পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্য মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নেয়া এবং পুলিশ ভেরিফিকেশন বিষয়ে জাতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরটি নিয়ে শিক্ষকদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা করছেন। অবশ্য এক্ষেত্রে বিপক্ষের পাল্লাই বেশি ভারী।
শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থাই শুধু নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর সরকারের আস্থা নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। এসব পরীক্ষার সিদ্ধান্তও বাস্তব সমস্যার সঠিক সমাধান নয় বলে মনে করছেন অনেকে।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব পলিটিক্স অ্যান্ড গভর্নমেন্টের বিভাগীয় প্রধান আলী রিয়াজ তার ফেসবুক টাইমলাইনে দেয়া স্ট্যাটাসে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদটি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বিশ্বাস করুন আমি এই সংবাদটি কয়েকবার পড়েছি। মাত্র পাঁচ প্যারার খবর, বাক্য হচ্ছে এগারোটি। কিন্তু একটি বাক্য ছাড়া (‘বর্তমানে দেশে ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে’) বাকি দশ বাক্যের প্রায় প্রতিটি বাক্যে যা বলা হয়েছে, যা প্রস্তাব করা হয়েছে তা আদৌ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বলা যায় কিনা সেটাই বুঝতে পারছি না। কেন বুঝতে পারছি না তার একটু ব্যাখ্যা দেয়া দরকার।
১৯৮৪ সাল থেকে হিসেব করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ২১ বছর শিক্ষকতার সৌভাগ্য হয়েছে, যার অর্থ হচ্ছে এইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত নিয়োগ এবং পদোন্নতি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এর বাইরে ৬ বছর ইউনির্ভাসিটি অব হাওয়াইয়ের গ্র্যাজুয়েট ছাত্র হিসেবে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সঙ্গে যুক্ত থাকার সুযোগ হয়েছে (হ্যাঁ, শিক্ষক নিয়োগে ছাত্রদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো); এশিয়ার একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এক গ্রীষ্মকালে থাকার সুবাদে সেই বিশ্ববিদ্যালয়কে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে; টেনিউর ও প্রমোশনের এক্সটারনাল রিভিউয়ারের দায়িত্ব পালন করেছি অসংখ্য। সর্বোপরি গত নয় বছর ধরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় চেয়ারের দায়িত্ব পালন করছি, যখন সব মিলে বিভাগে টেনিঊর ট্র্যাকে শিক্ষক নিয়োগ হয়েছেন নয় জন।’
নিজের এই অভিজ্ঞতার আলোকে সংবাদে থাকা ‘লিখিত পরীক্ষা’, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়’, ‘একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন’, ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন ও গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তথ্য যাচাই’, ‘সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত … যাতে নিয়োগ না পায়’ – এসব প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন আলী রিয়াজ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিআরা নাসরিন এ বিষয়ে ব্যাঙ্গাত্মকভাবে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন ফেসবুকে। তিনি লিখেছেন:
‘অহো কী অদ্ভুত কৌতুক! পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হবে লিখিত পরীক্ষার ভিত্তিতে!
শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতে পরিবর্তন তো দরকা্রই। তবে দেখার কথা ছিল, শিক্ষক আদৌ পড়াতে পারবেন কিনা। সেটা বুঝে নেওয়া যায় তাকে পাবলিক লেকচার দিতে দিলে। বিষয়ে তার দখল বোঝা যায়, তার গবেষণা কর্মের খতিয়ান করে।
এবার ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-পরীক্ষার তোতা-পাখী গাইড বেরুলো বলে। পুলিশি পরীক্ষাও না কি হবে!
উর্দি দেবেন না? রেজিমেন্টেড বাহিনীর তো চিহ্ন থাকা দরকার!
পূনশ্চ: প্রশ্ন ফাঁসের সুবন্দোবস্তসহ একটি কোচিং সেন্টার খুলে ফেলার ধান্ধায় আছি।’
গীতিআরা নাসরিনের এই স্ট্যাটাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের আরেক অধ্যাপক ফাহমিদুল হক কমেন্ট করে লিখেছেন, ‘ক্লাসে না গিয়ে, নিজের পড়া না পড়ে, ঢাবি লাইব্রেরিতে শিক্ষার্থীরা মোটা গাইড বই পড়বে, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার সহজ উপায়’। রচয়িতা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য।’
একই সংবাদ নিয়ে উপহাস করেছেন তাদের সহকর্মী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক খোরশেদ আলম। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন:
‘‘অনিয়ম এড়াতে শিক্ষক নিয়োগে মৌখিকের সঙ্গে লিখিত পরীক্ষাও নিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।’
‘অনিয়ম এড়াতে’ …… হা হা…… এখনো অনিয়ম এড়ানোর কিছু কি বাকি? তার অর্থ সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম হয়েছে! তাহলে যারা অনিয়ম করেছেন, তাদের চিহ্নিত করে, ব্যবস্থা নেয়া হোক আগে! এবং অনিয়ম করে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তদন্তসাপেক্ষে তাদের ছাঁটাই করা হোক! তবেই বোঝা যাবে এ নয়া-উদ্যোগ ‘অধিকতর দলবাজ-অনুগত’ নিয়োগের নয়া কলা-কৌশল নাকি ‘অনিয়ম’ নির্মূলে কর্তৃপক্ষীয় সদিচ্ছা!!!’
