চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বুকভরা স্বপ্ন নিয়ে ছুটে চলা এক রিকশাচালকের গল্প

কাকডাকা ভোরে রিকশায় প্যাডেল মেরেই শুরু হয় দিন। ঘরে অসুস্থ বৃদ্ধ মা, তৃতীয় শ্রেণী পড়ুয়া মেয়ে আর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী। পরিবারের ব্যয় বহন করার পুরো দায়িত্বই নিজের কাঁধে। এভাবেই চলছে গত বিশ বছর। এ পর্যন্ত ঠিকই ছিল! কারণ এরকম গল্প বাংলাদেশের অনেক রিকশাওয়ালার সাথেই মিলে যাবে। কিন্তু তার গল্পটা অন্যদের চেয়ে অনেক আলাদা।

নাম মো. কায়মুল হক কায়েম। বয়স ৩৫। বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার শীতলগাড়ী গ্রামে। ঢাকায় থাকেন এক রিক্সা গ্যারেজে। ২০০০ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন৷ বাবা মারা যাওয়ায় তারও দেড় বছর আগে থেকে পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে। পরবর্তীতে এক বছর ক্লাস করেও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসতে পারেননি অর্থের অভাবে। যে আফসোস তাকে আজও কাঁদায়, এখনও ভাবায় সব নতুন করে শুরু করতে। সে গল্পে পরে আসছি।

তার বাবা মারা যান ১৯৯৫ সালে। ঘরে বিধবা মা ও যুবতী দুই বোনের দায়িত্ব তখন থেকেই নিজের কাঁধে। সংসারের দায়িত্বের কারণে পড়াশোনায় দুই বছরের বিরতি পড়ে যায়। মা মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতেন আর তিনি অন্যের জমিতে কাজ করে যে সামান্য অর্থ উপার্জন করতেন তা দিয়ে সংসার চলছিল না। অন্যদিকে বোন দুজনেরও বিয়ে দিতে হবে। ছোট্ট কাঁধে এত দায়িত্ব নিতে পারছিলেন না কায়েম। পৈতৃক কিছু জমিজমা ছিল সেগুলোও শেষ হয়ে যায় বোনদের বিয়ে দিতে আর পরিবারের খরচ মেটাতে।

তারপর আবার শুরু পড়াশোনা। নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থাতেই মাসে ১৫ দিন ঢাকায় রিকশা চালিয়ে সংসারের ব্যয় মেটাতেন কায়েম। এভাবেই মাধ্যমিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। দিনে দিনে মা’ও বৃদ্ধ হয়ে যান। তখন সব দায়িত্ব নিজের উপর চলে আসে। পড়াশোনাটা আর চালিয়ে যেতে পারেননি। মাসের বেশিরভাগ সময় ঢাকায় রিকশা চালাতেন। বৃদ্ধ মাকে দেখাশোনা করার কেউ ছিল না। এ অবস্থায় বিয়ে করেন ২০০৫ সালে। তারপর এক মেয়ে হয় তাদের। মেয়ে স্থানীয় স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ছে। এত কিছুর মধ্যেও নিজের পড়াশোনার ইচ্ছা শেষ হয়ে যায় না কায়েমের। এখনও স্বপ্ন দেখেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার। রিকশা চালোনোর পাশাপাশি কবিতাও লিখেন তিনি। যার দুই একটি স্থানীয় পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে বলে জানান।

কায়েমের সাথে পরিচয়ের গল্পটাও বলে নেওয়া দরকার। বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলীম হলের সামনে থেকে তার রিক্সায় উঠেন ঢাবি সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান নয়ন। রিকশায় টিএসসি আসতে আসতে নয়নের সাথে তার পরিচয় হয়। নয়নকে নিজের একটি লেখা দেখিয়ে সেটি পত্রিকায় ছাপাতে সাহায্য চান। তখন নয়ন এই প্রতিবেদকের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেন।

কথোপকথনের সময় কায়েম তার গল্পগুলো শোনাচ্ছিলেন। রিকশা চালিয়ে দুই বিঘা জমি বন্ধক নেন তিনি। জমিতে গোবর সার দিতে গিয়ে তার চোখে পড়ে গোবরের সাথে মিশে থাকা প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য৷ নিজে কিছু পড়াশোনা করেছেন, এছাড়াও পত্রপত্রিকা পড়েন নিয়মিত৷ তাই প্লাস্টিকের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতেন৷ তখন তিনি এর ভয়াবহতা সম্পর্কে দেশবাসীকে জানাতে লিখেন এবং সেটি একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশের চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।

