বিরোধের সংঘর্ষকামীতা ক্রমশ গ্রাস করে চলেছে সর্বশ্রেনীর মানুষের নিরাপত্তা । ধর্মের সাথে ধর্মের, দলের সাথে দলের, পেশাজীবীর সাথে পেশাজীবীর, মালিকের সাথে মজুরের বিরোধ ছাপিয়ে এখন ঘনীভূত হচ্ছে স্ব স্ব ধর্মের,স্ব স্ব দলের,স্ব স্ব পেশাজীবীর, স্ব স্ব মালিকের, স্বস্ব শ্রমিকের, স্ব স্ব সাংবাদিক, লেখক, শিক্ষক ও ছাত্রদের নিজেদের মাঝে দ্বন্দ্ব। রয়েছে পীরের সাথে পীর,আলেমের সাথে আলেম, জালেমের সাথে জালেম, চাঁদাবাজের সাথে চাঁদাবাজ, ডাকাতের সাথে ডাকাত। বিরোধ রয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সাথে মুক্তিযোদ্ধার, কবির সাথে কবির, সুশীলের সাথে সুশীলের। বিরোধ চলছে সংখ্যাগুরুর সাথে সংখ্যালঘুর। আরও আছে সংখ্যালঘুর সাথে সংখ্যালঘুর বিরোধও। আইনশৃংখলা বাহিনীতেও রয়েছে বিরোধের সংক্রমন যেমন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিডিআর, পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশ (যেমন বাংলাদেশে সাধারন পুলিশ ও বিশেষ পুলিশ বাহিনীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্য)।
এক কথায় এক ভয়াবহ সংক্রামক ব্যাধির মতো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে বিরোধ। এই বিরোধে বিরোধময় হয়ে খসে যাচ্ছে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা।
ব্রাহ্মনবাড়িয়ার নাসির নগরে ঘটেছে সাম্প্রদায়িক হামলা। এই হামলা নিয়ে সংখ্যালঘুদের মধ্যেও দেখা গেছে বিরোধ। একপক্ষ বলছে, মন্ত্রী মালাউন বলেছে। আরেক পক্ষ বলেছে, মালাউন বলেনি। সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সুন্নী-ওহাবী দ্বন্দ্ব চালু রয়েছে। দুই মতবাদ পন্থীদের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষের খবরও পাওয়া যায়। চরমোনাইয়ের পীর ও দেওয়ান বাগীর পীরের অনুসারী কর্তৃক পাল্টাপাল্টি বিরোধে খোদ জাতীয় মসজিদের সামনে রক্তাক্ত সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। অথচ দুই পীরই ইসলাম ধর্মের অনুসারী ও বিশেষজ্ঞ দাবীদার।
চট্টগ্রামে ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ হত্যায় আরেক ছাত্র লীগ নেতার সম্পৃক্ততা ছাত্রলীগের সাথে ছাত্রলীগের বিরোধের উজ্জ্বল দৃষ্ঠান্ত। জাসদের সাথে জাসদের দন্দ্বের সর্বশেষ দৃষ্টান্ত জাসদ ইনু-শিরিন ও জাসদ আম্বিয়া-প্রধান হওয়া। দুই পার্টির নাম এক ও রাজনৈতিক অবস্থানের দিক থেকেও বর্তমানের ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের অনুসারী। বিএনপির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের বিরোধ যেমন রয়েছে তেমনই আওয়ামী লীগের সাথে আওয়ামী লীগের বিরোধও রয়েছে।
সম্প্রতি নেত্রকোনায় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এনেছে জেলা আওয়ামী লীগেরই সাবেক সভাপতি আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুজ্জোহা। এনিয়ে চলছে পাল্টাপাল্টি প্রচারণা। পত্রপত্রিকায় তা ফলাও করে প্রচার হচ্ছে। বিরোধের এই দ্বিপক্ষীয়তা ছাড়াও রয়েছে আরও একটি পক্ষ। সে পক্ষটি বলছে শামসুজ্জোহা যখন জেলা সভাপতি ছিলেন তখন আজকের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত মতিউর রহমান খান ছিলেন জেলা সহ সভাপতি,তখন কেন এই প্রশ্নটা আসলো না? এরকম অসংখ্য বিরোধে ছেয়ে আছে আমাদের রাজনীতি,সংস্কৃতি,সাংবাদিকতা ও সামাজিকতা।
নেত্রকোনার কবি নির্মলেন্দু গুন বিরোধে জড়ালেন একই এলাকার আরেক কবি হেলাল হাফিজের সাথে। কবি নির্মলেন্দু গুন বলছেন, কবি হেলাল হাফিজ জিয়াকে বন্দনা করে গান রচনা করেছেন। হেলাল হাফিজ বলছেন, লিখেন নি। প্রয়াত কবি হুমায়ুন আজাদ উপন্যাসিক হুমায়ুন আহমেদকে ব্যাঙ্গ করে বলতেন অপন্যাসিক। আরেক লেখক আহমদ ছফার সাথে তুমুল বাকযুদ্ধ হয়েছে লেখক হুমায়ুন আজাদের। দুই লেখকের ছবি দিয়ে তৎকালীন সংবাদপত্র গুলো তাদের বিরোধ ফলাও করে প্রচার করেছে।
শুধু তা-ই নয় অন্যান্য কবি লেখকদের মাঝেও বিরোধ রয়েছে। শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছে স্বীকৃত বিরোধ। সাদা দল, নীল দল নাম দিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে নির্বাচনও করছে তারা। শিক্ষকদের মধ্যে কেউ জাতীয়তাবাদী, জামাতী তথা সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহায়ক হতে চায় কেউ অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও আওয়ামী রাজনীতির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহায়ক হতে চায়। তারই উদাহরন হিসেবে আমরা দেখি বিএনপির শাসনামলে বিএনপি পন্থী শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তার ভিসি পদ চলে যায়। তার স্থলে আওয়ামী পন্থী শিক্ষক নতুন ভিসি হিসাবে নিয়োগ লাভ করে।
