চার বছরের অপেক্ষার অবসান। আর মাত্র ১৭ দিন পরেই (১৪ জুন) বিশ্বকাপ ফুটবলের মহাযজ্ঞ বসতে যাচ্ছে রাশিয়ায়। তার আগেই সারাবিশ্বের বইছে ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা। প্রিয়দল ও খেলোয়াড়ের সমর্থন দিতে এদেশের মানুষও বসে নেই।
অন্যদিকে, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বলছে, আগামী ১৬ জুন হতে পারে পবিত্র ঈদুল ফিতর! তার মানে, বিশ্বকাপ ফুটবল ও ঈদ উৎসব একসঙ্গে হতে যাচ্ছে। সারাবছর দুই ঈদকে ব্যবসার ‘সুবর্ণ সময়’ বলে মনে করেন সিনেমার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই। তাই এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলের কারণে ঈদে ছবি ব্যবসায়িকভাবে অনেকটা প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঈদে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’, ‘পোড়ামন ২’, ‘আমার প্রেম আমার প্রিয়া’, ‘পাঙ্কু জামাই’, ‘সুপার হিরো’। এছাড়া ‘ভাইজান এলো রে’ এবং ‘সুলতান’ নামের আরো দুটি কলকাতার ছবি আমদানিতে মুক্তির কথা শোনা যাচ্ছে। এই সাতটি ছবির মধ্যে কয়টি ছবি মুক্তি পাবে সেটি নিয়েও রয়েছে যথেষ্ট সংশয়। তবে যে কয়টায় মুক্তি পাক, বিশ্বকাপ ফুটবলের কারণে ব্যবসায়িকভাবে বিপর্যয় আসতে পারে এসব ছবির ক্ষেত্রে এমনটাই বলছেন চলচ্চিত্রের বাণিজ্য বিশ্লেষকরা। তবে এমন আশঙ্কা খুব বেশি আমলে নিচ্ছে না ‘পোড়ামন ২’ ছবির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার আবদুল আজিজ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, খেলা হবে দেড় ঘণ্টা সময়ে। যারা ছবি দেখার তারা ছবি দেখবেই। তিনি বলেন, প্রথমদিকে কোনো প্রভাব পড়বে আমি মনে করি না। মূল খেলা শুরু হবে নক নক আউট পর্ব থেকে। ঈদের পরে ২১ এবং ২২ তারিখ আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের খেলা রয়েছে। ওই দুদিন কিছুটা প্রভাব পড়তে পারে বলে আমি মনে করি। আর খেলা আছে বলে ছবি মুক্তিতে আর বসে থাকবো না। খেলা খেলার মতো হবে, ছবি মুক্তি থেমে থাকবে না।
ঈদে ছবির মুক্তির তালিকায় প্রথম থেকেই এগিয়ে ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’ ছবিটি। এরই মধ্যে সেন্সর লাভ করেছে খান প্রডাকশন প্রযোজিত ছবিটি। এই ছবির প্রযোজক পিংকি আকতার বলেন, সম্পূর্ণ বিনোদনমূলক ছবি ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’। এমন ছবি ঈদ উৎসবে দর্শকদের জন্য পরিপূর্ণ আনন্দ দিবে বলে আমি মনে করি। তিনি বলেন, বিশ্বকাপ খেলা আমিও দেখবো। আমি মনে করি খেলা এক জিনিস, আর সিনেমা দেখা আরক জিনিস। ভালো ছবি হলে মানুষ অবশ্যই হলে গিয়ে দেখবে।
এদিকে, বুবলী অভিনীত দুই ছবি ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’ ছাড়াও ‘সুপার হিরো’ মুক্তি পাবে বলে শোনা যাচ্ছে। দুই ছবির নায়িকা শবনম বুবলী। জনপ্রিয় নায়িকা মনে করেন, বিশ্বকাপ ফুটবলে ঈদের ছবিতে প্রভাব কিছুটা পড়বেই। চ্যানেল আই অনলাইনকে বুবলী বলেন, প্রভাব পড়লেও আমাদের দেশের মানুষ যেমন খেলাপ্রেমী, তেমনি সিনেমাপ্রেমীও। সেক্ষেত্রে অবশ্যই তারা ঈদের ছবি গুলোও দেখবে বলে আমি মনে করি। সবচেয়ে বড় কথা, বিশ্বকাপ ফুটবলে আমরা যেসব দল সাপোর্ট করি নিজেরা নিজেরা অনেক উত্তেজনায় থাকি তারা তো আর আমাদের নিজের দেশের কিছু না। এমনকি বিশ্বকাপ ফুটবলে যাদেরকে আমরা এভাবে সাপোর্ট করছি তারা হয়তো আমাদের দেশ সম্পর্কে ওভাবে জানেও না। তাই আমার মনে হয় আমাদের দর্শকরা নিজেদের ঈদের আনন্দ উপভোগ করবেন হলে গিয়ে ঈদের ছবি দেখে।
