বাংলাদেশের পল্লব-শায়লা জুটিকে নিয়ে উধাও প্লেন রহস্যের অবসান হয়েছে। বিলম্বে হলেও নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছেছেন তারা। ভ্রমণ বিড়ম্বনায় এই জুটি নিজের অজান্তে এক ট্রিপেই সাত এয়ারপোর্ট, ছয় ফ্লাইট, চার হোটেল ও তিন এয়ারলাইন্স ব্যবহারের রেকর্ড গড়েছেন।
বাংলাদেশের পল্লব-শায়লার অপ্রত্যাশিত দীর্ঘ ভ্রমণকে ‘দুনিয়াজোড়া রোমাঞ্চকর মধুচন্দ্রিমা’ নাম দিয়ে ফেসবুক ওয়ালে পোস্ট দিয়েছেন পল্লবের বাবা সাংবাদিক মাহমুদ হাফিজ।
ফেসবুকে ওই দম্পতির ছবিসহ মাহমুদ লিখেছেন, ‘আকাশে বিমান বিপত্তির জের ধরে পরিবারের দুই আমেরিকাগামীর ভ্রমণ বিপর্যয়ে আমাদের ৭২ ঘন্টার শাসরুদ্ধকর উদ্বেগ-উৎকন্ঠার অবসান হয়েছে। আজ বুধবার বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে নয়টায় পরিবারের দুই সন্তান পল্লব মাহমুদ ও শায়লা জেরিন অর্ধদুনিয়া ঘুরে তাদের গন্তব্য অরেগন রাজ্যের ইউজিন শহরে অবতরণ করেছে।
২০ ঘন্টার ভ্রমণযাত্রা পথে পথে বিড়ম্বনায় সাড়ে ৭২ ঘন্টা প্রলম্বিত হয়। এই সময়ের বেশিরভাগ কেটেছে আকাশে আকাশে। দিনরাত উড়তে হয়েছে তিন এয়ারলা্ইন্সের অন্তত ছয়টি আলাদা বিমানে, অতিক্রম করতে হয়েছে সাতটি বিমানবন্দর।
এরা নববিবাহিত। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার ঘোর কাটার আগেই শুরু হয়েছিল তাদের দূরযাত্রা। থ্যাংক গড, এই বিমান বিড়ম্বনা কার্যত দুনিয়াজোড়া রোমাঞ্চকর মধুচন্দ্রিমায় পরিণত হয়ে গেছে। ধন্যবাদার্হ চীনের গুয়াংজুপ্রবাসী আশরাফ জিয়াউদ্দিন, সানফ্রান্সিসকোপ্রবাসী কবি আতিয়ার রহমান ও ভাবী শাহানা রহমান। আশরাফ জিয়াউদ্দিন বিমান ও নিখোঁজ দুই যাত্রীর প্রথম খোঁজ দিয়ে আমাদের রুদ্ধশ্বাস অবস্থার খানিকটা বিরতির ব্যবস্থা করেছিলেন, যা ছিল সে সময়ে মহার্ঘ। আতিয়ার রহমান দম্পতি ভ্রমণক্লান্ত নবদম্পতিকে বিমানবন্দরে ফ্লাইটের বিরক্তিকর প্রতীক্ষা করার সুযোগ দেননি, স্নেহ ও মমতামাখানো ভালবাসায় আগলে তাদের ভ্রমণক্লান্তি ছুঁড়ে দিয়েছেন সানফ্রান্সিসকো শহরের নয়নজুড়ানো পর্যটনস্পটে। এখানেই শেষ নয় বাসায় নিয়ে দশ পদের প্রিয় খাবার খাইয়ে পেছনে ফেলে আসা মমতাময় আপনজনের অভাবই ভুলিয়ে দিয়েছেন।
সাড়ে বাহাত্তর ঘন্টার রোমহর্ষক পরিস্থিতির শুরু হয়েছিল ২০ সেপ্টেম্বর রবিবার সকাল নয়টায়। এদিন সকালে আমাদের কান্নাকলরোলের মধ্যে নববিবাহিত দুই সন্তান যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে চীনের গুয়াংজুগামী বিমানে ওঠে। দুপুর বারোটায় ছেড়ে বিমানটির গুয়াংজু নামার কথা বিকাল সাড়ে পাঁচটায়। লাইভ ওয়েবসাইটে গুয়াংজু অবধি বিমানটির খোঁজ থাকলেও চীনের আকাশে আকস্মিকই তা হদিসহীন হয়ে যায়। রাডারে এটা ধরা না পড়ায় আমরা থেকে যাই অন্ধকারে। এমনকি খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গুয়াংজুতে বিমান নামেনি, নির্ধারিত হোটেলে চেক ইন করেনি দু’ যাত্রী। পড়ে যাই সীমাহীন উৎকন্ঠায়। বার