ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলসে ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে দশটি দেশ। সবগুলো দেশই সেজন্য দল ঘোষণা করেছে। ৩০মে থেকে শুরু হতে যাওয়া বিশ্বকাপে প্রতিটি দলই তাদের অধিনায়কের ওপর অনেক ভরসা করবে।
১০জন অধিনায়কের মধ্যে মাত্র তিনজন আছেন, যারা আগে দেশ ও দলকে বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০১৫ বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দেয়া বাংলাদেশের মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা, ইংল্যান্ডের ইয়ন মরগান এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের জেসন হোল্ডার এবারও নিজ নিজ দলের কাণ্ডারি। বাকি সাতজনের বিশ্বকাপে অধিনায়কত্বের অভিষেক হতে যাচ্ছে।
দশ অধিনায়কের ওয়ানডেতে তাদের অতীতের রেকর্ড এবং কীভাবে তারা তাদের নিজ নিজ দলকে প্রভাবিত করতে পারেন সেটা দেখার চেষ্টা করেছে বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা- আইসিসি।
মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা (বাংলাদেশ)
দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ সদস্য তিনি। দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশকে বিশ্বকাপে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন মাশরাফী। তার অধীনেই ২০১৫ অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল বাংলাদেশ। তার আগে ইংল্যান্ড, আফগানিস্তান ও স্কটল্যান্ডকে নিয়ে গড়া গ্রুপ ‘এ’ থেকে সেরা হয় টাইগাররা। সেবারই প্রথম বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে যায় বাংলাদেশ। যদিও কোয়ার্টারে ভারতের কাছে হেরে যায়। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপে দলের সবচেয়ে উত্তেজক ১৫ রানের জয়টাও স্মরণীয়। বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মাশরাফী, দলকে ৭৩টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে ৪০টিতে জয় পেয়েছেন।
গুলবাদিন নায়েব (আফগানিস্তান)
শুধু বিশ্বকাপেই অধিনায়কত্বের অভিষেক হচ্ছে না গুলবাদিন নায়েবের, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই প্রথমবারের মতো দলকে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন তিনি। সফল হওয়া সত্ত্বেও সম্প্রতি আফগানিস্তান ক্রিকেট দলের অধিনায়কত্ব হারান আসগর আফগান। তাকে-সহ তিন ফরম্যাটের জন্য তিনজনকে নেতৃত্বের দায়িত্ব দিয়েছে আফগান বোর্ড।
ওয়ানডে দলের অধিনায়ক করা হয় অলরাউন্ডার গুলবাদিন নায়েবকে। অতীতে নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা না থাকা নায়েব তার নতুন ভূমিকা কীভাবে প্রয়োগ করেন সেটা দেখার জন্য মুখিয়ে আছে তার দেশসহ ক্রিকেট বিশ্ব। খেলোয়াড় হিসেবে অবশ্য নিজেকে আগেই প্রমাণ করেছেন নায়েব, ৫২ ওয়ানডে ম্যাচে ৮০৭ রান করার পাশাপাশি ৪০টি উইকেটও নিয়েছেন তিনি।
অ্যারন ফিঞ্চ (অস্ট্রেলিয়া)
২০১৮’র অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক করা হয় অ্যারন ফিঞ্চকে। তারপর থেকে এপর্যন্ত দলকে ১৮টি ওয়ানডে ম্যাচে নেতৃত্ব দিয়েছেন। জয়ের হার ৫৯% সামান্য উপরে। ২০১৮তে সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে একটি ছাড়া বাকি সবগুলো জয় এসেছে চলতি বছর। অধিনায়কত্ব পাওয়ার পর থেকেই ব্যাট হাতে খাবি খেয়েছেন ফিঞ্চ। তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পাকিস্তানের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করা সিরিজে দুটি করে সেঞ্চুরি ও হাফসেঞ্চুরি করেন তিনি।
