বন্ধুর প্রয়াণলিপি লিখা কষ্ট এবং বেদনার। পরিচয় বাংলা-তোলপাড় ঊনসত্তরের মহান গণঅভুত্থানের বছর। ২০১৫ সনের ২১ নভেম্বরে পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া আমাদের কাসেম বছর দু’য়েক আগে যখন আমাকেই চিনতে পারেননি, স্মৃতি অবলোপনের সেই দৃশ্যই জীবন্মৃত বন্ধুর প্রাথমিক প্রয়াণের বেদনায় দ্রবীভূত করেছে।
১৯৬৯ থেকে ১৯৮৬। ছাত্র ইউনিয়ন এবং যুব ইউনিয়নে একসঙ্গে কাজ করেছি সহযোদ্ধার মতো। কতো দিন কতো রাত। চেনা জানার সেই অক্ষর চিরতরে মুছে গেছে। ব্রেন স্ট্রোক। একের পর এক। ক্রমশঃ অবনতি।
অবশেষে মিরপুর বুদ্ধিজীবী সমাধির দেশমাটির নিচে কাসেম অন্তিম শয়ানে। বড় কষ্ট পেয়েছেন। কাসেমের জীবনসাথী ডেইজী ভাবী কী অসাধারণ নিষ্ঠায়, পরম মমতায় ক্রমশঃ মৃত্যুর পানে এগোতে থাকা জীবনবন্ধুর শুশ্রুষায় নিবেদিত থেকেছেন। আমাদের একজন সহযোদ্ধা উৎপল কান্তি ধরের উদ্যোগে কাসেম-ডেইজী জীবনবন্ধনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত ছিলাম।
এ জুটি নির্মাণের পাশে থাকায় ভুল করিনি, কাসেমের জীবনকালের অন্তিম পর্বে এসে তা উপলব্ধি করেছি গভীরভাবে। উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপক হিসাবে অবসর নেয়া ডেইজী ভাবী যে কতোটা সক্রিয় সজীব ছিলেন, তা দেখে ৫৭ বছরে এদেশে অবসর নেয়ার নিয়মটিকেই হাস্যকর বোধ হয়েছে।
এখন যখন ৬৫ বছর বয়সে প্রয়াত বন্ধু কাসেমের জীবনপর্বের ভিতরে দৃকপাত করি, কী ভেসে আসে! জীবনে যখন যে দায়িত্বভার কাঁধে নিয়েছেন কাসেম, সে অঙ্গীকার পূরণের জন্য পাগলের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে সক্রিয়-সজীব এক জীবনযাপন করেছেন বন্ধুটি।
বিশ বছর বয়সে ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়ন-কমিউনিস্ট পার্টি বিশেষ গেরিলা বাহিনীর প্রথম ব্যাচে আসামের তেজপুরে সামরিক প্রশিক্ষণ নেয়া কাসেম নরসিংদীর রায়পুরায় গেরিলাঘাঁটির সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে মাতৃভূমির প্রতি কর্তব্যপালন করেছেন।
আমাদের রাষ্ট্রের করিৎকর্মা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী আবুল কাসেমকে একবার গেজেটভুক্ত করেছে, ফের সেই গেজেট বাতিল করেছে, আরো অনেকের সাথে নিষ্ঠুর একগুঁয়েমিতে। আমাদের মহা করিৎকর্মা জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল জামুকার সম্মানিত সদস্যবৃন্দ লাখ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করার কৃতিত্বে ঝকঝক করছেন।
কাসেম যখন জীবন-মৃত্যুকে পরোয়া না করে মুক্তিযুদ্ধে নিমগ্ন, তখনও ছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ইউকসু)-এর নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে কাসেম বুয়েটের জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হিসাবে স্বাধীন বাংলায় ইউকসুর প্রথম সহসভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন বিপুল ছাত্রসমর্থনে।
১৯৭৩ সনে বার্লিন ছাত্র-যুব উৎসবে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের উজ্জ্বল সদস্য ছিলেন কাসেম। ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক ও সহ সভাপতির দায়িত্ব লাভ করেন তিনি। কমিউনিস্ট আন্দোলনে ক্রমশঃ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মানচিত্রে উজ্জ্বল হতে থাকা প্রকৌশলী আবুল কাসেম যুব ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার মূল দায়িত্বলাভ করেন।
