১৯৩০ সালের ৮ অগাস্ট গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব।তাঁর ডাক নাম ছিল রেনু। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনে যিনি দিয়েছেন অসীম সাহস এবং রেখেছেন নীরব ভূমিকা।বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ব্যস্ততা এবং কারাজীবনে পরিবারের হাল ধরা, আত্নীয় স্বজন ও সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করা, ছেলে মেয়েদের পড়াশুনা সব দায়িত্বই তিনি নিজ হাতে সামাল দিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু কারান্তরীণ হলে দলীয় নেতা কর্মীদের সুখ দুঃখের খোজ খবর নিতেন বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনে প্রায় ১৩ বছরই কাটিয়েছেন কারাগারে। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মামলা পরিচালনা করা, দলকে সংগঠিত করা, আন্দোলন পরিচালনায় পরামর্শ দেওয়াসহ প্রতিটি কাজে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন বেগম মুজিব। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন।
রাজনৈতিক জীবনে অনেক জটিল এবং সংকটময় পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকে পরামর্শ দিতেন এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করতেন। এ রকম একটি সংকটময় মুহূর্ত আসে ১৯৬৯ সালে। সারা দেশে তখন গণ-অভ্যুত্থান।
বঙ্গবন্ধুকে অবৈধভাবে কারাবন্দি করে রেখছে আইয়ুব খান। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু লাহোরে বিরোধী দলের সমাবেশে ৬ দফা উত্থাপন করেন। ৬ দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। ৬ দফা দাবি উত্থাপন করার পর আইউব সরকার বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ১২ টি মামলা দায়ের করে! মামলা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কাবু করতে না পেরে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে “আগরতলা ষড়যন্ত্র” মামলা দায়ের করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করার পর সারা পূর্ব বাংলা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পূর্ব বাংলার সামগ্রিক অবস্থা আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। এ দিকে জনতা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে অনড়। আইয়ুব ঠিক করলেন গোলটেবিল বৈঠক করবেন রাজনৈতিক নেতাদের সাথে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে লাহোরে নিয়ে যাওয়া হবে। তেজগাঁও এয়ারপোর্টে যথারীতি প্লেন রেডি বঙ্গবন্ধুকে বহন করে লাহোর নিয়ে যাওয়ার জন্য।
তখন বেগম মুজিব ভেবে চিন্তে দেখলেন, এই মুহুর্তে প্যারোলে মুক্তি নেওয়া ঠিক হবে না।শেখ মুজিব যদি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে যান, তাহলে এটা হবে বাংলার মানুষের অপমান। কারণ তখন সারা দেশে ছাত্র জনতা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্দোলন করছিল।যেতে হলে অবশ্যই নিঃশর্ত মুক্তিদিতে হবে।সে মুহুর্তে বেগম মুজিব তাঁর জামাতা ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনাকে চিরকুট দিয়ে পাঠালেন ক্যান্টনমেন্টে। কি বলতে হবে সেটাও শিখিয়ে দিলেন।
বেগম মুজিবের কড়া নির্দেশ ছিল, জনগণ তাঁর সাথে আছে। কিছুতেই প্যারোলেমুক্তি নেবে না। তোমাকে বীরের বেশে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে আসতে হবে। তখন অনেকেই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বেগম মুজিবের নির্দেশ পেয়ে লাহোর যাত্রা স্থগিত করেন। পরবর্তীতে বেগম মুজিবের পরামর্শই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। আইউব খান বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কারাগার থেকে মুক্ত হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলার জনতা তাঁকে রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯৭১ সাল, মার্চ মাস। অসহযোগ আন্দোলনের শুরু।সারা বাংলায় বিক্ষোভ দানা বেঁধেছে। আওয়ামী লীগের নির্দেশে পুরো দেশ চলছে। ২রা মার্চ স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরি করা হয়েছে, সেই পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হাতে। ঘনিয়ে এলো ৭ই মার্চ। ছাত্র জনতা চায় বঙ্গবন্ধু আজই স্বাধীনতার ঘোষণা দিক। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ৭ই মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে জানিয়ে দেন, বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করলে আমেরিকা মেনে নিবে না। তারপরই ইয়াহিয়া খান ফোনে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলেন, অনুরোধ করেন এখনই যেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করেন।
এ সময় বাসা ভর্তি মানুষ। বেগম মুজিব সবাইকে তাঁদের ঘর থেকে বাইরে যেতে বললেন।বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে বললেন,তুমি ১০টা মিনিট শুয়ে রেস্ট নাও। কিছুক্ষণ পর বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মনে রেখো তোমার সামনে লক্ষ মানুষের বাঁশের লাঠি।এইমানুষগুলোর নিরাপত্তা এবং তারা যেন হতাশ হয়ে ফিরে না যায় সেটা দেখা তোমারকাজ। কাজেই তোমার মনে যা আসবে তাই তুমি বলবা, আর কারও কোনো পরামর্শ দরকারনাই। তুমি মানুষের জন্য সারা জীবন কাজ করো, কাজেই কী বলতে হবে তুমি জানো।এত কথা, এত পরামর্শ কারও কথা শুনবার তোমার দরকার নেই। এই মানুষগুলির জন্যতোমার মনে যেটা আসবে, সেটা তুমি বলবা।
বিকাল ৩.২০ মিনিট বঙ্গবন্ধু শুরু করলেন ১৮ মিনিট ব্যাপী ঐতিহাসিক কালজয়ী সে ভাষণ। নির্মলেন্দু গুনের ভাষায় –
শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসেজনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন
গণ-সূর্য্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি
“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতি, ধৈর্যশীল ও আদর্শনারী। ৬ দফা আন্দোলনের সময় তিনি নিজের অলঙ্কার বিক্রি করে আর্থিক সাহায্য করেছিলেন। বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি পদক্ষেপে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন বঙ্গমাতা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়ন করার জন্য হিমালয়সম বাঁধা টপকে দিয়েছেন আকুণ্ঠ সমর্থন।
এই মহীয়সীর জন্মদিনে জানাই শ্রদ্ধা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)