‘পোড়ামন ২’ ছবি দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন ছোটপর্দার তারকা সিয়াম আহমেদ। নবাগত এই নায়ক তার প্রথম ছবি মুক্তির আগেই ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছেন। তিনি মনে করেন, ঈদের সময় বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রভাবে ছবির ব্যবসায় কোনো ক্ষতি হবে না। চ্যানেল আই অনালাইনকে সিয়াম বলেন: বিশ্বকাপ হচ্ছে পুরো পৃথিবীর জন্য একটা আনন্দময় ব্যাপার। আর ঈদ হচ্ছে আমাদের মুসলিম বিশ্বের একটা উৎসব। আমাদের জন্য খুশির ব্যাপার হচ্ছে, আমরা একসঙ্গে ডাবল আনন্দ পেতে যাচ্ছি। তিনি বলেন, বিশ্বকাপে আমাদের দেশ অংশ নিচ্ছে না। এর কারণে আমাদের দেশের ছবির কোনো ক্ষতি হয় এর জন্য আমরাই দায়ি থাকবো। এটার দায় বিশ্বের অন্য কোনো দেশ নেবে না। তাই দেশের জন্য ক্ষতি হয় এমন কিছু নিশ্চয়ই আমরা করবো না।
সিয়াম আরো বলেন, দেশের ছবি আছে এবারের ঈদে। যেটা নিয়ে আমরা সবাই খুব আশাবাদী। বিশ্বকাপ খেলা বেশিরভাগ রাতে। আমি আশা করবো, দেশের ছবি ও দেশের শিল্পীদের উৎসাহ দেয়ার জন্য অবশ্যই হলে গিয়ে যেন ছবি দেখতে যায়। সেটা আমার ছবি হোক কিংবা শাকিব ভাইয়ের ছবি হোক। সিনেমা দেখতে যেন সবাই হলে যায়। আর দেশের ছবি আমাদের দেশের সম্পদ। আমাদের দর্শকরা দেশের সম্পদের ক্ষতি হোক এটা চাইবেন না। বিশ্বকাপের প্রভাবে ঈদের ছবিতে কোনো ক্ষতির আশঙ্কা আমি করছি না।
ঈদের ছবি মুক্তির তালিকায় রয়েছে ‘আমার প্রেম আমার প্রিয়া’। যদি ছবিটি নিশ্চিত মুক্তি পাবে কিনা এখনও বিষয়টি ‘চূড়ান্ত হয়নি’ বলে জানান এই ছবির পরিচালক শামীমুল ইসলাম শামীম। চ্যানেল আই অনলাইনে তিনি জানান, শাকিব খানের একাধিক ছবি মুক্তি পেলে তার ছবি মুক্তি দেবেন না। যদি একটি ছবি মুক্তি পায় শাকিবের, তবে তার ছবি মুক্তি দেবেন। আরো বললেন, ছবি মুক্তি দেয়ার জন্য রেডি আছে। দেখা যাক কি হয়! তারপরেও বিশ্বকাপে কী ঈদের ছবিতে প্রভাব মনে করেন? সবখানেই এখন খেলা নিয়ে আলোচনা চলছে। আমি হাজার পারসেন্ট বিশ্বাস করি বিশ্বকাপের ফলে ঈদের ছবিতে অনেক প্রভাব পড়বে। এমনও হতে পারে সেল অর্ধেকে নেমে আসতে পারে। এটাও চিন্তার বিষয়।
কয়েক যুগ ধরে সিনেমা হল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রাজধানীর মিরপুরের সনি সিনেমা হলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হোসেন। এই বিশ্বকাপের ফলে তিনি ঈদের ছবির ব্যবসা নিয়ে বেশ চিন্তিত। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, যে কোনো খেলায় হলে ছবির ব্যবসায় প্রভাব পড়ে। এমনকি আইপিএল-এর খেলা হলেও প্রভাব পড়ে। আর এটা তো বিশ্বকাপের মতো বিরাট আসর! তবে আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা বলছে, ছবির মান যদি ভালো হয় তবে প্রভাব পড়বে না।
মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ১৯৯৯ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপে আমার প্রযোজিত ও পরিচালিত ছবি ‘রাঙা বউ’ মুক্তি দিয়েছিলাম। বাংলাদেশের হুমায়ূন ফরিদী, আমিন খান, কলকাতার ঋতুপর্ণা ওই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। ছবিটি তখন দুর্দান্ত ব্যবসা করেছিল বিশ্বকাপের মাঝেই। টানা ২৯ শো হাউজফুল ছিল। এর কারণ, ছবির মান ছিল ভালো। খেলার মধ্যেই ছবিটি সুপারহিট হয়েছিল।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির বর্তমান সভাপতি ইফতেখার উদ্দিন নওশদাকে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করে পাওয়া না গেলেও এই বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিয়াঁ আলাউদ্দিন। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, খেলাটা তাৎক্ষণিক। সেজন্য গুরুত্ব থাকবে। ওই সময় দেখা না গেলে পরে আর মজা থাকে না। রিপিট দেখলেও সরাসরি দেখার মজা পাওয়া যায়না। অন্যদিকে ছবির শো থাকবে সপ্তাহব্যাপী। তাই পছন্দের দলের খেলা হলে সেদিন দর্শক আর হলে আসতে চাইবে না।
মিয়াঁ আলাউদ্দিন জানান, তিনি আর্জেন্টিনার সমর্থক। ওইদেশের খেলা হলে জরুরি কাজ না থাকলে তিনি ঘর থেকে বের হন না। তার মতো অনেকেই আছেন, যারা প্রিয় দলের খেলার দিন ওইদিকেই মনোযোগ রাখবেন। কথা প্রসঙ্গে মিয়াঁ আলাউদ্দিন বলেন, ছবির মান যদি ভালো হয়, গান-ট্রেলার দেখে দর্শক যদি ছবি দেখার জন্য মুখিয়ে থাকে তবে তেমন সমস্যা নাও হতে পারে। আমি দেখেছি, কোয়ালিটিফুল ছবি হলে একমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া ছবির ব্যবসা তেমন প্রভাব পড়ে না। চলচ্চিত্রের এই পুরনো ব্যক্তিত্ব আরো বলেন, ইদানিং কিছু মানুষ সামান্য কিছু হলেই হাইকোর্টে যায়। ঈদের সময় যেন বিদেশি খেলা না চলে সেটা বন্ধ করতে তারা কী হাইকোর্টে যাবে? কিংবা পূজা-পার্বন বিভিন্ন উৎসবে বিদেশি খেলা দেখা বন্ধ করতে তারা হাইকোর্টে যাক! কোনো ছুতো পেলেই হাইকোর্ট! এটা কেমন কথা? আমার ব্যবসা আমি কীভাবে, কেমন করে করবো সেটা একান্তই আমার ব্যাপার।
প্রসঙ্গত, ঈদের ছয় ছবির মধ্যে ‘চিটাগাংইয়া পোয়া নোয়াখাইল্লা মাইয়া’, ‘পোড়ামন ২’ দুটি ছবির মুক্তি নিশ্চিত হলেও বাকি চারটি ছবির মুক্তি নিয়ে রয়েছে সংশয়। সরকারের রাজস্ব ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে অনুমতি ছাড়া অবৈধভাবে ‘সুপার হির ‘ ছবির শুটিংয়ের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে, ‘ভাইজান এলো রে’ এবং ‘সুলতান’ নামের দুটি কলকাতার ছবি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশি ছবি দেশে আমদানি কোনো উৎসব উপলক্ষে মুক্তির ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। যার কারণে আমদানি করা ছবি দুটি আসছে ঈদে মুক্তি পাবে কিনা সেটা বলা যাচ্ছে না। ‘আমার প্রেম আমার প্রিয়া’ ছবিটিও মুক্তির জন্য তৈরি থাকলেও নিশ্চিত মুক্তি পাবে কিনা সেটি নিয়ে এখনও দ্বিধায় রয়েছেন ছবির পরিচালক।