বার ফোন করেও ভাষা জটিলতায় চীনা বিমানবন্দর বা হোটেল কর্মীদের কাছ থেকে কোন তথ্যই উদ্ধার করা যায়নি। পরে বন্ধু আরিফ জিয়াউদ্দিনের অগ্রজ গুয়াংজুপ্রবাসী আশরাফ জিয়াউদ্দিনের মাধ্যমে রাতে পাহাড়ি শহর গুইলিনের বিমানবন্দরে অবতরণের তথ্য মেলে। গভীর রাতে গুইলিন থেকে ফোন আসে। জরুরী অবতরণ পরিস্থিতির পর জানা যায় পরদিন সোমবার সকালে যাত্রীদের গুয়াংজু নিয়ে আসা হবে অন্য ফ্লাইটে। যাত্রীদের কানেক্টিং ফ্লাইট ধরতে অসুবিধা হবে না।
এরকম পরিস্থিতিতে বিমানবন্দর, এয়ারলাইন্স ও সংশ্লিষ্টরা যে বিশেষ য্ত্ন নিয়ে থাকে, এখানে তার অভাব ছাড়াও বিমানবন্দরে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসাসহ পাসপোর্ট বুঝতেই ঘন্টা পার করে দেয়া হয়েছে। এতে পল্লব-শায়লা সানফ্রান্সিসকোগামী নির্ধারিত ফ্লাইট আর ধরতে না পারলে নতুন সমস্যা তৈরি হয়।
পুরো ভ্রমণলিংকে সানফ্রান্সিসকো থেকে পোর্টল্যান্ডগামী ফ্লাইট, পোর্টল্যান্ডে একদিন বেড়ানো, হোটেলে থাকা, পরদিন গাড়িতে ইউজিন ট্রান্সফার অগ্রিম বুক করা ছিল। বিপর্যয়ে সবকিছু বাতিল হয়ে যাবে বলে দুই ভ্রমণকারীর সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেয় সানফ্রান্সিসকো থেকে তাদের গন্তব্যের টিকেট। বিমানযাত্রায় টিকেটাদি সবসময় অগ্রিম বুকিং হয়, ব্যতিক্রম ছাড়া সাথে সাথে কিছুই পাওয়া যায় না। আল্লাহ সহায়, গুয়াংজু’র হোটেল থেকেই ল্যাপটপে পল্লব উচ্চমূল্যে আলাস্কা এয়ারলাইন্সের দুটি টিকেট যোগাড় করতে সক্ষম হয়। পোর্টল্যান্ডে লে ওভারের পরিকল্পনা বাদ রেখে সেখান থেকে ইউজিনের কানেক্টিং ফ্লাইটে টিকেট নিশ্চিত করে।
এদিকে গুয়াংজুতে বিমানকর্মীদের সঙ্গে দরকষাকাষি করলে পল্লব-শায়লাকে দিনমান গুয়াংজুতে হোটেল রেখে তারা রাত পৌণে দুইটায় নিউইয়র্কগামী ফ্লাইটে আসন বরাদ্দ করতে বাধ্য হয়। নিউইয়র্ক থেকে সানফ্রান্সিসকোর কানেকশন দেয়া হয় ডেল্টা এয়ারলাই্ন্সে। শুরু হয় তাদের দীর্ঘ আকাশযাত্রা। প্রথমে পনেরো ঘন্টার উড়ালশেষে মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বিকাল চারটায় নিউইয়র্কের জেএফকে বিমানবন্দরে পৌঁছায়। চারঘন্টা বিরতি বাদে আবার সাড়ে ছয়ঘন্টার জন্য যাত্রা শুরু করে সানফ্রান্সিসকোমুখো।
শিউড়ে উঠলাম এই ভেবে যে, ডেল্টার এই যাত্রাও তাদের জন্য শেষ নয়, এরপরও বিমানবন্দরে পাঁচঘন্টা বিরক্তিকর সময় কাটিয়ে তাদের আলাস্কা এয়ারলাইন্সের দেড়-দু-ঘন্টা ফ্লাইটে যেতে হবে পোর্টল্যান্ড। সেখান থেকে ঘন্টাকাল বাদে একঘন্টার ফ্লাইটে উড়াল দিতে হবে ইউজিনে।
সন্তানদের এই দীর্ঘভ্রমণ বিড়্ম্বনায় তাদের ক্লান্ত, উদ্বিগ্ন, বিধ্বস্ত ও চিন্তিত চেহারাই আমাদের মনে ভেসে উঠছিল। রোমহর্ষক ও উদ্বেগাকুল পরিস্থিতির মধ্যে কাটছিল এর সঙ্গে যুক্ত সকলের। দিন পেরিয়ে আসছিল নির্ঘুম, ক্লান্তিকর, উদ্বেগাকুল রাত। নাওয়া-খাওয়া-ঘুমের ঠিক ছিল না কারও। আজ বুধবার সকাল সাড়ে নয়টায় সাড়ে বাহাত্তর ঘন্টা পর তাদের ইউজিন পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত আমাদের সকল কাজের কেন্দ্রে ছিল দোঁহের ভ্রমণযাত্রা।