ইয়ন মরগান (ইংল্যান্ড)
২০১৫ বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্যায় থেকে হৃদয়বিদারক বিদায়ের পর একদিনের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের অসাধারণ রূপান্তর হয়েছে ইয়ন মরগানের তত্ত্বাবধানেই। মরগানের নেতৃত্বে ধীরে ধীরে উন্নতি করেছে ইংলিশরা। আইসিসির সবশেষ আপডেট করা ওয়ানডে র্যাঙ্কিংয়ের একনম্বর দল ইংল্যান্ড। চলতি বছরের বিশ্বকাপে তারাই অন্যতম ফেভারিট। ঘরের মাঠে প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন্স হওয়ার জন্য খেলোয়াড়রাও মুখিয়ে। বিশ্বকাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাওয়াদের পক্ষে সবচেয়ে শক্তিশালী দলেরই কি অধিনায়ক মরগান? এমন প্রশ্নও চারদিকে ঘুরপাক খাচ্ছে। ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়ার পর এপর্যন্ত ৭৬টি ওয়ানডেতে নেতৃত্ব দিয়ে ৫০টিতে জিতেছেন মরগান।
বিরাট কোহলি (ভারত)
মরগানের মতো, বিরাট কোহলিও টুর্নামেন্ট জেতার সম্ভাবনায় পছন্দের অন্যতম একজন অধিনায়ক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোহলির নেতৃত্বে উন্নতি হচ্ছে। তিনি যখন বিশ্বকাপে দলকে নেতৃত্ব দিতে নামবেন, তখন নামের পাশে ওয়ানডেতে ৭৩.৮৮% সফলতার গল্প লেখা থাকবে। কোহলির অধীনে ৬৮ ওয়ানডে খেলে ভারত জয় পেয়েছে ৪৯টিতে। তার অধীনেই ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে উঠেছিল ভারত। সেখানে লডর্সের ফাইনালে অবশ্য চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের কাছে হেরে যায় তারা। বিশ্বকাপে অধিনায়ক হিসেবে অভিষেকের পাশাপাশি পুরো টুর্নামেন্টের অন্যতম নজরে থাকা খেলোয়াড়ও হতে যাচ্ছেন কোহলি।
কেন উইলিয়ামসন (নিউজিল্যান্ড)
২০১৫ বিশ্বকাপের রানার্সআপ দলের সদস্য নিউজিল্যান্ডের বর্তমান অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। নিজেদের ইতিহাসে সেবারই প্রথম বিশ্বকাপ ফাইনালে উঠেছিল কিউইরা। কিন্তু ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে শিরোপা বিসর্জন দিতে হয় তাদের।
ব্রেন্ডন ম্যাককালামের অধীনে বেড়ে ওঠা উইলিয়ামসন নিজেই অধিনায়কত্বে এক বিশাল ভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে এসেছেন। শান্ত এবং ধীরস্থির উইলিয়ামসন ব্যাটিং ও অধিনায়কত্ব উভয় দিকেই প্রশ্নাতীতভাবে নিজের ধার দেখিয়েছেন। উইলিয়ামসন নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপে সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন। বিশ্বকাপে মাঠে নামার আগে ওয়ানডে ক্রিকেটে অধিনায়কত্বে তার সফলতার হার ৫৩.৯৬%।
সরফরাজ আহমেদ (পাকিস্তান)
২০১৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা জয়ের সময়কার অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালের একইস্থান থেকে বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দেবেন। তিনি নিশ্চিতভাবেই অধিনায়ক হিসেবে ট্র্যাক রেকর্ডের মালিক। ৩৫টি ওয়ানডেতে তার নেতৃত্বে পাকিস্তান জিতেছে ২১টিতে। জয়ের হার ৬১.৭৬। বিশ্বকাপের সময় অধিনায়ক হিসেবে, মিডলঅর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে এবং উইকেটরক্ষক হিসেবে পাকিস্তানের জন্য সরফরাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।
