গঠনতন্ত্র জানার ও মানার খুবই অভাব এদেশীয় রাজনীতিতে। ব্যক্তিতান্ত্রিকতা, ব্যক্তিমোহ,পারিবারিক মোহ প্রবলভাবে কাজ করে নেতাকর্মীদের মধ্যে। প্রতিটা রাজনৈতিক দলেরই গঠনতন্ত্র ও ঘোষণা পত্র থাকে কেবলই কাগজে কলমে। জেলা,উপজেলা এমন কি কেন্দ্রের অনেক ডাকসাইটে নেতাও গঠনতন্ত্র ও ঘোষণা পত্র উল্টিয়ে দেখারও আগ্রহবোধ করেন না। দলের ভেতরে যাদের গণতন্ত্র নেই আবার তারাই মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ান।
আওয়ামী লীগ মানেই শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া মানেই বিএনপি, এরশাদ মানেই জাতীয় পার্টি এরকম ভাবনাও অনেকে ভেবে থাকেন। গোটাকয়েক দলে কিছু গঠনতন্ত্র চর্চা হয়। যেমন ওয়ার্কার্স পার্টি, কমিউনিষ্ট পার্টি,সাম্যবাদী দল, প্রভৃতি বাম সংগঠনে। কিন্তু এসব দল বাংলাদেশে তেমন গণভিত্তি সৃষ্টি করতে পারেনি। সাধারণ, অসাধারণ নেতাকর্মীরাও গঠনতন্ত্র ও ঘোষণা পত্র জানার ও মানার প্রয়োজনবোধ করেন না। তাদের মধ্যেও ব্যক্তিমোহ সৃষ্টি হয়ে গেছে।
গঠন তন্ত্র ও ঘোষণা পত্র ভিত্তিক আদর্শিক কোনো বোধ না থাকায় তাদের পক্ষে দল বদলের ঘটনা ঘটছে খুবই স্বাভাবিক ভাবে। একসময় যে দলকে সারাক্ষণ খিস্তিখেউর ও বকাবাজী করতো। সহসা সুর পাল্টে তাদেরকে সে দলেরই নেতা বনে যেতে দেখা যায়। গঠনতান্ত্রিক আদর্শ ভিতের বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলের সুূদিন যে কোনো সময় ঝরে যেতে পারে। গ্রাস করতে পারে দুঃসময়ের করাল ভূত।
কারণ দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যক্তির মোহাবিষ্ঠতার বাইরে আদর্শিক ভিত মজবুত করার মত কোন অনুকূল পরিবেশ থাকেনা এসব দলে। যার দারুন আদর্শিক বিপরীত ধারার সংগঠন হতে এসেও দলে সদস্যপদ ও নেতৃত্ব পেয়ে যেতে পারে। যেমন জামাত হতে আওয়ামী লীগ,আওয়াৃমী লীগ হতে বিএনপি, বিএনপি হতে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি হতে বিএনপি-আওয়ামী লীগে সদস্য পদ ও নেতৃত্ব প্রাপ্তির ঘটনা ভূরিভূরি ঘটছে। যোগদান করানোর আগে যোগদানকারীর অতীত রাজনীতি ও সেসময়কার ভূমিকার মূল্যায়ন কেউ করছে না।
দলে একজন সদস্য বাড়বে, নেতা বাড়বে সেটাই মুখ্য। আদর্শিক দ্বন্দ্বে কেউ দল ত্যাগ করছে না, দলত্যাগ করছে ব্যক্তি দ্বন্দ্ব কিংবা নেতৃত্ব,কর্তৃত্ব ও সুবিধা পাওয়া না পাওয়ার ব্যাপার নিয়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে আওয়ামী লীগ নেতা মোশতাক রাষ্ট্রপতি হয়ে ডেমোক্রেটিক লীগের নেতা হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধু হত্যা ও পরবর্তিতে কতিপয় আওয়ামী লীগ নেতার নতুন দল গঠন কোন গঠনতান্ত্রিক আদর্শিক দ্বন্দ্বের কারণে নয়। এগুলো ব্যক্তি দ্বন্দ্ব ও প্রতিহিংসার ফল। পরবর্বিতে মেজর জিয়া ক্ষমতা দখল করে দল গঠন করল।
সে দলে একাত্তরের পরাজিত শত্রু রাজাকার আল বদরদেরও নেতৃত্ব প্রদান করা হল। আবার মেজর জিয়া ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। তার দল গঠনে আদর্শিক সত্তার কোনো ব্যাপার ছিল না। ব্যাপার ছিল দলের নেতা,শক্তি ও প্রভাব বৃদ্ধির। কারণ ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে হলে দল বড় করতে হবে। কে কোন দল হতে ও মত হতে আসছে তাই সেটা বিবেচ্য ছিলো না।
