ভয়াবহ জঙ্গি হামলা ঘটনার পর বিধ্বস্ত সেই হলি আর্টিজান আবারও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ছোট পরিসরে বেকারি চালু করে কাস্টমারদের ভাল সাড়া পাচ্ছেন তারা। তবে বিভীষিকাময় সেই স্মৃতি আজো ভুলতে পারেননি হলি আর্টিজানে সেই সময়ের কর্মচারিরা। প্রতিনিয়তই এক অজানা আতঙ্কে সময় কাটে তাদের।
সরেজমিন দেখা গেছে, গুলশান-২ নম্বরে গোল চত্বরের কাছাকাছি ১৫৩/এ গুলশান নর্থ অ্যাভিনিউয়ে হলি আর্টিজান বেকারিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কর্মচারিরা। র্যাংগস আর্কেডের দোতলায়, সুপারশপ গোরমেট বাজারের একটি অংশে চলছে বেকারির কার্যক্রম। গত ১০ জানুয়ারি চালু করা হয়েছে বেকারিটি।
ভবনটির সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে সুপারশপটির ঠিক ডান দিকে তাকালে দেখা যাবে সাদা রং দিয়ে ইংরেজি বর্ণে লেখা-‘হলি: স্লো, বিউটিফুল অ্যান্ড প্রিসাইস’। সুপারশপের দরজা পেরোলে ডান দিকের কোণায় ছোট পরিসরের হলি আর্টিজান বেকারি।
হালকা সবুজ রঙের নিচু পার্টিশান দিয়ে মূল দোকান (গোরমেট) থেকে একটা অংশ আলাদা করে বেচাকেনা করছেন কর্মচারিরা। সেখানে রয়েছে নয়টি ছোট গোল টেবিল ও নয়টি চেয়ার। এছাড়া দুই পাশে রয়েছে সোফা যুক্ত একজোড়া বেঞ্চ।
বেকারির কাউন্টারের ওপর সাজানো রয়েছে নানা আকারের রুটি, ক্রোসন, ইয়েগা। কাচের আঁড়ালে রাখা আছে কেক-পেস্ট্রি-টার্ট। আর কাউন্টারের সামনে দেখা গেছে ক্রেতাদের জটলা।
আগে বেকারি ও রেস্তোরাঁ থাকলেও এখন শুধু বেকারি অংশ চালু করা হয়েছে ছোট পরিসরে। আগের ঠিকানায় লন আর ভবনের দুই তলা মিলে প্রায় ৭০ জন অতিথি বসার ব্যবস্থা ছিল। সেই তুলনায় নতুন দোকানের আয়তন মাত্র ৫০০ বর্গফুট, এক সাথে বসতে পারবে ১৫ থেকে ২০ জন অতিথি।
ভয়াবহ ওই ঘটনার সময় সেখানে কর্মরত ছিলেন শপ ইনচার্জ শাহরিয়ার আহমেদ।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: ঘটনার পর সেখানে যারা কর্মরত ছিলেন তাদের সবাই বেকার হয়ে পড়েন। খুবই খারাপ সময় পার করতে হয়েছে সবাইকে। রেস্তোরাঁয় ও বেকারিতে প্রায় ৫০ জন স্টাফ কর্মরত ছিলেন। তাদের আয়ের ওপর ভর করেই চলতো তাদের পরিবার। বেকারি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর দূর্বিষহ জীবন কাটাতে হয়েছে পরিবারের সদস্যদেরও।
বেকারিতে কর্মরত স্টাফরা জানান, চালু হওয়ার পর কাস্টমাররা নিয়মিত আসছেন। খাবার খাচ্ছেন, কেউ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন।
শাহরিয়ার আহমেদ বলেন, ‘আমাদের কিছু নিয়মিত কাস্টমার ছিলো, তারা আসছেন। আগের মতোই ভাল সাড়া পাচ্ছি। বেকারি চালুর খবর শুনে অনেকে এসে অভিনন্দনও জানিয়েছেন। তবে ভাল লাগছে এই জন্য যে, এখন কিছু অনিয়মিত কাস্টমারও আসছে। সব মিলিয়ে আমরা ভাল সাড়া পাচ্ছি। আশা করি, হলি আর্টিজান পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াবে।
আগের হলি আর্টিজানে ৫০ জন স্টাফ থাকলেও এখন মাত্র ৮ জন। এরা সবাই পুরাতন। ছোট আয়তনে করা হয়েছে বলেই স্টাফ সংখ্যা কমানো হয়েছে। কাজের পরিধি বাড়লে ধীরে ধীরে বাকিদেরও ফিরিয়ে আনা হবে।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী শাহরিয়ার বলেন, ‘ওই দিনের ঘটনা সহজে ভোলার মতো নয়। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা। বিভীষিকাময় সেই স্মৃতি কখনই ভুলতে পারবো না।’
তিনি বলেন: আমাদের একজন সহকর্মী ওই ঘটনায় নিহত হয়েছেন। তার জন্য আমাদের কষ্ট হয়। যতদূর জানি তিনিই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপর্জানক্ষম ব্যক্তি। নিশ্চয়ই তার পরিবারের এখন কষ্টে জীবন-যাপন করছে। তবে এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।
আগের মতোই বেকারিতে ভাল সাড়া পেলেও এক অজানা আতঙ্কে সময় পার করতে হয় তাদের। প্রতিনিয়ত চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে ভয়ঙ্কর সেই দৃশ্য। তবুও জীবিকার তাগিদে কাজ করছেন তারা। বেকারির সামনে পুলিশি নিরাপত্তা অনেকটা সাহস যোগাচ্ছে তাদের।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শাহরিয়ার বলেন, ‘যে একটা সময় পার করে এসেছি তাতে আতঙ্ক তো থাকবেই। তবুও মনে সাহস আনার চেষ্টা করছি। কারণ এখানে বেকারির সামনেই পুলিশের চেকপোস্ট রয়েছে। সবসময় পুলিশ থাকে। এছাড়া পাশে রয়েছে গুলশান থানা।’
২০১৬ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে রাজধানীর অভিজাত গুলশান-২ নম্বর এলাকায়। সেখানে হলি আর্টিজান বেকারি ও রেস্তোরাঁয় জিম্মি করে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে জঙ্গিরা। জিম্মিদের উদ্ধার করতে গিয়ে অভিযানে নিহত হন পুলিশের দুই কর্মকর্তা। পরের দিন যৌথ বাহিনীর অভিযানে পাঁচ হামলাকারী জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হয়। এরপর বন্ধ হয়ে যায় রেস্তোরাঁটি।
ভয়াবহ ওই হামলার প্রায় সাড়ে চার মাস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকে হলি আর্টিজান প্রাঙ্গণ। গত নভেম্বরে রেস্তোরাঁটি মালিকপক্ষকে বুঝিয়ে দেয় পুলিশ। তবে, সেখানে না করে নতুন জায়গায় চালু হয় হলি আর্টিজান।
ছবি: ওবায়দুল হক তুহিন