ফ্যাফ ডু প্লেসিস (সাউথ আফ্রিকা)
সহজেই বলা হয়, এই তালিকায় সর্বাধিক সফল অধিনায়ক ফ্যাফ ডু প্লেসিস। নেতা হিসেবে দুর্দান্ত সাফল্য লাভ করেছেন, ৩০টি ওয়ানডেতে তিনি অধিনায়কত্ব করেছেন, তার মধ্যে সাউথ আফ্রিকা মাত্র পাঁচটি হেরেছে। সফলতার হার চোখে পড়ার মতো, ৮৩.৩৩ শতাংশ। ২০১৮ সালে ডু প্লেসিস অধিনায়কত্ব শুরু করার পর ছয়টি দ্বি-পাক্ষিক সিরিজের মধ্যে মাত্র একটিতে হেরেছে প্রোটিয়ারা। মিডলঅর্ডারের এ স্টাইলিশ ব্যাটসম্যানের ওয়ানডেতে গড় ৪৬.৫৪। নিজেকে দলের টপ-অর্ডারে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
দিমুথ করুনারত্নে (শ্রীলঙ্কা)
গত অক্টোবরেও দলের অধিনায়ক ছিলেন দিনেশ চান্দিমাল। অল্প কয়েকদিন আগে দলের হয়ে ওয়ানডে খেলেছেন উপুল থারাঙ্গা। কিন্তু তাদের বাইরে রেখেই ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের জন্য দল ঘোষণা করে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড (এসএলসি)। দলে জায়গা হয়নি সাম্প্রতিক সময়ে খেলা উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান নিরোশান ডিকেভেল্লা, অফস্পিনার আকিলা ধনঞ্জয়া, ওপেনার ধানুস্কা গুনাথিলাকারও। ফলে এদের সার্ভিস মিস করবে লঙ্কানরা।
১৯৯৬ বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নদের এবার নেতৃত্ব দেবেন দিমুথ করুনারত্নে। যিনি সর্বশেষ ওয়ানডে খেলেছেন ২০১৫’র মার্চে, মানে অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপেরও আগে। তার নেতৃত্বে অবশ্য সম্প্রতি সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে ২-০তে ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজ জিতেছে শ্রীলঙ্কা। তবে ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবে এখনো খাতা খোলেননি। ব্যাটসম্যান হিসেবে করুনারত্নে টেকনিক্যাল, তবে পরিসংখ্যান খুব একটা তার পক্ষে নয়। ১৭ ওয়ানডেতে ১৬’র কম গড়ে রান করেছেন ১৯০।
জেসন হোল্ডার (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)
১৯৭৫ ও ১৯৭৯ বিশ্বকাপের প্রথম দুটি আসরেই চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তাদের বর্তমান অধিনায়ক সেই মানুষটির কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন যার নেতৃত্বে দুবার এই ট্রফি জিতেছে ক্যারিবীয়রা। তিনি ক্লাইভ লয়েড। এবারের বিশ্বকাপের ফাইনাল হবে লডর্সে। কিছুদিন আগে লয়েডের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে হোল্ডার বলেছেন, ক্রিকেটের ‘তীর্থ স্থানে’ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে চান।
২৭ বছরের হোল্ডার এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে কমবয়সী অধিনায়ক হিসেবে দলকে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির পথে অভিজ্ঞ ও তরুণদের নিয়ে গড়া একটা দল পেয়েছেন তিনি। যদিও ২০১৪ সাল থেকে কোনো দ্বি-পাক্ষিক সিরিজ জিততে পারেনি ক্যারিবীয়রা। সবশেষ ইংল্যান্ডের বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজ ২-২এ অমীংসিতভাবে শেষ করে। বিশ্বকাপের আগে স্বাগতিক দেশের বিপক্ষে পাওয়া এই সাফল্য নিয়েই বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু করতে চায় গ্যারি সোবার্স-ভিভ রিচার্ডসের দেশ।