বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের জন্মস্থান কোথায়? তার জীবনী এবং বীরত্বগাঁথা তো দূরের কথা এ প্রশ্নের জবাবই মিলল না স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ের অন্তত দশজন শিক্ষার্থীর কাছে। প্রাথমিকের পাঠ্যবইয়ে বীরশ্রেষ্ঠদের গল্পে এ সম্পর্কে খুব ক্ষুদ্র একটি অধ্যায় থাকলেও মাধ্যমিক বা কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে তেমন কোনো ধারণা রাখে না বললেই চলে।
জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের জন্মস্থান ভোলার প্রায় দশজন শিক্ষার্থীকে এমন প্রশ্ন করে যখন ভাসা ভাসা সঠিক উত্তর পাওয়া যায় দু’য়েক জনের কাছে, তখন সারাদেশে বীরশ্রেষ্ঠদের সম্পর্কে প্রজন্ম কতোটা ধারণা রাখছে তা সহজেই বুঝা যায়।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্মৃতি জাদুঘর কোথায়? কোথায় সমাহিত আছেন জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান? এই প্রজন্মের কাছে এসব প্রশ্ন অবান্তরই মনে হলো। এমন প্রেক্ষাপটে মোস্তফা কামালের জন্মস্থান ভোলা জেলার দৌলতখান এবং তার স্মরণে করা স্মৃতি জাদুঘরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। দৌলতখানে যাওয়ার পথে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে এমন উত্তরও পাওয়া গেছে: ‘ভাই, আমি তো অনেক বছর ঢাকায় ছিলাম এই নামে কাউকে চিনি না, তাদের বাড়ি কোথায় তাও জানি না।’
দৌলতখান মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স মার্কেটের এক দোকানীকে জিজ্ঞেস করেও এ বিষয়ে সদুত্তর পাওয়া গেল না। পরে অবশ্য জানা গেল, বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের পরিবার ভোলা সদরে ১৯৮২ সালে বরাদ্দ পাওয়া সরকারি বাড়িতে থাকেন। এর পাশেই তার স্মরণে করা স্মৃতি জাদুঘর। তাই পরদিন সেই জাদুঘর এবং এই বীরশ্রেষ্ঠ’র রত্নগর্ভা মায়ের সান্নিধ্য পেতে সেখানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত।
ভোলা সদরের রাজনৈতিক কর্মী ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট রিহান আহমেদ শুরুতেই সেই জাদুঘর ও বাড়ির ঠিকানা দিলেও লালমোহন থেকে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল বাস টার্মিনালে এসে সেখানে যাওয়ার কোনো পথ নির্দেশক নজরে পড়লো না। জেলা পরিষদের কতোটা অবহেলা এবং দায় এড়ানোর মানসিকতা হলে এমন অবস্থা হয়, তা সহজেই অনুমেয়। বাস টার্মিনালের পাশ দিয়েই ‘ভোলা বিশ্বরোড’ ধরে কিছুদূর গিয়ে মাদ্রাসা বাজার, সেখান থেকে অল্প দূরত্বেই আমরা পৌঁছালাম জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের স্মৃতির এই স্থানে। ঢাকা থেকে আসতে হলে ভোলা খেয়াঘাটে নেমে সেখান থেকে মাদ্রাসা বাজার হয়ে গ্রন্থাগার ও জাদুঘর এবং তাদের বাড়িতে যাওয়া যাবে।
স্মৃতি জাদুঘরে ঢোকার আগেই জানা গেল সেখানকার অযত্ন-অবহেলার কথা। ভেতরে গিয়ে সেসবের সত্যতা মিলল। দেখা গেল, কেয়ারটেকার নেই। মোটরবাইক রেখে তিনি গিয়েছেন স্থানীয় হাসপাতালে। কাউকে না পেয়েই পরিদর্শন করলাম জাদুঘর। শিশু সাহিত্য, প্রযুক্তি বিজ্ঞান, রচনাবলীসহ আরও কিছু শেল্ফ ভাঙাচোরা এবং খালি পড়ে আছে। একইসঙ্গে জাদুঘরের ভেতরের একটি কক্ষের দরজা পুরোটাই ভাঙা। মোস্তফা কামাল স্মৃতি জাদুঘর হলেও সেখানে এই বীরশ্রেষ্ঠর বীরত্বগাঁথা ও জীবনী সংক্রান্ত কোনো বই পাওয়া গেল না সেখানে। সবমিলিয়ে পুরো গ্রন্থাগার ও জাদুঘরেই অযত্ন আর অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। একপর্যায়ে পাশে থাকা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করে জানা গেল গ্রন্থাগার ও জাদুঘরে লোকজনের আনাগোনা না থাকায় সেখানে শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানো হয়।
