ইমন ইসলাম: ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানেই উচ্ছ্বাস। ঈদের আনন্দ বহুগুণে বেড়ে যায় যখন পরম আত্মীয় কেউ বাড়িতে ফেরে। অধীর আগ্রহ নিয়ে প্রিয় মানুষের জন্য বসে থাকার অপেক্ষার প্রহর ফুরায়। অপেক্ষার শেষে ঘরে ফেরার আনন্দও কি কম? বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কাছে ঈদে ঘরে আনন্দটা ভিন্ন মাত্রার।
উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ার স্বপ্নালু চোখে পরিবার পরিজন ছেড়ে দেশের আনাচে-কানাচে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আসে শিক্ষার্থীরা। ক্লাস-পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রেজেন্টেশন আরও কত রকমের একাডেমিক কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয় তাদের। হৃদয়ে লালন করা হাজারো স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেই শিক্ষার্থীদের এই বিরামহীন ছুটে চলা। ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর ও মন একটু বিশ্রাম নিতে চাইতেই পারে। সেটি নিশ্চয়ই দোষের নয়। বিরামের সেই সুযোগ নিয়ে আবার এসেছে পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর।
বৈশাখের কাঠফাটা দুপুরে নোটিশ বোর্ডের বুকে এক টুকরো চিরকুট। যেখানে লেখা ‘ছুটির নোটিশ’। বৈশাখের প্রকৃতি যেন নির্মল আনন্দে মেতে উঠে তখন। কাঠফাটা রোদ ঢেকে গিয়ে মেঘলা আকাশের তলে স্বস্তিমাখা শীতল বাতাস শরীরে লাগে যেন! ক্লাস শেষে নোটিশ বোর্ডে উঁকি দিতেই চোখে পড়লো সেই চিরকুট । আহা কি আনন্দ! এতো দিন স্বপ্নে গিয়েছি বাড়ি এবার স্বপ্ন সত্যিই যাবে বাড়ি। যে ক্যাম্পাসের প্রেমে সবাই হাবুডুবু খেত সেই প্রেমটাও যেন “ছুটির শব্দে ফিকে হয়ে গিয়েছে। আগে ক্লাস শেষ হলেই সবাই যেখানে আড্ডা আর খুনসুটিতে মজতো, আজ সবাই ছুটছে টিকেটের জন্য। সেখানে বিক্রি হচ্ছে বাড়ি ফেরার আনন্দ। লম্বা সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে তারা যেন সেই আনন্দ কেনার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা হাজারো স্বপ্ন পিপাসু তারুণ্যে। পরিবারের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে ছুটিতে বাড়ি ফেরেন তারা। রাস্তার সীমাহীন দুর্ভোগ, যানজট, টিকেটের ভোগান্তি কোন কিছুই তাদের বাড়ি ফেরার আনন্দকে দমিয়ে রাখতে পারে না যেন।
ভোর হতেই শুরু হয় তাদের বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি। হলের বন্ধ রুমের আবদ্ধ রঙিন কাপরের জায়গা হয় ব্যাগের এক কোনে । প্রিয় হলের মায়া ত্যাগ করে কল্পনার সেই শুভ যাত্রা শুরু হয় সবার। বিদায় লগ্নে প্রিয় বন্ধুদের চোখ গুলো কেমন যেন ছলছল করে ওঠে। মনে হয় কতদিন হবে না দেখা, হবে না আড্ডা, হবে না খুনসুটি।
এদিনে ক্যাম্পাস অঙ্গনে কেমন যেন বিষাদ মধুর ছায়া নেমে আসে। ক্যাম্পাস যেন বুঝে ফেলে তার সৌন্দর্যের ইতি ঘটেছে। তাকে নিয়ে আর কারো ব্যস্ততা নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসমত আরা শশী বলেন, দীর্ঘ চার মাস পর বাড়ি ফিরছি। অনুভুতিটা একটু বেশিই। বাড়ি যাওয়ার জন্য মন ছটফট করছিলো। অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিনটি এসেছে। বাড়ি যাচ্ছি। গত রাতভর ঘুমাতে পারিনি । কখন সকাল হবে কখন বাসে উঠবো, বাড়ির পথে রওনা হবো? আরো এক্সাইটেড লাগছে কারণ আমি এবার নিজের উপার্জনের টাকায় আব্বু, আম্মু, ভাই সবার জন্য ঈদের শপিং করে নিয়ে যাচ্ছি। সবার হাসিমুখ দেখার অপেক্ষায় আছি।