যে কারণে লিখিত পরীক্ষার সিদ্ধান্ত
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এবার থেকে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগে পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং গোয়েন্দাদের মাধ্যমে তথ্য যাচাই করে নেয়ার জন্যও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
নিয়োগের সময় যেন কোনো ধরনের অনিয়ম হতে না পারে সেজন্য লিখিত পরীক্ষা প্রয়োজন। এছাড়া সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত বা কোনো অপরাধী যেন নিয়োগ না পায়, সেজন্য পুলিশ ভেরিফিকেশন করা দরকার বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
জাতীয় দৈনিকে বুধবার প্রকাশিত একটি সংবাদে এসব তথ্য জানানো হয়। বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে পরীক্ষার এ অনুরোধ জানানো হয়েছে।
শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মের গল্প
অনেক সময়ই পরীক্ষায় ফলাফল এবং শিক্ষকতার যোগ্যতা বিবেচনা না করে নানা অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ শোনা যায়। এ নিয়ে এস্তনিয়ান এণ্টারপ্রেনারশিপ ইউনিভার্সিটির ক্রিয়েটিভিটি ডিপার্টমেন্টের বিভাগীয় প্রধান আমিনুল ইসলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
সেখানে তিনি বলেন, এই পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্তের মানে দাঁড়ালো, ‘চার পাঁচ বছর পড়ে যে ছাত্র ছাত্রী গুলো ভালো রেজাল্ট করছে, তাদের উপর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর (পড়ুন মন্ত্রণালয়ের) আস্থা নেই। তারা আদৌ ভালো ছাত্র কিনা সেটা নিয়ে মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় গুলো নিজেরাই সন্দিহান!’
এই সন্দেহ কোত্থেকে আসছে – এমন প্রশ্ন তুলে নিজেই একটি ব্যাখ্যা দেন আমিনুল ইসলাম। স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন:
‘আমরা যাদের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড কিংবা ভালো জিপিএ ধারী বলে বিরাট মেধাবী ছাত্র হিসেবে মনে করি; এরা আসলে ফার্স্ট কিংবা সেকেন্ড হচ্ছে কিভাবে? কেউ ফার্স্ট হচ্ছে শিক্ষকদের পিছে পিছে ঘুরে, ইচ্ছে মতো তেল মেরে; কেউ শিক্ষকদের বাজার করে দিয়ে, কিংবা নানান উপহার দিয়ে; কেউ আবার রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ফার্স্ট হয়ে যাচ্ছে।
এত কিছুর পরও যারা এমনি এমনি ফার্স্ট, সেকেন্ড হয়ে যায় (এদের সংখ্যা খুব কম বলেই আমার ধারণা!); দেখবেন এরা মুখস্ত করা পড়া চমৎকার হাতের লেখায় বমি করে দিয়ে ফার্স্ট হয়ে গেছে। এদের ক্লাসে সামান্য জটিল কিছু একটা জিজ্ঞেস করেন, এরা আর উত্তর দিতে পারবে না! ছাত্রদের উল্টো ধমক দেবে প্রশ্ন করার জন্য!’
এমন শিক্ষার্থীরাই মেধাবী ছাত্র ছাত্রী হিসেবে পরিচিত হচ্ছে আর পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছে বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। এমনই এক শিক্ষকের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন স্ট্যাটাসে প্রবাসী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আমিনুল ইসলাম:
‘আমাদের ক্লাসে এক ম্যাডাম ছিলেন, যিনি ক্লাসে এসে চেয়ারে এসে বসতেন এবং কোথাও থেকে জোগার করে আনা নোট খাতা থেকে রিডিং পড়ে যেতেন। সেই রিডিংও থেমে থেমে পড়তেন, যাতে অন্যরা সেটা লিখে নিতে পারে! ধরুন এই রকম – ‘বাংলাদেশে জনসংখ্যার হার খুব বেশি, এটি একটি সামাজিক সমস্যা’ এই বলে তিনি কিছুক্ষণ থামবেন, এরপর জিজ্ঞেস করবেন – লেখা শেষ হয়েছে? শেষ হলে এর পরের লাইন বলবেন! এইভাবে তিনি পুরো সেমিস্টার পড়িয়েছেন! এই কাজের জন্য একজন শিক্ষকের কী প্রয়োজন পড়লো, আমার ঠিক জানা নেই!’
এই শিক্ষক বলেন, আগে প্রচলিত পুরো ব্যবস্থাটাই পাল্টাতে হবে। নইলে যতই লিখিত পরীক্ষা নেয়া হোক তাতে কোনো লাভ হবে না! স্ট্যাটাসের শেষে কৌতুক করে তিনি বলেন, ‘শেষে কে জানে, এরপর হয়তো শুনতে হতে পারে – বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় নকল করতে গিয়ে কয়েকজন বহিষ্কার হয়েছে! কিংবা প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গেছে!’