‘স্বাধীনতা সংগ্রামের অর্থনৈতিক যুক্তি তুলে ধরাদের একজন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। এখনও দেশের জনমানুষের কল্যাণে তিনি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রের দুই অংশে অর্থনৈতিক বৈষম্য তুলে ধরেছিলেন তিনি। অধ্যাপক রেহমানের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে বৈষম্য ঘোচাতে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলেও এদেশের সমাজে বৈষম্য প্রকট। সাম্প্রতিককালে রেহমান সোবহান গবেষণায় দেখিয়েছেন, এখন যে উন্নয়ন ধারা চলছে সেটা বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে।’
বাঙলার পাঠশালা আয়োজিত ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি: অধ্যাপক রেহমান সোবহান পাঠ’ শীর্ষক এক পাঠচক্র সমাপনীতে এসব কথা বলেছেন জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ ড. নজরুল ইসলাম।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ লেকচার হলে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় বাড়ছে তবে কিন্তু এই আয় সমাজে সমতাপূর্ণ বিতরণ হচ্ছে না।
ইতোমধ্যে যাদের আয় বেশি দেখা যাচ্ছে এই বর্ধিত আয় তাদের কাছেই চলে যাচ্ছে। এটা ন্যায়ের ব্যাপার। প্রফেসর সোবহান ন্যায্যতার বিষয়টি সামনে নিয়ে এসেছেন।’
জাতিসংঘের এই অর্থনীতিবিদের বক্তব্যের পর আলোচনায় যোগ দিতে সশরীরে আসেন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। পাঠচক্রে তার সামনেই দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি পাঠ পাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজেদের ধারণাগুলো তুলে ধরতে থাকেন।
ঢাবি অর্থনীতি বিভাগের সঞ্জয় দাস রাহুল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী শিক্ষার্থী জান্নাত শারমিন, ইন্সটিটিউট অব কস্ট এন্ড ম্যানেজমেন্ট একাউন্টেন্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএমএবি) শিক্ষার্থী মো. মাহফুজুর রহমান তাত্ত্বিক আলোচনার পাশাপাশি দেশে বৈষম্য নিয়ে নিজস্ব ধারণা প্রকাশ করেন।
শিক্ষার্থীদের বক্তব্য শেষে অর্থনীতির অধ্যাপক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের প্রতিষ্ঠাতা রেহমান সোবহানের লেখালেখি ভিত্তিক এই আলোচনায় বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
ব্যক্তি সোবহানের কয়েকটি দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘পাবলিক ইন্টেলেকচ্যুয়াল হিসেবে শুধু গবেষণায় সীমাবদ্ধ না থেকে অধ্যাপক সোবহান বাস্তবায়নের প্রয়োগ দেখিয়েছেন। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, নব্বইয়ের দশকে দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে থাকাকালীন ২৯টি টাস্কফোর্স গঠন করেছিলেন। ২২০ জন মেধাবীর ওইসব টাস্কফোর্সের প্রতিবেদন এখনো আমাদের পথ নির্দেশ করে।’
পাঠচক্রের সভাপতি হিসেবে সবার শেষে রাখা বক্তব্যে স্বাধীনতার সংগ্রামের অর্থনৈতিক যুক্তি দাঁড় করানোদের একজন রেহমান সোবহান বর্তমান বৈষম্য নিয়ে কথা বলেন।
বর্ষীয়ান এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বর্তমান সময় কূয়ায় বসে থাকার সময় নয়। তবে বিশ্বায়নের চাকা ঘুরে গেছে, চীন বসছে নেতৃত্বের আসনে। এখন আমেরিকা দূর্গ গড়তে মরিয়া। ট্রাম্প বিশ্বায়নকে অস্বীকার করছেন। অন্যদিকে তার মেয়ের পোশাক ব্যবসায় পোশাক যোগাচ্ছে বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে এই বিশ্বায়ন সুবিধা পাচ্ছে মাত্র ২-৩’শ বড় গার্মেন্টস ব্যবসায়ী। এই উন্নতি তারা করতে পেরেছে আমাদের গার্মেন্টসের মেয়ের কারণে। কম বেতনে ১২ ঘণ্টা কাজ করে রাস্তার দুই পাশ দিয়ে হাজার হাজার নারী বাড়ি ফেরে, আবার পরদিন ভোর ৬ টায় গার্মেন্টসে এসে ঢোকে। স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামী লীগের একটা স্লোগান ছিলো সোনার বাংলা শ্মশান কেন? আর এখন স্লোগান তুলতে হবে এই ৪০ লাখ গার্মেন্টস কর্মীর ওপর শোষণ কেন।’
এই শোষণ দূর করতে সামাজিক ন্যায্যতা দরকার বলে মনে করেন তিনি এবং ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় অর্থনীতিকে ঢেলে সাজানোর তাগিদ তার।
গত ১৯ আগস্ট ২০১৭ এ পাঠচক্রের উদ্বোধন করা হয়। এতে প্রায় ৩০০ জন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নিবন্ধন করেন। অধ্যাপক রেহমান সোবহানের রচনাগুলোকে ৪টি বিষয়ে ভাগ করে প্রতি মাসে ২টি করে সর্বমোট ৮টি ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়।
পাঠচক্রে ক্লাস নেন ড. কে.এ.এস. মুর্শিদ (মহাপরিচালক, বিআইডিএস), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত, অধ্যাপক ড. এম. এম. আকাশ ও অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
বিষয়গুলো হলো: পাকিস্তান রাষ্ট্রে অন্যায় ও অবিচার, দারিদ্র্য ও অন্যায্যতা, বহিরাষ্ট্র নির্ভরতা ও নীতিনির্ধারণী স্বত্ত্ব ও আঞ্চলিক অসমতা দূরীকরণে সহযোগিতা।
সমাপনী আলোচনা সভায় অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক, অধ্যাপক রওনক জাহান প্রমুখ।