ট্রেনের হুইসেল যেন তারুণ্যে বুকে ভালোবাসার সঞ্চার ঘটায়। ট্রেনে ওঠা নিয়ে চলে ছোটাছুটি। অনেকে আবার যানজটের অনাকাঙ্খিত আবহকে আপন করেই ছুটতে থাকে প্রিয়জনদের কাছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী ওয়ালিদ হোসেন বলেন, ঈদ মানে আনন্দ, যা দূরের মানুষ গুলোই বেশি উপলব্ধি করে। জাদুর শহর ঢাকার কর্মব্যাস্ততার মধ্যেও ঈদ যেন সুখের মুহূর্ত গুলোকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। পরিবারের সাথে সেই সুখ ভাগ করে নিতেই আমাদের ছোটাছুটি। অনেক দিন বাড়ি যাই না। বাবা- মায়ের সাথে সময় কাটাতে পারিনা । এই অনুভূতি গুলো ঈদের তাৎপর্যতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
বৃদ্ধদের মতো ঠকঠক করে ধীর চলতে থাকে যানবাহন গুলো। আর ওদিকে বাড়ি ফেরার অনুভুতির হিসেব কষতে কষতে চোখ বোলাতে থাকে ব্যস্ত পথিকগণ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সানজানা আলম নির্জনা বলেন, আমার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। আগে পুরো রমজান মাস কাটাতাম পরিবারের সাথে। তবে এবছর রমজানেও চলেছে ক্লাস-পরীক্ষা। ১৯ রোজার পর বাসায় যাচ্ছি। যদিও রাস্তায় অনেক জ্যাম, মানুষের ভিড় কিন্তু বাসায় যাচ্ছি যখন ভাবছি তখন এই কষ্টগুলো নিমিষেই উড়ে যাচ্ছে। বাড়ি ফেরার আনন্দটা অনেক বেশি। ছোটবেলার ঈদের সময়টা ছিল দারুণ। এখন বড় হয়ে গেছি, আর পড়াশোনার ব্যস্ততাও বেড়েছে তবে ঈদের আনন্দটা ঠিক আগের মতোই রয়ে গেছে।
রেল স্টেশনের করিডোর আর বাসস্টপের খোলা বাড়ান্দা ভড়ে ওঠে তারূণ্যের পদচারণায়। কেউবা আবার নীল দড়িয়ার বুক চিরে নদীর মন মাতানো মহুয়া খেতে খেতে বাড়ি ফেরে।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাইরুল ইসলাম বলেন, ঈদের ছুটি পেয়েছি। তাই বাড়িতে যাচ্ছি। আমার বাড়ি রংপুর। সেখানে আমার বাবা-মা, ভাই-বোন ও আত্মীয়স্বজন থাকেন। তাদের ছাড়া ঈদ কল্পনাই করতে পারি না। পরিবারের সাথে ঈদের আনন্দ উপভোগ করতেই তাই বাড়িতে যাচ্ছি । অনেক দিন পর বাড়ি যাচ্ছি, তাই অনুভুতিটাও একটু বেশি ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ব্যস্ত জীবনের চাপে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ঈদের ছুটি কিছুটা হলেও রিলাক্সেশন দেবে। তাই বাড়ি যাচ্ছি। আমার বাড়ি বরিশাল । এই সুযোগে নৌ ভ্রমন টাও হয়ে যাবে। পরিবারের সাথে আবার দেখা হবে, ছোটবেলার সেই আনন্দ ফিরে পাবো ভাবতেই কেমন যেন শিহরণ লাগছে।
ভ্রমন একদিকে যেমন ক্লান্তিকর তেমনি রোমাঞ্চকরও বটে। ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরা মানেই ভ্রমণ করা। আর ভ্রমন মানেই বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে করে হৈ হৈ করতে করতে বাড়ি ফেরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাহিম শাহরিয়ার বলেন, অনেক দিন হলো বাড়ি যাইনা। ঈদের ছুটি যেন আমাকে সেই সুযোগটি করে দিয়েছে। আমার গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়। অনেক কষ্টে টিকেট কেটেছি। বাড়িতে বাবা-মা অপেক্ষা করছেন আমার ফেরার প্রতিক্ষায়। আবারো হৈচৈ কোলাহলে মেতে উঠবো ছোট বেলার বন্ধু বান্ধব ও পরিবার পরিজনের সাথে।