টস হেরে প্রথমে ৩২১ রান তুলে স্বস্তিতেই থাকার কথা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। কারণ এই ম্যাচের আগ পর্যন্ত চলতি বিশ্বকাপে তিনশো তাড়া করে জেতার কীর্তি দেখাতে পারেনি কোনো দলই। পারেনি কথাটি আর লেখা যাচ্ছে না। কারণ নিজেদের গড়া চার বছর পুরনো এক রেকর্ড ভেঙে আবার নতুন করে লিখেছে বাংলাদেশ। তাতে এসেছে ৭ উইকেটের অসাধারণ জয়।
সাকিব আল হাসানের ৯৯ বলে অপরাজিত ১২৪ ও লিটন দাসের ৬৯ বলে ৯৪ রানের মহাকাব্যিক অপরাজিত ইনিংসে ক্যারিবীয়দের ৩২১ রানকে পাড়ার ক্রিকেট বানিয়ে ৫১ বল ও ৭ উইকেট অক্ষত রেখেই বিশ্বকাপকে দারুণ এক জয় উপহার দিয়েছে টাইগাররা।
অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের আসরে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ৩১৮ রান তাড়া করে জিতেছিল টাইগাররা। ওই ম্যাচে ৩২২ রান করে তারা। যেটা বিশ্বকাপ ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানতাড়া করে জেতার রেকর্ড। সেই রেকর্ডটি এবার তিনে নেমে গেল। বিশ্বকাপে দ্বিতীয় এবং বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বোচ্চ রানতাড়ার রেকর্ড ইনিংস হয়ে থাকছে টন্টনের মহাকাব্য।
শুরুর আগে একটি কথার পুনরাবৃত্তি হয়েছে অনেকবার, এবার বিশ্বকাপ হবে রানের বিশ্বকাপ। রান হবে ৩০০-৪০০ হরদম। প্রথমে ব্যাট করা দল ৩৫০ করেও শান্তি পাবে না। পরে ব্যাট করে হেসেখেলেই সে রান পেরিয়ে যাবে প্রতিপক্ষ!
সেই আগাম কথার কিছুটা হলেও ফলেছে। ৪০০ না হলেও প্রথমে ব্যাট করা দলগুলো ৩০০-৩৫০ রান পার করেছে হেসেখেলেই। কেবল পারছিল না পরে ব্যাট করা দলগুলো। ৩০০ রান তাড়া করা যেনো হয়ে উঠছিল দুর্বোধ্য! অবশেষে বাংলাদেশের কল্যাণে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের রংটাই গেল পাল্টে!
ম্যাড়ম্যাড়ে টানা তিন ম্যাচের পর সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে দারুণ এক ম্যাচ উপহার দিয়ে বিশ্বকাপকে জাগিয়ে তুলেছিল বাংলাদেশ। এবার ৩০০’র বেশি রান তাড়ায় কীভাবে ম্যাচ বের করে আনতে হয় সেটাও দেখিয়ে দিলেন সাকিব-লিটনরা।
বড় রান তাড়া করতে যেমনটা দরকার ছিল, তেমন এক শুরুই এনে দেন দুই ওপেনার তামিম ইকবাল-সৌম্য সরকার। প্রথম দুই-তিন ওভার দেখেশুনে খেলার পর শুরু হয় দুজনের আগ্রাসন।
তামিমের চেয়ে একটু বেশিই আগ্রাসী ছিলেন সৌম্য। আত্মবিশ্বাস যোগাচ্ছিল বিশ্বকাপের আগে ত্রিদেশীয় সিরিজটা। সেই সিরিজে ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে ৭৩, ৫৪ ও ৬৬ রানের তিনটি দারুণ ইনিংস ছিল বাঁহাতি ওপেনারের।
তবে আগ্রাসনটা বেশিক্ষণ ধরে রাখতে পারেননি সৌম্য। আট ওভারে স্কোরবোর্ড ৫০ ছোঁয়ার পরই আউট হয়ে যান। আন্দ্রে রাসেলের বুক বরাবর বাউন্সার স্লিপের উপর দিয়ে গলিয়ে খেলতে গিয়ে ক্রিস গেইলের সুন্দর এক ক্যাচের শিকার হন। ফেরার আগে সমান দুটি করে চার ও ছক্কায় ২৩ বলে করেন ২৯ রান।
সৌম্যকে আউট করেই যেন ভুল করে ফেলল উইন্ডিজ। কারণ উইকেটে নেমেই পাল্টা আক্রমণ শানালেন দুই বন্ধু তামিম-সাকিব। সৌম্য আউটের আগপর্যন্ত যেখানে রানরেট ছিল ৬’র একটু বেশি, সাকিব নামার পর সেটা ছাড়িয়ে সাতেরও বেশি।
সাকিবকে অন্যপ্রান্তে রেখে তখন তামিমই আগ্রাসী হলেন বেশি। এর আগে টানা তিন ম্যাচে রান না পাওয়ার জ্বালাটা যেন মেটাতে চাইলেন এই ম্যাচে। জ্বলে উঠে ১৪ ওভারেই বাংলাদেশকে পার করালেন একশো।
টানা চার ম্যাচে ফিফটি পাননি, ক্যারিয়ারে এর আগে একবারই এমন হয়েছে তামিমের। তাই রান পেতে মরিয়া ছিলেন। এগোচ্ছিলেনও ভালোভাবে। ৫৩ বলে ৪৮ করে ক্যারিয়ারে ৪৭তম ফিফটির যখন খুব কাছে বাঁহাতি ওপেনার, তখনই বলের রানআপের সময় দারুণ এক গতির থ্রোতে তার উইকেট ভেঙে দেন শেলডন কটরেল। ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মতো চারের বেশি ম্যাচে ফিফটি ছাড়াই আউট হলেন তামিম!