এসব বিষয়ে জানতে মাঠের অপর পাশের প্রাথমিক স্কুলে গিয়ে পাওয়া গেল না প্রধান শিক্ষককে। শিক্ষিকরা জাদুঘর সম্পর্কিত কিছু জানাতে পারলেন না, বা জানালেন না। তারা জানালেন পাশের দোকানে গেলে তত্ত্বাবধায়ককে পাওয়া যেতে পারে। সেখানে গিয়ে আশেদ নামের একজনকে পাওয়া গেল। তিনি জানালেন তার ভাইয়ের অবর্তমানে তিনি জাদুঘরের দেখাশোনা করেন। এখানে প্রাইভেট পড়ানোসহ নানা অবহেলার বিষয়ে যখন তাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হলো, তিনি হাসিমুখে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার একফাঁকে জানালেন: তিনি বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের ভাগ্নে। তার বড় ভাই রাশেদ মূলত এই গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের দেখাশোনা করেন।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের স্মৃতির প্রতি এমন অবহেলা কেন? জেলা পরিষদ বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় কি এ বিষয়ে উদাসীন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন: ২০০৮ সালের পর থেকে বেশ কয়েকবছর জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে গুরুত্বসহ খোঁজখবর নেয়া হলেও এখন তেমন কোনো লক্ষণ নেই।
একপর্যায়ে আমরা গেলাম বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের মায়ের কাছে। তার গ্রামের বাড়ী দৌলতখানের হাজীপুর মেঘনা গর্ভে বিলীন হয়ে গেলে ১৯৮২ সালে তাদেরকে এই বাড়ীটি বরাদ্দ দেয়া হয়। সেখানে প্রথমে সেমি পাকা ঘর করে দেয়া হলেও এখন তা বিল্ডিং। কয়েকদিন আগে সেনা সদরের বরাদ্দ পেয়ে ঘরে টাইলস লাগানো হয়েছে। এখনও বাড়ির গেটে কাজ চলতে দেখা গেল। আমরা বীরশ্রেষ্ঠর মায়ের সঙ্গে সাক্ষাত করলাম। ৯৬ বছর বয়স হলেও খুবই সাদা মনের মানুষ মনে হলো। যে গর্ভে ধারণ হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ, সেই মা এমন হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। চলাফেরা করতে না পারা এবং স্মৃতিশক্তি তেমন একটা না থাকলেও ঠিকই বললেন মোস্তফা কামালের স্মৃতি।
তিনি বললেন: মোস্তফার বাবা, দাদাসহ বংশের অনেকেই সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। একাত্তরের সেই উত্তাল সময়ের এক সকালে পান্তা ভাত খেয়ে আমার বাবা (মোস্তফা কামাল) যে সেই বের হলো, আর ফিরে পেলাম না। এমনকি জীবনে কোনোদিন একবারের জন্য স্বপ্নেও দেখিনি। ইতোমধ্যে মায়ের চোখের কোণে পানি জমতে শুরু করেছে। তাই অন্য প্রসঙ্গে কথা বললাম। শরীরের অবস্থাসহ নানা কথা জিজ্ঞেস করলাম। বললেন, নাতি এবং তাদের স্ত্রীদের যত্নে তিনি খুব ভালো আছেন।
বীরশ্রেষ্ঠর মায়ের কাছে দোয়া চেয়ে বিদায় নিয়ে পরে কথা হয় মোস্তফা কামালের ভাতিজা এবং স্থানীয় বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল মহাবিদ্যালয়ের লেকচারার সেলিম আহমেদ লিটনের সঙ্গে। তিনিও আক্ষেপের সঙ্গে জানালেন জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তানের পরিবারের প্রতি অবহেলার কথা।
