচ্ছে দুই ব্যবসায়ীর দ্বন্দ্বের ফল আজকের এই অশান্ত পরিস্থিতি। এক ব্যবসায়ী কর্মচারীর পরিচিত ছিল ঢাকা কলেজের কতিপয় ছাত্র। আর সেই সূত্রেই তারা পক্ষ নিলো সেই ব্যবসায়ীর। এক কথায় ব্যবসায়ীদের দ্বন্দ্বের ফাঁদে পড়লো ছাত্ররা। আর তথ্যটি সত্য হলে দুই ব্যবসায়ী ও তার কর্মচারীদের কেন জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হচ্ছেনা? জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হোক সে সময়ে আগত ঢাকা কলেজের ছাত্রদেরকেও। কিন্তু সেই জিজ্ঞাসাবাদটা করবে কে?

এডিসি, ওসির ভূমিকা ইতোমধ্যেই আস্থা হারিয়েছে এক পক্ষের কাছে। সুতরাং উদ্দেশ্যবাজ তৃতীয় পক্ষ খুঁজতেও আরেক তৃতীয় পক্ষের প্রাসঙ্গিকতা যৌক্তিক নয় কি? আর কে হতে পারে এই তদন্ত টিমের অন্তর্ভুক্ত। সেটা হতে পারে সংসদীয় তদন্ত টিম। জাতীয় সংসদের স্পিকারের মাধ্যমে গঠিত হতে পারে এই তদন্ত টিম। এমন একটি স্পর্শ কাতর সংঘাতের নামকাওয়াস্তে আইওয়াশ ধর্মী তদন্ত টিম চাই না। যেখানে সরিষাতেই থাকে ভূতের উপস্থিতি। এসব আমলাতান্ত্রিক তদন্ত টিমে মানুষ আর নির্ভর করতে পারছেনা। এই সংঘাতে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় অশান্ত করার দূরভিসন্ধি ভয়ংকর পরিণতিকে স্বাগতম জানায়। তাই আইওয়াশ ধর্মী তদন্ত টিম করে এটিকে হেলাফেলা করা হবে মারাত্মক ভুল।

যে কোন একটা ঘটনা ঘটলেই আমলাদের নিয়ে তিন সদস্য/পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত টিম গঠনের রীতির প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়েছে। এসব তদন্ত টিমের তদন্ত করে কে? এগুলো যে এক ধরনের আইওয়াশ তা সাধারন মানুষও বুঝে। মধ্যরাতে ঢাকা কলেজ বনাম নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী দ্বন্দ্ব কেন্দ্রিক সমঝোতা বৈঠকেও ছিলো আমলারাই। কেন সেখানে কি জাতীয় সংসদের একটা প্রতিনিধি দল থাকতে পারতোনা? থাকতে পারতোনা ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিনিধি দল? কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অশান্ত হলেতো ক্ষতি দেশের, ক্ষতি মানুষের ও ক্ষতি রাজনীতির। আর সে রাজনীতির আঁতুরঘর জাতীয় সংসদ ও তার প্রহরী এদেশের ছাত্র সমাজ এবং ছাত্র রাজনীতি। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যবাজী ও সুবিধাবাজী ছাড়া আর কি বা থাকতে পারে? এদেশের কোন রক্তঝরা সংগ্রামেই ব্যবসায়ীরা ছিলনা। ছিলো ছাত্রসমাজ। ছাত্র সমাজের রয়েছে অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা ও ইতিহাস ঐতিহ্য। ছাত্র সমাজের সাথে ব্যবসায়ীদের এই সংঘাতের কারণ উদঘাটনে তাই আইওয়াশ ধর্মী তদন্ত টিম চাই না। চাই এর সত্যিকারের রহস্য উন্মোচন। আর সেজন্য প্রয়োজন একটি সংসদীয় তদন্ত টিম।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)