চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

বেঁচে ফেরে রবীন্দ্রনাথ, গুলিতে মরে সাদ্দাম-রয়েল

ঘটনা-১
পাঁচ দিন বঙ্গোপসাগরে ভেসে থাকার পর ভারতীয় জেলে রবীন্দ্রনাথ দাশকে বাংলাদেশি একটি জাহাজের নাবিকরা উদ্ধার করে গত ১০ জুলাই। রবীন্দ্রনাথকে অথৈ সাগর থেকে জাহাজে করে উদ্ধারের ভিডিও এরই মধ্যে ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে।

দুই মিনিট ১৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, নাবিকরা জাহাজ থেকে বয়া ও দড়ির খাঁচা পৌঁছে দিচ্ছে সাগরে হাবুডুবু খাওয়া রবীন্দ্রনাথের কাছে। এরপর সেই দড়ির খাঁচায় বসে জাহাজে উঠে আসেন তিনি। লাখ লাখ মানুষ রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধারের সে ভিডিও দেখে জাহাজের নাবিকদের ধন্যবাদ জানান।

ঘটনা-২
একই দিন অর্থাৎ ১০ জুলাই রাতে আবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে ভিন্ন চিত্র। সেখানে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে মারা যান দুই বাংলাদেশি। তারা হলেন, শিবগঞ্জ উপজেলার তারাপুর হঠাৎপাড়ার সাইফুদ্দীন লাওয়ার ছেলে সাদ্দাম ওরফে পটল (২২) এবং দুর্লভপুর ইউনিয়নের দোভাগী গ্রামের আসাদুল ইসলামের ছেলে রয়েল (২৩)।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বঙ্গোপসাগরে যেদিন এক ভারতীয় নাগরিককে প্রাণে বাঁচিয়ে তার মুখে খাবার-পানীয় জল তুল দিচ্ছে বাংলাদেশি নাবিকরা, সেদিন রাতেই চাঁপাইনবাবগঞ্জে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের গুলিতে প্রাণ যায় সাদ্দাম আর রয়েলের। এখানে আরেকটি বড় পার্থক্য হলো, এই দুইজনের মৃত্যুর ঘটনা কোনো মাধ্যমেই ভাইরাল হয়নি। এর পেছনে অবশ্য কারণও আছে, যুগ যুগ ধরেই সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশিদের মৃত্যুর খবর এখন মানুষের গা-সওয়া হয়ে গেছে, তা যেন সুপরিচিত কোনো খাবারের স্বাদের মতো। মানুষ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে, এই মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।

এই দুটি ঘটনার মাত্র কিছুদিন আগে গত ১৫ জুন রাজধানী ঢাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদর দপ্তরে মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকে অংশ নেন বিজিবি ও বিএসএফ মহাপরিচালক (ডিজি)। ওই বৈঠকের পর বিএসএফের ডিজি রজনীকান্ত মিশ্র সীমান্ত হত্যাকে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, চলতি বছরে এ ধরনের ঘটনা বেড়েছে। তার দাবি, যখন বিকল্প থাকে না, প্রাণ বাঁচাতেই বিএসএফ শুধু প্রতিহত করে। তাদের কাছে মানুষের জীবনই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখন সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে না। তারপরও হতাহতের এসব ঘটনা ভারতের সীমানার মধ্যেই ঘটেছে। তাতে বিএসএফ সদস্যরাও প্রাণ হারিয়েছেন।

কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলছে, সেখানে বিএসএফ প্রধানের কথায় মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল দুইদিন আগে ১১ জুলাই জাতীয় সংসদে জানান, গত ১০ বছরে বিএসএফের হাতে ২৯৪ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। যদিও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর এই বিষয়ে দেওয়া পরিসংখ্যানে বিএসএফের গুলিতে নিহতের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। এক্ষেত্রে আমরা যদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরিসংখ্যানকে সঠিকও ধরে নেই, সেটাও বেদনাদয়ক। কেননা পৃথিবীর আর কোথাও এভাবে প্রতিবেশি দেশের নাগরিকদের হত্যা করে না। অনুপ্রবেশের এমন সব ঘটনা মানবিকভাবেই সমাধান করে।  

এমন নয় যে, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত চুক্তি নেই। এ ধরনের ঘটনায় অনুপ্রবেশকারী নাগরিককে তার দেশে প্রত্যর্পণের জন্য সমঝোতা চুক্তি আছে। কিন্তু ভারতের সীমান্তরক্ষীরা এসব ক্ষেত্রে গুলি চালানোই সমাধান মনে করে।

৮ বছর আগে আমরা সীমান্তের কাঁটাতারে ১৪ বছরের কিশোরী ফেলানিকে ঝুলে থাকতে দেখেছিলাম। সেদিন বিশ্ব বিবেক নাড়া দিয়েছিল ফেলানির ঝুলতে থাকা লাশ। ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ভোরবেলা ভারতে থাকা মা-বাবাকে দেখে কাঁটাতারের বেড়া পার হয়ে দেশে ফিরতে চেয়েছিল ফেলানি। বিএসএফের গুলিতে প্রাণ যায় তার। এরপর তার লাশ কাঁটাতারে ঝুলতে থাকে বেশ কয়েকঘণ্টা।

ফেলানির সেই ছবি আমাদের এখনো ভাবায়, কাঁদায়। কিন্তু সেই করুণ মৃত্যুর মিছিল বন্ধ হয়নি। কিছুদিন পরপর সেই মিছিলে যুক্ত হয় নতুন কোনো ফেলানির নাম। তবুও আমরা ভূপেন হাজারিকার গাওয়া সেই কালজয়ী গানের “মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য একটু সহানুভূতি…” মানবিকতাকে ধারণ করি এবং সাগরের অথৈ জলে ভাসা অসংখ্য রবীন্দ্রনাথকে বাঁচিয়ে তাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করি।

তবে প্রাণ নিয়ে দেশে ফেরার অপেক্ষায় থাকা রবীন্দ্রনাথ যখন বাংলাদেশি জাহাজের নাবিক ও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে, তখন আমরা গর্বিত হই। কেননা আমরা চাই মানবিকতাকে ছুঁয়ে যাওয়া এ রকম গর্বের দৃষ্টান্তে তৈরি হোক বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দুই দেশের সীমান্ত। বন্ধ হোক সীমান্ত হত্যা। কারণ শুধু গরু চোরাচালানের সমাধান খুঁজতে সীমান্তে ‘মানুষ হত্য’ চলতে পারে না।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)