চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বৈষম্য’র দুনিয়ায় আইকন মেগান

যুক্তরাষ্ট্র মেয়েদের বিশ্বকাপ জিতেছে এ বছরই। বিশ্বজয়ী দলের অধিনায়ক মেগান রাপিনো এখন বিশ্বে মেয়েদের ফুটবলের অন্যতম মুখ। তাকেই নেতা মানছেন সকলে। ছেলেদের বিশ্বকাপের সঙ্গে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন মেগান। তার গলার সুর ধরেই বিশ্বকাপ ফাইনালের গ্যালারি থেকে আওয়াজ ওঠে, ‘ইক্যুয়াল পে বা সমান বেতনের’।

সোমবার রাতে মেয়েদের ব্যালন ডি’অর জিতে আবারও ফুটবল দুনিয়ার সামনে ভাসছে মেগানের মুখ। ৩৪ বছরের ফরোয়ার্ডের জন্য একটি চমকপ্রদ বছরই। বিশ্বকাপ, গোল্ডেন বল, গোল্ডেন বুট, ফিফার সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতার পর সম্মিলিতভাবে ফুটবলের সবচেয়ে সম্মানজনক ব্যালন ডি’অরও জিতলেন। সবমিলিয়ে পূর্ণতা পেল তার টানা দুটি বিশ্বকাপ জয়ের অর্জন।

প্যারিসের বিশ্বকাপ ফাইনালের সেই আওয়াজ একটা গ্যালারি থেকে আর একটা গ্যালারিতে আছড়ে পড়েছে। খোদ ফিফা প্রেসিডেন্ট জিওভান্নি ইনফান্তিনোর সামনে পর্যন্ত সমান অর্থের দাবি ওঠে। এখানেই শেষ নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নারীদের বিশ্বকাপের সঙ্গে ছেলেদের বিশ্বকাপের ছবি দিয়ে তুলনা করা হয়।

একটা কাপের ক্ষেত্রে কী এমন বৈষম্য?
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের নিউজ ও ছবিতে দেখা যায়, পুরুষ বিশ্বকাপের প্রাইজমানি যেখানে ৪০০ মিলিয়ন ডলার, সেখানে নারীদের ৩০ মিলিয়ন ডলার।

চার বছর আগে নারী বিশ্বকাপের প্রাইজমানি দ্বিগুণ করার ঘোষণা দিয়েও বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আসলে কিছুই করেনি। এবারের ফাইনালের পর সেটা আবারও সামনে আসে। মেগানের সৌজন্যেই।

আগেরবারের মতো এবারের আসর শেষে ইনফান্তিনো আবারও ঘোষণা দিয়েছেন আগামী চার বছরে নারীদের ফুটবলে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবেন। এছাড়া ২০২৩ নারী বিশ্বকাপে ২৪ দল থেকে বাড়িয়ে ৩২ দলের কথাও বলেছেন তিনি।

৩৪ বছর বয়সী এই ফুটবলার শুধু ফুটবলার নন, পরিবর্তনের মুখ হিসেবে সবাই তার দিকে তাকিয়ে। নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচের আগে লাইনে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীতে গলা মেলাননি সতীর্থদের সঙ্গে। বিশ্বকাপের শুরু থেকে একই ঘটনা। তা নিয়ে কম আলোচনা-সমালোচনা হয়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিতর্কেও জড়িয়েছিলেন।

মেগান সুর পাল্টাননি বিশ্বকাপের শেষেও। গোল করার পরে দু’হাত ছড়িয়ে তার উৎসব, গোটা বিশ্বে এখন যা একটা প্রতীক। ছয়টি গোল, তিনটি অ্যাসিস্ট, সোনার বল ও সোনার বুট তারই দখলে। জাতীয় সঙ্গীত না গাওয়ার বিতর্কে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টুইটে মেগানকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন, ‘কথা পরে হবে। নিজের কাজটা আগে করতে হবে।’ আক্ষরিক অর্থে তা করে দেখিয়েছেন মেগান।

বিশ্বকাপ জয়ের পরে আমেরিকার কোচ জিল এলিসের মন্তব্য, ‘শুধু ফুটবল নয়, আজকের সবকিছুর পেছনে মেগান।’ আর মেগান বলেছেন, ‘আমরা যা করেছি, তা বিশ্ব ফুটবলে সেরা বিজ্ঞাপন হতে পারে। প্রত্যাশার চাইতেও বেশি। কে কী বলল, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই।’