তিনি বললেন: পারিবারিকভাবে আমরা কাকার মৃত্যুবার্ষিকী পালন করি। জেলায় তেমন কেউ এমন আয়োজন করে না। আমাদের পারিবারিক আয়োজনে জেলা প্রশাসকদের দাওয়াত দিলেও তারা আসেন না বললেই চলে। প্রতিনিধি পাঠিয়েই নিজেদের দায় সারেন। এছাড়া কাকার জন্মস্থান দৌলতখানে লঞ্চ টার্মিনাল এবং জেলা পরিষদের অডিটোরিয়ামের নামকরণ ওনার নামে করা হলেও এখন তা নেই। এগুলো কারা পরিবর্তন করে? গত কেয়ারটেকার আমলে ভোলা সদরের এই এলাকার নাম মোস্তফা কামাল নগর করা হলেও সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। লোকজন এখনও এই এলাকাকে আলীনগর হিসেবেই জানে। বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল বাসস্ট্যান্ড থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা আয় করলেও সেখানে এখন পর্যন্ত ওনার একটা ম্যুরাল বা স্মৃতিস্তম্ভ কেউ করেনি। এভাবে বললে আরও অনেক কষ্টের কথা বলা যাবে, তবে আমরা কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে চাই না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কাকা যতোটা সম্মানের সঙ্গে আছেন, নিজ জন্মভূমিতে ঠিক ততোটাই অবহেলার শিকার।
প্রায় একই কথা জানালেন মোস্তফা কামালের ভাই মোস্তাফিজুর রহমান। দৌলতখান লঞ্চঘাটের নাম বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল লঞ্চঘাট থাকলেও সম্প্রতি নোয়াখালী থেকে আসার সময় তা দেখেননি বলে জানালেন তিনি। এছাড়াও বীরশ্রেষ্ঠর প্রতি এমন অযত্ন-অবহেলার কথা আক্ষেপের সুরেই জানালেন মোস্তাফিজুর রহমান।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ভোলা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম ছিদ্দিক বলেন: বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর আমি পরিদর্শন করে এসেছি। ওনার মায়ের সঙ্গেও দেখা করেছি। জাদুঘর সংস্কারের জন্য আমরা জেলা পরিষদকে চিঠি দিয়েছি। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিগগিরই সংস্কার কাজ শুরু হবে বলে আশা করি।
এই জাদুঘরে যাওয়ার জন্য জেলার কোথাও কোনো পথনির্দেশক না থাকার বিষয়টি জেলা প্রশাসকের নজরে আনা হলে তিনি এ বিষয়েও ইতিবাচক মানসিকতা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন: এটা ভালো একটি প্রস্তাব। আমরা শিগগিরই পথনির্দেশকসহ এই জাদুঘরের বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা আরও বাড়াবো।
জেলা প্রশাসকের এই আশ্বাস কথার কথা হবে না বলেই বিশ্বাস করি। এতদিনের উদাসীনতার ফলে ভবিষ্যত প্রজন্ম যে মুক্তিযুদ্ধ ও বীরশ্রেষ্ঠদের চেতনা থেকে ছিটকে পড়ছে তা ফুটে উঠেছে মোস্তফা কামালের ভাগ্নে আশেদের কথায়। দর্শনার্থী এমনকি এই গ্রন্থাগারে এলাকার লোকজন বা শিক্ষার্থীরা কেন আসছে না? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন: ‘শিক্ষার্থীসহ প্রায় সবাই এখন স্মার্টফোনে মগ্ন হয়ে গেছে। এজন্য আগে এখানে মোটামুটি জনসমাগম হলেও এখন তেমনটা নেই।’
মোস্তফা কামালের বিষয়ে জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের নীরবতার কারণে ইতোমধ্যে প্রজন্মের ক্ষতি যা হওয়ার, তা হয়ে গেছে।
এই অবস্থা থেকে রেহাই পেতে হলে বীরশ্রেষ্ঠদের স্মৃতির প্রতি এমন অযত্ন-অবহেলার মানসিকতা থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের এই মহান বীরসহ সকল মুক্তিযোদ্ধার যথাযথ সম্মান দিতে হবে। তাদের চেতনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে নিরলস কাজ করতে হবে। এর বদলে এই মহান বীরদের প্রতি এমন অযত্ন-অবহেলা কখনোই কাম্য নয়, কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)