তার লেখাটি নিচে তুলে ধরা হলোঃ

‘‘জমির উর্বরতা পলিথিনের ভয়াবহতা
বাংলাদেশ কৃষি নির্ভর দেশ। এদেশের শতকরা ৭০-৮০ জন মানুষ কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এদেশের অধিকাংশ কৃষক অর্ধশিক্ষিত-অশিক্ষিত। জমির উর্বরতা শক্তি বাড়ানোর জন্য কৃষকেরা জমিতে গোবর সার ব্যবহার করে। গোবরের ঢিঁবি বা পালা থেকে ভ্যানে বা যেকোন বাহনে কৃষক জমিতে গোবর সার ফেলায়, সেই গোবরের সাথে মিশে থাকে অসংখ্য পলিথিন বা প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য। সেগুলো কৃষি জমিতে মিশে যায়। ফলে কৃষি জমির উর্বরতা শক্তি কমে যায়। তখন ফসলের বৃক্ষ মাটিতে শিকড় বিস্তার করতে পারে না। এতে ফসলের ফলনও কমে যায়।

অতীতে সরকারি উদ্যোগে পলিথিন বা প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেলে পলিথিনের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে পলিথিনের ব্যবহার আবার শুরু হয়েছে। এমতাবস্থায় যদি পলিথিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে আমাদের সোনার বাংলা ফসল উৎপাদনে বাধাগ্রস্ত হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে ফসল উৎপাদন বাড়াতে হলে জমির উর্বরতা জরুরী৷ তাই পলিথিনের ক্ষতিকর দিকগুলো সাধারণ মানুষের জ্ঞান সীমায় পৌঁছে দিতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ নেওয়া অপরিহার্য। এক্ষেত্রে পাটজাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করা যেতে পারে বিকল্প হিসেবে। সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যাতে এই পলিথিনের ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প ব্যবস্থার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।’’

তিনি নিজের চাষ করা জমিতে ছাড়াও অন্যকারও জমিতে প্লাস্টিক পলিথিন জাতীয় জিনিস দেখলে পুড়িয়ে ফেলেন। পাশাপাশি অন্যদেরকেও সচেতন করেন বলে জানান। এতে তার নিজ গ্রামে অনেকেই এ জাতীয় জিনিস ব্যবহারে সচেতন হয়েছেন বলেও জানান।

পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হওয়া কায়েম এখনও স্বপ্ন দেখেন আবার কলেজে ভর্তি হওয়ার। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে শেষ করতে চান পড়াশোনা। তারপর দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে চান। চালিয়ে যেতে চান সমাজ সচেতনতামূলক কাজ।

আর এজন্য তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ‘আমি বাধ্য হয়ে পরিস্থিতির চাপে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। কিন্তু সবসময়ই পড়াশোনাটা শেষ করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু পারিনি পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে গিয়ে। এখন বয়সও বেড়েছে। কিন্তু আমি তো ইচ্ছা করে পড়াশোনা ছেড়ে দেইনি। এখন পরিবারের সদস্য সংখ্যাও বেড়েছে। তাই আয়ও করতে হয় বেশি। সারাদিন হাড় ভাঙ্গা খাটুনি খেটে পড়াশোনা করব কিভাবে? যতটুকু শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে সেটা দিয়ে যদি একটা স্থায়ী কাজ পেতাম তাহলে আবার শুরু করতে পারব পড়াশোনা।’

উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় পাঠ্যসূচী বহির্ভূত কার্যক্রমেও পুরস্কার জিতেছেন কায়েম। অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন বঙ্গবন্ধুর জীবনীর উপর বক্তৃতা দিয়ে প্রথম হয়েছিলেন বলে জানান কায়েম।

কায়েমের এরকম সচেতনতা মূলক কাজের সত্যতা মিলেছে তার এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যের সাথে কথা বলে। ইউপি সদস্য বাদল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ‘সে (কায়েম) এলাকায় কম থাকে। ঢাকায় রিকশা চালায়। তবে বাড়িতে আসলে কৃষকদেরকে প্লাস্টিক পলিথিনের ব্যবহারে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানায়। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে স্থানীয় পত্রিকাতে তার লেখাও পড়েছি।’

সবসময় রিকশার সিটের নিচে টুলবক্সে খাতা কলম নিয়ে ঘোরেন কায়েম। কোন অসঙ্গতি দেখলেই লিখে ফেলেন। লিখেন কবিতাও। আর মনে গভীরে স্বপ্ন বুনেন আবার পড়াশোনা শুরু করার।