বিশ্বের সাতটি দেশের ক্লাবে খেলেছেন। অভিজ্ঞতা সমুদ্রে বিচরণ করছেন। আমেরিকার কিংবদন্তি গোলকিপার হোপ সোলোরের পরেই তার নাম উঠে আসছে। সেই হোপ সোলো বলেছেন, ‘মেগান শুধু ফুটবলার নয়। বিশ্বের অনন্য একটি নাম।’

মেগানের নাম জড়িয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের সমকামী আন্দোলনের সঙ্গেও। বিশ্বকাপের ফাইনালে দলের হয়ে গলা ফাটিয়েছিলেন সু বার্ড। মার্কিন বিখ্যাত নারী এনবিএ তারকা আবার মেগানের বান্ধবী।

চারটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ও চারটি অলিম্পিক সোনার মালিক সু বার্ডের সঙ্গে দুই বছর ধরে ডেটিং করছেন মেগান। গত বছর ইএসপিএন দুজনের একটি ছবি দিয়ে বলেছিল, ‘তারা আমেরিকার প্রথম একই সেক্সের দম্পতি।’

তবে এসবে কিছু আসে-যায় না মেগানের। বরং নারীদের ফুটবলে তার সমান অর্থের দাবি বিশ্বকে প্রভাবিত করছে।

বিশ্ব জয়ের পর মেগানের মন্তব্য ছিল, ‘সমান অর্থের দাবি শুধু বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করা নয়, বরং আদায় করার চেষ্টা করে যেতে হবে। এটা শুরু, তবে জানি না এর শেষ কোথায়। ফিফাও পারবে না এই দাবি নস্যাৎ করতে।’

বিশ্বকাপের মাঝে যেমন, দেশে ফিরেও একইরকম বিদ্রোহী ছিলেন মেগান। কাপ জয়ের উৎসব তখনো শেষ হয়নি। নিউইয়র্কের রাস্তায় বিশাল জনতার মাঝে ট্রফি নিয়ে প্যারেডে হাঁটেন মেগান রাপিনোসহ পুরো দল। তারমধ্যে বিতর্কের শুরু। হোয়াইট হাউসের আমন্ত্রণ পেলে কী করবে বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলাররা?

তখনো হোয়াইট হাউসের চিঠি না এলেও রীতি অনুযায়ী সেই আমন্ত্রণ আসবেই। কিন্তু মেগান আবার সুর জোরাল করেন। সাফ জানিয়ে দেন, ‘হোয়াইট হাউসে যাওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই। শুধু আমি নই, ব্যাপারটাকে আমরা এমনভাবে সতীর্থদের বুঝিয়েছি, মনে হয় না, কেউ সেখানে যাবে।’ কথা মতো পরে প্রেসিডেন্ট ভবনের ডাকে সাড়া দেয়নি মার্কিন নারী দল।

শুধু মেগান নন, যুক্তরাষ্ট্র নারী দলে বহু সমকামী ফুটবলার রয়েছেন। যারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মানসিকতা নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। ট্রাম্প সমকামিতা নিয়ে প্রকাশ্যে যা বলেছেন, তা নিয়ে রীতিমতো ফুঁসছেন। ট্রাম্পের স্লোগান, ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’। এই স্লোগানের সঙ্গে সকলে একমত নন। মেগানরা পাল্টা বলেছেন, ‘এই গ্রেট সকলের জন্য নয়। তিনি যা করছেন, তাতে আমেরিকা মানসম্মান থাকবে না।’

একের পর দুর্নীতি নিয়েও সরব মেগান। তার ভাষায়, ‘ট্রাম্পের স্লোগান আমেরিকার কিছু লোকের জন্য। সকলের জন্য অবশ্যই নয়।’ শুধু এটুকু বলেই চুপ করে থাকেননি আমেরিকার অধিনায়ক। বলেছেন, ‘ট্রাম্পের স্লোগানে সকলে নেই। আমার মতো অনেকেই নেই। ভিন্ন রংয়ের লোকরা সেখানে নেই। যাদের পছন্দ করেন না, নেই তারাও। তাহলে কী করে সকলের জন্য এই স্লোগান?’

মেগানের প্রতিবাদের ভাষা যতই কঠিন ও কড়া হোক, বিনয়েও কম যান না তিনি। ব্যক্তিগত কারণে ব্যালন ডি’অর প্রদানের অনুষ্ঠান মঞ্চে অনুপস্থিত না থাকলেও ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘এমন একটা রাতে উপস্থিত থাকতে না পেরে আমি খুবই দুঃখিত। এটা অবিশ্বাস্য ঘটনা। লড়াইয়ে থাকা অন্যদের অভিনন্দন। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না যে, আমি এই পুরস্কার জিতেছি।’