যুব সংগঠন, যুব আন্দোলন গড়ে তোলার কাজটি বন্ধুর, কঠিন। যুবকদের পেশা-কর্মস্থল নানারূপ, পরিবর্তনশীল। যুব আন্দোলনের ইতিবাচক পথরেখার তেমন কোন ঐতিহ্য দেশে ছিল না। ১৯৭৬ সনের ২৮ আগস্ট যুব ইউনিয়ন সূচিত হবার শুরু থেকেই কাসেমের সে কি নিষ্ঠা অচেনা পথে চিহ্ন রাখার।
যুব ইউনিয়নের পথ পরিক্রমার প্রথম দশটি বছর ছিল একজন যুবনেতা কাসেমের অভাবনীয় শ্রম নিবেদনের দশক। সংগঠনটির প্রথম আহ্বায়ক, সাধারণ সম্পাদক এবং সভাপতি হিসাবে ক্রমাগত দায়িত্ব পালন করে দেশ জুড়ে যুব ইউনিয়ন সংগঠনের মানচিত্র অংকনের মূল আঁকিয়ে ছিলেন আমাদের কাসেম।
কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক একজন হিসাবেই যুব আন্দোলনের প্রধান ঘোড়সাওয়ার হিসাবে ভূমিকা পালন করেছিলেন প্রকৌশলী আবুল কাসেম। স্বাধীন বাংলাদেশের শুরুতেই শিথিল-নাজুক পরিস্থিতিতে দেশ জুড়ে শিক্ষাঙ্গনে নকলের বন্যা। সেই বন্যার প্রকোপ থেকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে রক্ষা করার সংগ্রামে শিক্ষকবৃন্দের পাথে কাসেমের দৃঢ়চিত্ত নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ করেছি, মুগ্ধ হয়েছি।
১৯৭৩ সনের ১ জানুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবের বিপরীতে অবস্থিত মার্কিন তথ্যকেন্দ্র ইউসিসের সামনে ভিয়েতনামে মার্কিনী বোমা বর্ষণের প্রতিবাদে আয়োজিত মিছিলে পুলিশের বেপরোয়া এবং বেধড়ক গুলিবর্ষণে মতিউল এবং কাদের শহীদ হন।
ছাত্র ইউনিয়নের পরাগ নামের একজন কর্মীর কণ্ঠনালী ভেদ করে বুলেট চলে যায়, মিছিলের স্পষ্টবাক পরাগ মাহবুব চিরতরে নির্বাক হয়ে গেলেন। আর আমাদের কাসেম? বুলেট বিদীর্ণ করে দিল তার একটি হাত। ১৯৭৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সেই বুলেটে বিপর্যস্ত করতল নিয়েই জীবনযাপন করেছেন কাসেম।
মিছিলে তার পাশে ছিলাম, তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে রক্তাক্ত আহত সহযোদ্ধা কাসেমকে বহন করে নিয়ে যাবার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, কী অসাধারণ সাহসের অস্থিমজ্জায় নির্মিত কাসেম! বুলেটচিহ্নের হাতটুকু এখন মিরপুরে বাংলাজমিনের গভীরে।
১৮ বছর একসাথে কাজ করার অজস্র স্মৃতি। ১৯৭২ সনে ডাকসু, ইউকসু, চাকসু, রাকসু, বাকসু নির্বাচনে জয়জয়কার ছাত্র ইউনিয়নের। বিজয়ী নেতৃত্ব দেখা করতে গেলেন সদ্য স্বাধীন দেশের প্রধান নির্বাহী বঙ্গবন্ধুর কাছে। গোপালগঞ্জে কাসেমের জননীর স্নেহপুষ্ট ছিলেন শেখ মুজিব। কাসেমের বাবা এবং বঙ্গবন্ধুর বাবা ছিলেন নিবিড় বন্ধু।
কাসেমের বড় ভাই বঙ্গবন্ধুর নিবিড় বন্ধু। স্বভাবসুলভভাবে বঙ্গবন্ধু সেই চেনা আপনজনের সুরে এবং স্বরে কথা বললেন কাসেমের সাথে। বিস্মিত হলাম দু’টি কারণে। এতো যে কাছে ছিলাম কাসেমের, কখনোই বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সাথে তাদের পরিবারের এতটা ঘনিষ্ঠতার কথা একবারও উল্লেখ করতে শুনিনি। তদুপরি বঙ্গবন্ধুর অমন নরম সম্ভাষণেও কাসেম এতটুকু বিগলিত না হয়ে দৃঢ়স্বরে তখনকার ছাত্র আন্দোলনের প্রয়োজনীয় কথা, শিক্ষানীতি প্রভৃতি দাবীনামা অবিচল কণ্ঠে উত্থাপন করলেন।
