বাংলা অভিধানে ‘শুদ্ধাচার’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ পবিত্র বা শুদ্ধ আচরণ। অর্থাৎ নিজের আচার আচরণ ও ব্যবহারে মার্জিত হওয়া। কিন্তু ব্যাপক অর্থে এই শব্দটির বিস্তৃত তাৎপর্য রয়েছে। যা আমরা বুঝি অথবা বুঝতে চাই না।
একজন মানুষের শুদ্ধাচারের বিষয়টি শুরু হয় তার পরিবারের নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে। আর পরিবার থেকে যাত্রা হওয়া শুদ্ধাচার ব্যক্তিক জীবন থেকে শুরু করে সমাজ, দেশ ও রাষ্টীয় জীবনে তার প্রভাব পড়ে।
সাধারণভাবে শুদ্ধাচার বলতে নৈতিকতা ও সততা দ্বারা প্রভাবিত আচরণগত উৎকর্ষ বুঝায়। সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ জীবন ধারণের জন্য মানুষকে ভালো আচরণ, ভালো রীতি, ভালো অভ্যাস রপ্ত ও প্রতিপালন করাই শুদ্ধাচার। একটু ব্যাখ্যা করলে বলা যায়, সততা, সময়ের প্রতি গুরুত্ব, মানবিকতা, সুশাসন, আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, নিজস্ব শুদ্ধ ইতিহাস চর্চা, কর্তব্যনিষ্ঠা, নৈতিকতা দ্বারা নিজ নিজ দ্বায়িত্ব পালনই হলো শুদ্ধাচার চর্চা।
রাষ্ট্রীয় সকল প্রতিষ্ঠানে শুদ্ধাচার চর্চা করা জরুরী। এটিকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আর তা যদি হয় বিশ্ববিদ্যালয় তাহলে তো কোন কথাই নেই। একটি রাষ্ট্রের ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয়কেও আর একটি রাষ্ট্র বলা হয়। যেখানে শুদ্ধাচারের চর্চা করা অতিব প্রয়োজন।
তাই হয়তো জওহর লাল নেহেরু বলেছিলেন, ‘একটি দেশ ভালো হয় যদি তার বিশ্ববিদ্যালয় ভালো হয়।’ আসলেই একজন শিক্ষার্থীর প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকের পরে সর্বশেষ পর্যায় হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। একজন শিক্ষার্থীর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সর্বশেষ ধাপই তার এই আলোর ঘর। তাহলে বুঝাই যায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুদ্ধাচার চর্চা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৭টি। যেগুলো প্রতিষ্ঠা হয়েছে স্বাধীনতার আগে এবং পরে। ইতিহাস বলে আঁশির দশকের পরপরই খুব তাড়াতাড়ি বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায়। যেগুলো এখনও পরিপক্ক হয়ে ওঠেনি বলেই মনে হয়। কারণ নিত্যদিন পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় দেখা নানা ঘটনা। যা পড়ে বোঝা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা প্রশাসন কতটুকু দ্বায়িত্ব জ্ঞানহীন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শুদ্ধাচার চর্চা কতটুকু দরকার, এই বিষয়ে কিছু কিছু বলতে চাই। প্রথমে আসা যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় যদি জ্ঞান চর্চার উদ্যান হয় তাহলে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে হবে। হ্যাঁ অবশ্যই স্বচ্ছতা নিয়ে আসতে হবে। না হলে জ্ঞান চর্চা করার মতো শিক্ষক না পেয়ে উদ্যানে পাবেন কিছু পোকামাকড়। যারা আপনার বাগানের পরাগায়ন করতে গিয়ে শুধু ফুলের সৌন্দর্যই নয়, ফুলকেও নষ্ট করবে। তাই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিয়ে আসা জরুরী।
একজন চাকরি প্রার্থীকে শুধুমাত্র একটি সাক্ষাতকারের মাধ্যমে কীভাবে বিচার করবেন যে তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগ্য। শুধু কয়েকটি প্রশ্ন পারলেই তিনি শিক্ষক হয়ে যাবেন! তিনি কথা বলতে পারেন কিনা, ভাষাগত দক্ষতা কতটুকু তা যাছাই করা দরকার। একজন শিক্ষার্থীর ভালো ফলাফল করলেই কি তিনি ভালো শিক্ষক হবেন? এমন নিশ্চয়তা আপনাদের কে দিয়েছে? তার ফলাফল ভালো কিন্তু তিনি কথা বলতে পারেন না, বুঝাতে পারেন না তিনি কি শিক্ষক হিসেবে যোগ্য হবেন? আচার আচরণ কেমন তাও দেখতে হবে। না হলে একজন ভালো শিক্ষক কীভাবে আপনি নির্বাচন করবেন।