তামিম ফেরার পর চাঙ্গা হয়ে ওঠে উইন্ডিজ। এক ওভার বাদেই ১ রান করা মুশফিকুর রহিমকে উইকেটরক্ষক শাই হোপের ক্যাচ বানিয়ে বাংলাদেশকে ব্যাকফুটে ঠেলে দেন ওশানে থমাস। রান তখন কেবল ১৩৩।
উইন্ডিজদের সাফল্য সেখানেই শেষ। এরপর লিটন দাসকে সঙ্গী করে ১৮৯ রানের জুটিতে ক্যারিবীয়দের আর মাথা তুলে দাঁড়াতে দিলেন না সাকিব। এদিন যেন তার ব্যাট আবার হয়ে উঠল খোলা তলোয়াড়। প্রতিপক্ষ হয়ে যে বোলারই এসেছেন তাকেই করেছেন ছিন্নভিন্ন।
মাঠের ৩৬০ডিগ্রী জুড়েই ব্যাট চালিয়েছেন সাকিব। মাত্র ৪০ বলে পেয়েছেন ফিফটির দেখা। সেখানে তাকে তো থামানো যায়নি, বরং যত সময় গেছে ততই ক্ষুরধার হয়ে উঠেছে ব্যাট। পরের ৪৫ বলে আরেক ফিফটিতে দেখা পেয়েছেন এই বিশ্বকাপের টানা দ্বিতীয় ও নিজের ক্যারিয়ারের নবম সেঞ্চুরির দেখা। ১২৪ রানের ইনিংসটিতে হয়তো একটা আক্ষেপ থাকতে পারে সাকিবের, ১৬ চার পেলেও একটাও যে ছক্কা পাওয়া হয়নি ম্যাচ সেরা খেলোয়াড়ের।
এই ইনিংস দিয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকের সিংহাসনটা আবারও দখল করলেন সাকিব। ৩৮৪ রানে আসরে সবার উপরে দেশ সেরা অলরাউন্ডার। ৩৪৪ রানে তার পরেই অবস্থান অজি অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ।
সাকিবের কথা বলতে বলতে লিটনের কথাইবা কেন বাদ যাবে? সাকিব যদি হন এই ম্যাচের মূল নায়ক, তবে লিটন পার্শ্বনায়ক। সাকিব যখন ব্যাট চালাচ্ছেন, তখন স্ট্রাইক পরিবর্তন করে তাকে যোগ্য সঙ্গ দিয়ে গেছেন। শুরুতে নিজেকে আটকে রাখলেও পরে হাত খুলেছেন ওপেনার থেকে মিডলঅর্ডার বনে যাওয়া এ ব্যাটসম্যান।
মাত্র ৪৩ বলে তুলে নেন ফিফটিও। শেষ তিন ম্যাচে কিন্তু এটি তার টানা তৃতীয় ফিফটি। শেষপর্যন্ত যখন হাসতে হাসতে মাঠ ছেড়ে বেরচ্ছেন লিটন, তখন নামের পাশে লেখা ৬৯ বলে ৮ চার ও ৪ ছক্কায় ৯৪! ওয়েস্ট ইন্ডিজের রানটা আরেকটু বেশি হলে পেতে পারতেন সেঞ্চুরির দেখাও!
আসলেই উইন্ডিজ যে আরও বেশি রান করতে পারেনি তার জন্য বাংলাদেশের ফিল্ডারদের অবদান কেন স্মরণে নেবেন না? ম্যাচটা যে জিততে চায় টাইগাররা তার নমুনা মিলেছে ফিল্ডিংয়েই। মনে রাখার মতো ফিল্ডিংয়ে অন্তত ৩০টা রান কম দিয়েছেন ফিল্ডাররা।
ধন্যবাদ পেতে পারে ডেথ ওভারে বোলিংও। নইলে শাই হোপ ও শিমরন হেটমায়াররা যেভাবে খেলছিলেন, সাড়ে তিনশো হওয়া অসম্ভব কিছু ছিল না। ২৬ বলে ৫০ করে টাইগার বোলিংয়ের লাগামটা আলগা করে দেন হেটমায়ার। আর মাত্র ৪ রানের জন্য সেঞ্চুরি পাননি হোপ। এই দুজনের সঙ্গে সময়মতো আন্দ্রে রাসেল, জেসন হোল্ডারদের মতো ব্যাটসম্যানদের ফিরিয়ে রান বাড়তে দেননি মোস্তাফিজ, মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনরা।
৫৯ রানে ৩ উইকেট মোস্তাফিজের। ৭২ রানে সমান উইকেট পেয়েছেন সাইফউদ্দিনও। তবে ৭০ রান করা এভিল লুইস ও ২৫ রানে নিকোলাস পুরানকে ফিরিয়ে চাপ ধরে রেখেছিলেন কিন্তু সাকিবই!