ম্যাজিস্ট্রেট স্ত্রীর কথায় এক বিসিএস কর্মকর্তা তার গর্ভধারিনী মাকে রেলস্টেশনে ফেলে রেখে গেছেন- এমন একটি খবর ভাইরাল হয়েছে সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, খবরটি মিথ্যা। সূত্র যাচাই না করেই কয়েকটি গণমাধ্যম ওই ভুয়া সংবাদটি প্রকাশ করে।
ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ উঠে, ম্যাজিস্ট্রেট স্ত্রী তার মাকে মেনে না নেয়ায় রেলস্টেশনে ফেলে চলে গেছেন। এমন সংবাদ প্রকাশের পরপরই সৃষ্টি হয় তীব্র সমালোচনার।
তবে অনুসন্ধান করে এ সংবাদের কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি। এমনকি যার ফেসবুক পোস্ট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে সংবাদটি করা হয়েছে, তাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
এ ধরনের মিথ্যে সংবাদে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জনপ্রশাসন সংশ্লিষ্টরা। ধিক্কার জানিয়েছেন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরাও।
ওই সংবাদ পড়ে জানা যায়, লোকের বাড়িতে কাজ করে আর রাতে কাপড় সেলাই করে সেই বিসিএস ক্যাডারকে পড়িয়েছেন মা। নিজের জীবন তুচ্ছ করে যে মা সন্তানকে মানুষ করেছেন, গর্ভধারিণী সেই মায়ের সাথে বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তার এ ধরনের আচরণ মেনে নিতে পরছেন না সাধারণ মানুষ। অনেকেই সেই কর্মকর্তার পরিচয় জানতে চেয়ে তাকে আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির কথাও বলেছেন।
বিষয়টি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া আইনজীবী এস এম ইকবাল চৌধূরীর সাথে চ্যানেল অাই অলাইনের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি রোববার সকালের পর থেকে ডিঅ্যাক্টিভ পাওয়া যায় তার ফেসবুক অাইডিও।
আসলে কী ঘটেছিল? বা ঘটেছে? সে বিষয়ে অনুসন্ধান না করেই ব্যারিস্টার এস এম ইকবাল চৌধূরীর ফেসবুক পোস্ট থেকে হুবহু কপি করে সংবাদটি প্রচার করে কতিপয় সংবাদ মাধ্যম।
আর সেই সংবাদের উৎস উল্লেখ করা হয়েছে, একজন আইনজীবীর দেয়া ফেসবুক স্ট্যাটাস।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংবাদ উৎসে যে মায়ের ছবি ব্যবহার করা হয়েছে তিনি একজন ভারতীয়। ২০১৫ সালে ভারতের শাটারস্টক নামক একটি পত্রিকায় ভারতের বৃন্দাবন বৃদ্ধাশ্রমে থাকা এই মায়ের সাক্ষাৎকার প্রচার করা হয়।
কিছু প্রশ্নের উত্তর নেই:
সংবাদটি প্রকাশের পর থেকেই তা আদৌ কতটা সত্য তা নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে কিছু যৌক্তিক প্রশ্ন। কারণ আইনজীবীর দেয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসটি নেই। বৃদ্ধা মায়ের সন্তান কোন জেলার ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত, কোন রেল স্টেশনে তিনি পেয়েছেন বৃদ্ধা মাকে, আর কোন বৃদ্ধাশ্রমেই বা রেখেছেন এসবের কোনো বিস্তারিত বর্ণনা দেননি।
ওই আইনজীবী বৃদ্ধা মায়ের বয়স লিখেছেন সত্তর বছর। কিন্তু এত নিশ্চিতভাবে তিনি কীভাবে বয়সের বিষয়টি উল্লেখ করলেন?