আদর্শ বোধহীন ব্যক্তি তান্ত্রিকতার কুফল দেখা গেল আওয়ামী লীগেও।গড়ে উঠল আওয়ামী লীগ(মিজান)আওয়ামী লীগ (মালেক) আবার কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ(বাকশাল) এসবের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক রাজনীতি কোনটা ছিল এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এরপর ক্ষমতায় এল এরশাদ। এসব দল হতে দলে দলে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিতে লাগল। অতঃপর গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য এরশাদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠল। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ পদচ্যুত হয়। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। তখন ভোল পাল্টে অনেকেই জাতীয় পার্টি হতে বিএনপিতে যোগ দিতে শুরু করে।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। তখন আবার অনেককেই জাতীয় পার্টি ও বিএনপি হতে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে দেখা যায়। ২০০১,ওয়ান ইলেভেন,২০০৮ এর পাশাপাশি ২০১৪’র নির্বাচনোত্তর বর্তমান বাস্তবতাও আমরা প্রত্যক্ষ করছি। গোটা কয়েক বাম দল ছাড়া বড় দলগুলো গঠন তন্ত্রের ধার ধারছেনা। নেতৃত্বের জন্য নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বি নেতাকে হত্যা করতেও পিছপা হয়না তারা। গঠনতন্ত্র, ঘোষণা পত্র, দলীয় আদর্শিক বোধ ও দেশাত্ববোধের উর্ব্ধে অবস্থান করছে নেতৃত্ব আর কর্তৃত্ব দখলের প্রতিযোগিতা।
অথচ দলীয় গঠনতন্ত্র ও আদর্শিক সত্তারই সবকিছুর উর্ব্ধে থাকার কথা ছিল। তা হয়ে উঠছে না বলেই রাজনীতিতে আদর্শবাদিতার স্থলে সুবিধাবাদ জেকে বসেছে। নেতৃত্ব সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যক্তির হাত থেকে গিয়ে গঠনতন্ত্রের কাছে না যাওয়া পর্যন্ত সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
ব্যক্তি দ্বন্দ্বে দলীয় ভাঙ্গন ভূরিভূরি। জাতীয় পার্টি এরশাদ হতে জাতীয় পার্টি (মন্জু) জাতীয় পার্টি (নাজিউর)জাতীয় পার্টি(কাজী জাফর)জাসদ(রব) হতে জাসদ(ইনু)জাসদ(ইনু) হতে জাসদ(আম্বিয়া-প্রধান)বাসদ(মাহবুব) হতে বাসদ(খালেক)বিএনপি(খালেদা) হতে বিএনপি(ওবায়েদ) প্রভৃতি গড়ে ওঠে।
এসব ভেঙ্গে গড়া সংগঠনগুলোর মধ্যে কয়টির আলাদা গঠনতন্ত্র প্রণীত হয়েছিল? কি ভিন্নতা ছিল তাদের গঠনতান্ত্রিক ব্যাখ্যা ও আদর্শিক ঘোষণা পত্রে? প্রজন্মের সামনে তা পরিস্কার করা উচিত। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলন।
এবারের সম্মেলনে বিদেশী রাজনৈতিক দলের আমন্ত্রিত নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি দৃশ্যমান হল। অতীতে ওয়ার্কার্স পার্টি,কমিউনিষ্ট পার্টি,জাসদ,বাসদ,সাম্যবাদী দল প্রভৃতি বাম সংগঠনের জাতীয় সম্মেলনে বিদেশী সমমনা রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি দেখা গেছে। আওয়ামী লীগ বিএনপি ও জাতীয় পার্টিতে দেখা যায়নি। এখন হয়তো তারাও আওয়ামী লীগকে ফলো করে শুরু করবে।
এবারের সম্মেলনে গঠনতন্ত্র ও ঘোষণা পত্রের বিষয়কেও বেশ গুরুত্ব দেয়া হল।গঠন তন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হল, যুদ্ধাপরাধীর সন্তান ও বঙ্গবন্ধুর খুনীর উত্তরসূরিরা আওয়ামী লীগের কোন প্রকার সদস্য হতে পারবেনা। এই ক্যাটাগরিতে কারা কিভাবে পড়বে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন ব্যক্তিক নয়, সেটা হতে হবে গঠনতান্ত্রিক।
গঠনতন্ত্রের নীতি বাস্তবায়নে বর্তমান নতুন নেতৃত্ব কি আদর্শিক ভূমিকা নিতে সক্ষম হবে? নাকি শুধু তা কাগজে কলমেই লেখা থাকবে? গঠনতন্ত্র ব্যক্তির অধীন নয়, ব্যক্তি গঠন তন্ত্রের অধীন। যে দল এ রীতিটি চালু করতে না পারবে সে দল একদিন ক্ষয়ে যাবে। কারণ ব্যক্তি মারা যেতে পারে অথবা দল বদল করতে পারে কিন্তু গঠনতন্ত্র থাকে। তাই গঠনতন্ত্রকেই হতে হবে দল পরিচালনার মেইন সুইচ।
এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)