আর যদি একজন শিক্ষক দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পান তাহলে তিনিও দুর্নীতির সুযোগ পেলে তার যথাযত ব্যবহার করবেন বলেই মনে করি। তাই দুর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ না দিয়ে স্বচ্ছতা নিয়ে আসুন। তাহলে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল হবে। প্রায়শই দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের প্রভাব। তারা যদি শিক্ষক নিয়োগে হাত দেন তাহলে কেমন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় পাবে তা সকলেরই অনুমেয়।
শুদ্ধাচারের অভাবে বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বায়িত্ববান ব্যক্তিদের অবৈধ অর্থ উর্পাজন করার চেষ্টা করতে দেখা যায়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে মূল্যবোধের অবক্ষয়, যা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বায়িত্বশীলদের নয় সবারই থাকা দরকার। তা না থাকলে একজন মানুষ অন্যায় করতে দ্বিধা বোধ করবে না। যদি শুদ্ধাচারের কৌশল শিখতে চান তাহলে নিজে সুশাসনের আওতায় আসতে হবে এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। আর যদি সোনার বাংলাদেশ গড়তে চান তাহলে তো কোন কথাই নেই।
সততা, জবাবদিহিতা শুদ্ধাচারের চিত্র। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তা কতটুকু চর্চা হচ্ছে? দ্বায়িত্বশীল পদে বসে কেউ যদি দুর্নীতি করে তাহলে সম্পূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ই দুর্নীতিগ্রস্ত হবে, তা অন্যদের দুর্নীতি করতে উৎসাহ যোগাবে। ভয়ঙ্কর সত্য ব্যাপার হলো এই দুর্নীতির সাথে শুধু পদধারীরা জড়িত এমন নয়, তাদের সঙ্গে আরও অনেক শিক্ষক-কর্মকর্তা জড়িত থাকবেন অবশ্যই। ফলে দুর্নীতির একটি চক্র হয়ে যাবে। এই গুরুত্বপূর্ণ পদকে কেন তারা কলুষিত করবেন? তাই দুর্নীতিগ্রস্ত লোকদের এসব পদে বসানো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো কিছু নয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অশুদ্ধাচারের অনেক জায়গা আছে। যেমন ভর্তি পরীক্ষা, একাধিক গাড়ি ব্যবহার, অবৈধ নিয়োগ, শিক্ষকদের ক্লাস ফাঁকি, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সময়মত অফিসে না আসা, অফিস ফাঁকি দেয়া, যথা সময়ে সেমিস্টার শেষ না করা, ৫-৬ টি ক্লাস নিয়ে কোর্স শেষ করা। এগুলো অশুদ্ধাচারের মধ্যে পড়ে। এগুলো থেকে বিরত থাকতে হবে। না হলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ভঙ্গুর হয়ে যাবে। তাই সাবইকে শুদ্ধাচার চর্চা করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে একই আদর্শের শিক্ষকদের মধ্যে দলাদলি। একে অপরের বিরুদ্ধে নানা কথা বলে বেড়ানো, রাজনৈতিক কারণে শিক্ষক সমাজের বিভাজন এগুলো অশুদ্ধাচারের মধ্যে পড়ে। যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষকেদের এগুলো পরিহার করা উচিত।
অশুদ্ধ চর্চাকে পরিহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। সীমাহীন লোভ দুর্নীতির থেকে বিরত থাকতে হবে। নিম্ন মেধাকে প্রাধান্য না দিয়ে যোগ্য এবং মেধাবীদের প্রধান্য দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই যদি প্রতিটি ক্ষেত্রে শুদ্ধাচার চর্চা করেন তাহলে কারো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। আদর্শ দেশ গঠনের জন্য আদর্শ মানুষ যেমন তৈরি করা দরকার, তেমনি উন্নত দেশ গঠনের জন্য প্রত্যেক মানুষের শুদ্ধাচার চর্চা করা দরকার। তাই আসুন সবাই শুদ্ধাচারের চর্চা করি দেশ ও জাতি গঠন করি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)