প্রশ্ন আছে মায়ের কাছে পাওয়া ছেলের লেখা চিঠির ভাষা নিয়েও। যেখানে ছেলেকে সরকারি কর্মকর্তা এবং বৌ-মাকে ম্যাজিস্ট্রেট বলে দাবি করা হয়েছে। আর এ থেকেই জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে একটি বিশেষ পেশায় কর্মরতদের হেয় করার জন্যই এ গল্প ধরনের গল্প নয় তো?
বিএসএস কর্মকর্তাদের বক্তব্য:
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব কবির বিন আনোয়ার চ্যানেল অাই অনলাইনকে বলেন, ‘এ ধরনের একটি সংবাদ আমরা দেখেছি। কিন্তু ঘটনা কতটুকু সত্য সে বিষয়ে আমরা আরও বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।’
বিষয়টি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উল্লেখ করে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ৩০ ব্যাচের প্রচারক ও প্রকাশনা সম্পাদক তৌহিদ এলাহী চ্যানেল অাই অনলাইনকে বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে সরকারী কর্মকর্তাদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যই এ ধরণের একটি ভুল সংবাদ প্রচার করা হয়েছে। যা অত্যন্ত দু:খজনক। এর মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এবং সমাজে আমলাদের গ্রহণযোগ্যতা নষ্টের চক্রান্ত করা হয়েছে।’
চিঠি নিয়ে প্রশ্ন:
ওই বৃদ্ধার ব্যাগে পাওয়া ছেলের লেখা চিঠি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সেই চিঠি কীভাবে ভাঁজহীন থাকলো? এ নিয়েও দানা বেঁধেছে সন্দেহ।
কী বলছেন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞরা:
সংবাদটির প্রতিক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। সেখান থেকে পাঠকদের জন্য কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।
তিনি লিখেছেন,
‘সন্দেহ নেই বানোয়াট খবর বিরাট একটা সমস্যা। সামাজিক মাধ্যম থেকে তথ্য নিয়ে পাতা ও সময় ভরানোর প্রবণতা এখন বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে মারাত্মক চেহারা নিয়েছে। ডেস্কে বসে প্রতিবেদন তৈরি করতে হলেও যে ভেরিফিকেশানের বিষয় আছে, সাংবাদিক হিসেবে সেটি বিস্মৃত হলে চলে? ‘সম্পাদক’ হিসেবে যাদের গেট-কিপিং করার কথা, তারাই বা কোথায়?
ফেসবুক থেকে তো আমরা সবাই পাই। কিন্তু আপনারা তো সংবাদ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান তাই না? নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতায় নিজেরাই কুড়োল চালাচ্ছেন কেন?
ভাইরালকৃত পোস্টগুলির সঙ্গে নারী বিদ্বেষমূলক, বিশেষতঃ কর্মজীবী নারী বিদ্বেষমূলক যে মন্তব্যগুলি আছে, কোনো গবেষক তার আধেয় বিশ্লেষণ করতে পারেন।’
যমুনা টেলিভিশনের সাবেক সিইও এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু আলম মো. শহীদ খান বিষয়টি নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘ফেসবুকে ভাইরাল একটি অসত্য খবর। অথচ আমাদের কোন কোন মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করছে যাচাই না করেই। এটা কি মিথ্যা খবরের সাথে বিসিএস/ম্যাজিস্ট্রেট জুড়ে দেয়ার কারণে। যিনি প্রথম ফেসবুকে এটা পোস্ট করলেন ভারতের ছবি এবং হাতে লিখা জাল চিঠি দিয়ে তার প্রতি ঘৃণা! আর হায়রে মিডিয়া। বিসিএস বা ম্যাজিস্ট্রেট পেলেই হয়ে উঠে অযাচিত সংবেদনশীল। হে মহা শক্তিধর মিডিয়া ফেসবুক থেকে কিছু নেয়ার আগে আরো সাবধান হোন।’কী লেখা ছিল সেই স্ট্যাটাসে?
