প্রাপ্তি আর হারানোর হিসাব কষতে বসলে দেখা যাচ্ছে ২০২০ সাল কেবল নিয়েই গেছে, প্রাপ্তি সবে হাতেগোনা। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে চলতি শতাব্দীর সবচেয়ে অভিশপ্ত বছর হিসেবে সালটা ছিল নক্ষত্র পতনের কাল। অন্য অঙ্গনের মতো দেশি-বিদেশি ক্রীড়াঙ্গনেও বছরজুড়ে অসংখ্য তারকা হারিয়েছে বিশ্ব।
দেশের ক্রীড়াঙ্গন
বাদল রায়
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে গত ২২ নভেম্বর রাজধানীর একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন বাংলাদেশ ফুটবলের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র বাদল রায়। লিভার, কিডনিসহ নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। ৫ নভেম্বর শ্বাসকষ্টের কারণে রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে, পরে ১১ নভেম্বর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে সেখান থেকে স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে নেয়া হয়। পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে তাকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই মারা যান।
’৭০-৮০ দশকের মাঠ কাঁপানো ফুটবলার ছিলেন বাদল রায়। ’৮১ থেকে ’৮৬ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের হয়ে এবং ’৭৭ থেকে ’৮৯ পর্যন্ত মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের জার্সিতে খেলেছেন। বাংলাদেশ ফুটবলে অনন্য অবদানের জন্য ২০০৯ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পান তিনি।
খেলাকে বিদায় জানানোর পর ফুটবল ফেডারেশনের সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন তিন মেয়াদে। সবশেষ বাফুফে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দিয়ে শারীরিক অসুস্থতার জন্য নাম প্রত্যাহার করে নেন।
গোলাম রব্বানী হেলাল
বাংলাদেশ ফুটবলের অন্যতম সুদর্শন ফুটবলার ছিলেন। গত ২৮মে ব্রেনস্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর ৩০মে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান আবাহনীর জার্সিতে মাঠ মাতানো গোলাম রব্বানী হেলাল। বরিশাল থেকে উঠে এসে ঢাকা আবাহনীর হয়ে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল মাতিয়েছেন। ১৯৭৫ থেকে ’৮৮ সাল পর্যন্ত খেলেছেন আবাহনীতে। মাঝে অবশ্য কিছুদিন বিজেএমসিতে ছিলেন। ১৯৭৯ সাল থেকে ’৮৫ পর্যন্ত খেলেছেন জাতীয় দলে। খেলা ছেড়ে আবাহনী লিমিটেডের পরিচালকও হয়েছেন। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সদস্য ছিলেন। ’৭৯ থেকে ’৮৫ পর্যন্ত খেলেছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলে।
এসএম সালাহউদ্দিন
গোলাম রব্বানী হেলালের মৃত্যুর একদিন পর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন ‘নারায়ণগঞ্জের সালাহউদ্দীন’খ্যাত এ ফুটবলার। ৩১মে ভোরে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার গোগনগর নিজ বাড়িতে শেষ তিনি নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে মারা যান কৃতি এ ফুটবলার।
নুরুল হক মানিক
করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১৪ জুন মারা যান নব্বই দশকের বাংলাদেশ ফুটবলের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার নুরুল হক মানিক। ১৯৮৫ থেকে ’৮৭ সাল পর্যন্ত তিনি আরামবাগে খেলেছেন। পরের বছর ইয়ংমেন্স ফকিরেরপুলে। ১৯৮৯ থেকে ’৯৩ সাল পর্যন্ত ব্রাদার্সে কাটিয়ে নাম লেখান মোহামেডানে, ১৯৯৪ থেকে ’৯৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন সেখানেই। ১৯৮৭ থেকে ’৯৭ সাল, এ দশ বছর জাতীয় দলে জার্সি ছিল মানিকের গায়ে। ঢাকার ফুটবলে তিনি অধিনায়ক ছিলেন চারটি দলের। ১৯৮৭ সালে আরামবাগ, ১৯৮৮তে ইয়ংমেন্স, ১৯৯১তে ব্রাদার্স ও ১৯৯৫ সালে মোহামেডানের নেতৃত্ব দেন।
লুৎফর রহমান
৭০ বছর বয়সে যশোরের লোন অফিসপাড়ায় নিজ বাড়িতে গত ২৯ জুন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন লাল-সবুজ পতাকার জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামের এ ফুটবলযোদ্ধা। ১৯৬৯ সালে ঢাকা ওয়ারী ক্লাবে যোগ দিয়েছিলেন। পরের বছর হন অধিনায়ক। ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতায় গিয়ে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলে নাম লেখান। দলটির খেলা ১৬ ম্যাচের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন। স্বাধীনতার পর খেলেছেন বাংলাদেশ জাতীয় দলে। ১৯৭৫ সালে তুলে রাখেন বুটজোড়া।
কে এন নওশেরুজ্জামান