বিষয়টা যে আমার খুব ভাল লেগেছিল তা নয়। কাসেম আরেকটু সৌজন্যের প্রকাশ ঘটালে কী এমন ক্ষতি হতো! কিন্তু ভালো হোক না হোক এটাই কাসেম-বৈশিষ্ট্য। যখন যে দায়িত্বে, তা পালনে একরোখা দৃঢ়চেতা পথরেখা তার।
বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হবার পর সেই হত্যাকাণ্ডে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিবাদী সংগ্রামে আবার কাসেমই ছিলেন অগ্রণী একজন। সামরিক শাসনের বৈরী প্রহরে, নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির গোপন-আধা প্রকাশ্য-প্রকাশ্য কার্যক্রমে কাসেমের নিবেদন ছিল নিরবচ্ছিন্ন।
অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন কাসেম। নেতৃত্বের সহজাত গুণাবলী। তার অমায়িক ভঙ্গী, সুউচ্চ কণ্ঠের হাসি, কর্মীদের কাছে টেনে নেবার অদম্য প্রয়াস তাকে জনপ্রিয় ছাত্র ও যুবনেতায় পরিণত করেছিল। বুয়েটে প্রথম বছরেই সাংস্কৃতিক সপ্তাহে বিতর্কে, উপস্থিত বক্তৃতায় কাসেমের প্রথম পুরস্কার জিতে যাবার চমকপ্রদ কাহিনীর কথা ছিল সুবিদিত।
১৯৭৩ সনে ‘প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় উৎসব’ পালনের বিশাল কর্মকযজ্ঞে কাসেমের নেতৃত্ব প্রদানের স্মৃতি এখনও রূপকথাময়। সে সময়কার অনেকেই টেলিফোন করে সেসব কথা উল্লেখ করেছেন। সারা পৃথিবী থেকেই কাসেমের বুয়েট সতীর্থরা, ছাত্র ইউনিয়ন-যুব ইউনিয়ন সহযোদ্ধারা শোকার্ত সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন এতো বছর পরও।
নানা উঠানামা-তুমুল তোলপাড়ে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন যখন বিপর্যয়ে নিপতিত, কাসেম তখন গণফোরাম প্রক্রিয়ায় ড. কামাল হোসেনর সাথে যুক্ত হলেন। সে সময়ে দেশবিকাশে তার চিন্তাভাবনার পরিচয় মেলে প্রকাশিত ইস্যুভিত্তিক সিরিজ রচনায়।
১৯৯১ এবং ১৯৯৬তে গণফোরাম থেকে নির্বাচন করলেন অবধারিত নির্বাচনী ফলাফল জেনেই। প্রতিদ্বন্দ্বী যে গোপালগঞ্জের শেখ সেলিম! ২০০১ এ নির্বাচন করলেন না, কেননা তখন তার বড় ভাই আবু সাইয়িদ যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার! রাজনীতিতে প্রবেশ করে প্রকৌশলী পেশা ও ক্যারিয়ারের প্রতি কাসেমের উপেক্ষা বড় ভাই একেবারেই পছন্দ করতেন না।
কাসেমও নিঃশব্দ অনমনীয়তায় সে পরিস্থিতি পার করেছেন। গণফোরামের রাজনৈতিক সম্ভাবনা যখন বাস্তবে তিরোহিত, সেসময়েও কাসেম একরোখা জেদে নিমগ্ন। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসাবে সক্রিয় ছিলেন রোগশয্যায় পড়ে যাবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত। কাসেম-বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার জন্যই এসব কথা বলা। কাসেম এখন মিরপুরের মাটিতে।
তার পরিবার এখন ঢাকার পরীবাগে। ডেইজী ভাবী, দু’টি সন্তান। বিশাল ঋণভার। পৈত্রিক সম্পত্তির ন্যায্যমূল্য পেলে বিপন্ন পরিবারটি সব প্রতিকূলতা অতিক্রমের পথ খুঁজে পাবে। কাসেমের জন্য শোকবিহল আপনজনেরা কাসেমের পৈত্রিক সম্পত্তির ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিলে সহমর্মিতার প্রকৃত পরিচয়বহ হয়ে উঠবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)