গত ২৯ মার্চ নিজের মাকে রেলস্টেশনে ফেলে যাওয়ার অভিযোগ জানিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন ব্যারিস্টার এস এম ইকবাল চৌধূরী। সেখানে তিনি লেখেন,
‘কয়েকদিন পর্যন্ত শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। ব্লাডপ্রেসার ডিস্টার্ব করছে আর বন্ধুরা বলে, আমার মাথার মাদারবোর্ড নাকি কাজ করছেনা- হা হা হা। তারপরও রেলস্টেশন গিয়ে দু’জন হাটাহাটি করছি কারণ আমাদের একজন সিনিয়র কলিগকে রিসিভ করতে অর্থাৎ ট্রেনের অপেক্ষায়। কিছুক্ষণ পর একটি জায়গায় বসে আছেন একবৃদ্ধা, যার বয়স সত্তর।
তিনি একজন মা। মায়ের মুখ হতে উচ্চারিত হচ্ছে- ‘খোকা কোথায় গেলি বাবা’। মায়ের কাছে জানতে চেয়েছি, খোকা কে? তিনি বললেন, আমার একমাত্র ধন (ছেলে)। তার সঙ্গে একটা ছোট ব্যাগ আছে। আমরা তার অনুমতি নিয়ে ব্যাগের বাহ্যিক পকেটে হাত প্রবেশ করালাম যাতে কোনও ফোন নম্বর পাওয়া যায় কি না। একটি চিঠি পেয়েছি তাতে কি লেখা ছিল নিম্নে সন্নিবেশিত।
ততক্ষণে ট্রেন উপস্হিত আর অতিথিসহ সিদ্ধান্ত নিলাম মাকে কোনো বৃদ্ধাশ্রমে ভর্তি করায় দেয়ার। স্টেশনমাস্টারের রুমে প্রবেশ করে নিজেদের পরিচয় দিলে তিনি যথার্থ সম্মান দিয়ে জানতে শশব্যস্ত হচ্ছেন কিন্তু আমরা মায়ের দূর্ঘটনার কথা বলাতে, তিনি মাকে নিজ চেয়ারে বসালেন।
মায়ের সন্তান একজন বিসিএস কর্মকর্তা। লোকের বাড়িতে কাজ করে আর রাতে কাপড় সেলাই করে বিসিএস ক্যাডারকে পড়িয়েছেন। আমি চেয়েছিলাম, সেই বদমাশ ছেলের নামসহ বিস্তারিত তুলে ধরতে কিন্তু মায়ের অনুরোধ যাতে তা না করি। মায়ের মতে,সন্তান ও বৌমা ম্যাজিস্ট্রেট আর তাদের সামাজিক মর্যাদা আছে। হায়রে মা…….সন্তানের সম্মান মায়ের কাছে কত মূল্য আর কুলাঙ্গারের কাছে মা কত ‘বিপদ’ !!
মায়ের বর্তমান ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম আর অভিভাবকের কলামে আমার নাম লিখাতে পেরে গর্বিত।
গতকাল বৃদ্ধাশ্রম থেকে ফোন আসলে রিসিভ করে অপরপ্রান্তে মায়ের কণ্ঠে- ‘খোকা, আমার মন ভালো নাই, যদি পারো একটু দেখতে এসো।’ ছুটে গেলাম জননীর নিকট খোকা হয়ে তখন দেখি মাকে ডাক্তার অবজারভেশনে রেখেছেন। মায়ের কপালে হাত রাখতেই তিনি চোখ খুলে মুচকি হেসে পানি চাইলেন এবং আমি তাকে পানি খাওয়াই।
তিনি বলেন, খোকা বেঁচে থাকবি সিংহ হয়ে। একদিন মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে জান্নাতগামী হলেন।
গতমাসে ঘটনাটি ঘটলেও আজ এ বিষয়ে লিখছি কারণ চোখের ঝর্ণাপ্রবাহ লেখার ক্ষমতাকে প্লাবিত করে যার ফলে বারবার বাধা পাচ্ছিলাম। কোনো মায়ের পরিণতি যেন তেমনি না হয়।’