সাংবাদিকদের সংগঠন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি নিয়েও তাই। যেমন জাতীয় প্রেসক্লাবের বিএনপিপন্থী সাংবাদিক সাবেক সভাপতি আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীন আমলে পদ হারিয়েছেন ও জেলে গমন করেছেন। কারন সাংবাদিকদের মধেও রয়েছে দুই ধরনের সংগঠন কেউ সরকার পন্থী, কেউ সরকার বিরোধী পন্থী। সুশীলদের মধ্যেও রয়েছে বিরোধ। যেমন একদিকে ফরহাদ মজহার, শফিক রেহমান, এমাজ উদ্দীন ও অন্যদিকে আব্দুল গাফফার চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসীর মামুন প্রমুখ।
বিরোধ রয়েছে বামদের মধ্যে ও বিরোধ রয়েছে ধর্মপন্থী ও ধর্মবিরোধী মহলেও। যেমন চীনপন্থী বাম ও সোভিয়েতপন্থী বাম আমরা দেখেছি। আরও দেখেছি দুই সমাজতান্ত্রিক দেশের বিরোধ। সে বিরোধের জেরে বাংলাদেশের বামদের মধ্যেও বিরোধ দেখা দেয়। বড় দল ছোট দল উভয় শিবিরেই সমানতালে ঘরে বাইরে বিরোধ বিরাজমান। যেমন বাংলাদেশে ওয়ার্কার্স পার্টি একদিকে সিপিবি একদিকে।
বড় দল বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার একসময় সাধারন সম্পাদক ছিলেন কেএম ওবায়দুর রহমান। পরবর্তিতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পৃথক বিএনপি গঠন করেন তিনি। সেই বিরোধের জের এখনো আছে। তার স্ত্রী শাহেদা ওবায়েদ আসল বিএনপি দাবী করা সংগঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বেশ কয়েকবার আসল বিএনপি দাবী করা দলটি খালেদার বিএনপি কার্যালয় দখল করার চেষ্টাও করেছেন।
যারা আইন বিশেষজ্ঞ তাদের মাঝেও আছে বিরোধ। আইনজীবীরা আদালত প্রাঙ্গনে সংঘর্ষেও লিপ্ত হয়। বিরোধের কারন কারও সরকারের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহায়ক হতে চাওয়া, কারও সরকার বিরোধীদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সহায়ক হতে চাওয়া। বিচারের রায়ে কোন অপরাধীর সাজা হলে কোন আইনজীবী বলে ন্যায্য বিচার হয়েছে কোন আইনজীবী বলে ন্যায্য হয়নি।
এছাড়াও রয়েছে অপরাধী ও সন্ত্রাসীর সাথে অপর অপরাধী ও সন্ত্রাসীর বিরোধ। ঘটছে এক সন্ত্রাসী কর্তৃক অপর সন্ত্রাসী খুনের ঘটনা। ভাগবাঁটোয়ারার দ্বন্দ্বে, আধিপত্য হারানোর ভয়ে এক সন্ত্রাসী আরেক সন্ত্রাসীকে হত্যা করে থাকে। সন্ত্রাসের ভয়াবহতায় বিভিন্ন জায়গায় গড়ে উঠছে সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠনের বাস্তবতা।
ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা, সাম্প্রদায়িক বিরোধ দূর করতে গড়ে ওঠা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্ঠান ঐক্য পরিষদ গঠনের বাস্তবতা সংখ্যাগুরুর সংখ্যালঘু পীড়নের প্রমানিত সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে। সব সংখ্যালঘুরা মিলে তারা মোকাবেলা করতে চাচ্ছে প্রবল সংখ্যাগুরুকে। হিন্দু,বৌদ্ধ খ্রীষ্ঠান ঐক্য পরিষদে মুসলমানের উপস্থিতি কেন নয়? মায়ানমারে সংখ্যাগুরু বৌদ্ধরা সংখ্যালঘূ মুসলমানদের যে নির্যাতন করছে সে ব্যাপারে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের কী বক্তব্য। তারা কী মায়ানমারের মুসলিম নিধন বন্ধে কোন কার্যকর কর্মসূচি দিয়েছে? যদি কেউ এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে মুসলমান, ইহুূদী, জৈন ঐক্য পরিষদ গঠন করে সেটা কি অযৌক্তিক হবে?
বিরোধে বিরোধময় দেশগুলোতে যতো বিরোধ আছে কোন বিরোধই দূর করা সম্ভব নয়। বিরোধ আছে বিরোধ থাকুক, এগুলো অবসানের চেষ্টার প্রয়োজন নয়, প্রয়োজন বিরোধ হতে সহিংসতা ও রক্তারক্তির প্রবৃত্তির অপসারন। সকল বিরোধ হবে শান্তিপূর্ন। যারা শান্তিপূর্ন বসবাসের অবস্থান ভঙ্গ করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ গড়তে হবে। না হয় বিরোধে বিরোধময় চারদিকে রক্তপাত বাড়ছে যে তা আরও বাড়তেই থাকবে।
তাই বিরোধের ভয়ারন্যে ভয়ার্ত মানুষদের ভয় কাটাতে জরুরি প্রয়োজন বিরোধ নয় বিরোধে সকল ধরনের সহিংসতাকে নিষিদ্ধ করা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)