দুই সপ্তাহ করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই শেষে গত ২১ সেপ্টেম্বর মৃত্যুর কাছে হেরে যান স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্যতম গর্বিত এ সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু অর্জনকারী সাবেক ফুটবলার জাতীয় দলের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে খেলেছেন। দেশের এক মৌসুমে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডধারী নওশের মোহামেডান ক্রিকেট দলের ওপেনিং ব্যাটসম্যানও ছিলেন।
বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গন
কোবি ব্রায়ান্ট
২০২০ সালের শুরু, করোনাভাইরাস তখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে জাঁকিয়ে বসতে পারেনি। এমন সময় ক্রীড়াবিশ্বকে নাড়িয়ে দেয় কোবি ব্রায়ান্টের মৃত্যু। মেয়ে জিজিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন ম্যাচে, কোর্টে পৌঁছানোর আগেই ঘন কুয়াশা আর প্রতিকূল আবহাওয়ায় ক্যালিফোর্নিয়ায় বিধ্বস্ত হয় বাস্কেটবল কিংবদন্তিকে বহনকারী হেলিকপ্টার।
বাস্কেটবল ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় এলএ লেকারসের হয়ে খেলেছেন ব্রায়ান্ট। পাঁচবার জিতেছেন এনবিও চ্যাম্পিয়নশিপ এবং অলিম্পিকে দুবার স্বর্ণ। মাত্র ৪২ বছর বয়সে এমন এক কিংবদন্তির অকালমৃত্যু ভীষণ বিষাদে ছুঁয়ে যায় ক্রীড়াঙ্গনকে।
ডিন জোন্স
পরিবার থেকে বহু দূরে মুম্বাইয়ে ব্যস্ত ছিলেন আইপিলের ধারাভাষ্য নিয়ে। করোনার কারণে তৈরি জৈব নিরাপত্তা বলয়ে সুযোগ ছিল না অন্যদের সঙ্গে খুব একটা দেখা-সাক্ষাতেরও। এমন এক একাকী সময়ে হঠাতই ২৪ সেপ্টেম্বর বুকেব্যথা, তারপর হার্ট অ্যাটাক। চিকিৎসা করার সুযোগও দেননি। ক্রিকেট বিশ্বকে কাঁদিয়ে চলে যান জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার ও সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ডিন জোন্স।
১৯৮৪ থেকে ’৯২ সাল পর্যন্ত ৫২ টেস্ট ও ১৬৪ ওয়ানডে খেলেছেন জোন্স। ওয়ানডে ক্রিকেটে তার মারকুটে ব্যাটিং পাল্টে দিয়েছিল ব্যাটিংয়ের সংজ্ঞাই।
চুনি গোস্বামী
এশিয়ান গেমসে ভারতের স্বর্ণযুগের প্রধান কারিগর ছিলেন চুনি গোস্বামী। তার হাত ধরে ১৯৬২ ইন্দোনেশিয়ান গেমসে স্বর্ণ ও ১৯৬৪ সালে ইসরায়েলে রুপা জিতে নেয় ভারত। শুধু ফুটবলই নয়, চুনি গোস্বামীর গর্বিত পদার্পণ ছিল ক্রিকেটেও, খেলেছেন প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে। অধিনায়ক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গকে রঞ্জি ট্রফিতে দুবার করেছেন রানার্সআপ। বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগে গত ৩০ এপ্রিল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কৃতি ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব।
স্যার এভারটন উইকস
ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিখ্যাত ‘থ্রি ডব্লিউ’র শেষ প্রতিনিধিকে ক্রিকেটবিশ্ব হারায় গত ১ জুলাই। আগের একবছর জুড়েই অসুস্থ ছিলেন, দীর্ঘ অসুস্থতায় ভুগে ক্যারিবীয় কিংবদন্তি ৯৫ বছর বয়সে অন্য দুনিয়ায় পাড়ি জমান।
চেতন চৌহান
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের শিকার হয়ে ভারতের অন্যতম সেরা ওপেনার চেতন চৌহান মারা যান গত ১৬ জুলাই। টেস্টে সুনীল গাভাস্কারের ওপেনিং সঙ্গী জুলাইয়ের শুরুতে করোনায় আক্রান্ত হন। পরে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান ৪০ টেস্ট খেলে ২০৮৪ রান করা সাবেক ভারতীয় ব্যাটসম্যান।
ডিয়েগো ম্যারাডোনা
২০২০ সালে ক্রীড়াবিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়া মৃত্যুটি ছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনার চিরবিদায়। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হওয়ার পর অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল কিছুদিন আগেই। সফলভাবে সম্পন্ন হলে দুসপ্তাহ পর বাড়িতে ফিরেছিলেন। কিন্তু সব চেষ্টাকে ব্যর্থ করে বুয়েন্স আয়ার্সের নিজ ভিলাতে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয় ১৯৮৬ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে শিরোপা এনে দেয়া অধিনায়কের। তার মৃত্যুতে কয়েকদিন শোকের সাগরে ভেসে ছিল সারাবিশ্বের খেলাধুলার জগত।
পাওলো রসি
ম্যারাডোনার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই ফুটবল জগতকে নাড়িয়ে দেয় আরেক কিংবদন্তির মৃত্যু। ৯ ডিসেম্বর দুরারোগ্য রোগে ভুগে মারা যান ইতালিকে ১৯৮২ বিশ্বকাপ জেতানো নায়ক পাওলো রসি। সেই আসরে ৬ গোল করে বলতে গেলে একাই ইতালিকে বিশ্বসেরা করেছিলেন তিনি। সক্রেটিস-জিকোদের নিয়ে গড়া ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্রাজিল দলকে শিরোপা জিততে দেয়নি ওই ইতালি দল।