সকল উদ্বেগ-দুশ্চিন্তার অবসানে বিমান বিপত্তি-বিভ্রাটকে নবদম্পতির রোমাঞ্চর মধুচন্দ্রিমা বলে ধরে নিলেও আমরা জানি না, কিভাবে কেটেছে ২০ সেপ্টেম্বর রবিবার থেকে গত তিন দিন তিন রাত। যাত্রাপথে দুয়েকটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি পাঠিয়ে দু’জন আমাদের প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করে গেলেও পিতা-মাতা-আত্মীয়-বন্ধুদের মন বলে কথা।
দুই ট্রাভেল ভিক্টিম আর বেশি কষ্ট পাক তা চাইনি। পল্লব ও শায়লা জেএফকে থেকে ফ্লাই করেছে….সানফ্রান্সিসকো অবতরণের পর তাদের বিড়ম্বনা ও ক্লান্তিকর ভ্রমণকে কিভাবে মধুচন্দ্রিমায় রুপান্তর করা যায় তা ভাবছিলাম। মনে এলো, সে শহরের প্রবাসী বন্ধু আতিয়ার রহমান লাবুর কথা। তিনদশক আগে কুষ্টিয়া থেকে যখন নানা কিশোর সংকলন বের করতাম, তখন লাবু বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ থেকে লেখালেখি করতেন। ছড়া-কবিতা লেখার হাত তার কিশোর বয়স থেকেই। আমার সংকলনে তার লেখা প্রকাশ হওয়া ছাড়াও ঢাকার পত্রপত্রিকায় আমরা একসঙ্গে লেখালেখি করেছি দীর্ঘদিন। সাহিত্যসভা, কবিতাপাঠের অনুষ্ঠানাদিতে একসঙ্গে ঘুরে বেরিয়েছি ঢাকার এ মাথা ও মাথা। লেখাপড়া শেষ করে একদিন অজান্তেই ইউরোপ পাড়ি জমান লাবু, পরে সানফ্রান্সিসকোয় থিতু হয়ে যান। ফেসবুকের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া এই গুণীর সঙ্গে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব নবায়ন হয় গত ফেব্রুয়ারির বইমেলায়। সাহিত্যপ্রাণ লাবু বইমেলায় আডডা দিতে এসে তাঁর কাব্যগ্রন্থ উপহার দেন। প্রেসক্লাবে একদিন আড্ডা দিয়ে তাকেও আমার ভ্রমণগদ্যের বই উপহার দিই। বন্ধু অন্ত:প্রাণ ও সদা-উজ্জীবিত লাবুর কাছে পুরো বিষয়টা পারতেই লুফে নেন এবং স্ত্রী শাহানা রহমানকে এর সঙ্গে যুক্ত করেন।
পরিকল্পনামতে প্রবাসীবন্ধুকে জানিয়ে দিলাম পল্লব-শায়লা’র অবতরণসময় ও ফ্লাইট নম্বর। নির্ধারিত সময়ে তিনি তার নতুন গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরে হাজির। ভ্রমণক্লান্ত দম্পতিকে অভিভাবকত্বের স্নেহে আগলে নিয়েই তিনি ড্রাইভ করে ছুটলেন গোল্ডেন গেট পার্ক, গোল্ডেন গেট ব্রিজ অভিমুখে। বাসায় স্ত্রী শাহানা রহমান নতুন অতিথিদের জন্য সপ্তব্যঞ্জন রন্ধনে ব্যস্ত। তিন ছেলে আনক, আদন ও আকর স্কুল থেকে ফিরে নতুন অতিথিদের আগমণের অপেক্ষায় উত্তেজিত। সানফ্রান্সিসকোর পর্যটন স্পট মেরিনা, রাশান হিল, বে ব্রিজ, ফিশারম্যান হার্ফ, আলমেদা আইল্যান্ড, ক্রুক স্ট্রিট হয়ে আতিয়ার রহমান যখন আলমেদা দ্বীপের ক্লিনটন এভিনিউ’র বাসায় এলেন, খাবার টেবিলে তখন সদ্য ধোঁয়া ওঠা পোলাও, বিফ ভুনা, চিংড়ি ভুনা, চিকেন ফ্রাই, মিক্সড ভেজিটেবল, শুঁটকির বড়া, ফিশ কারি, বেগুন চপ, গ্রিন সালাদ সার্ভ করা হয়েছে। অল্পসময়ের মধ্যে নবদম্পতির প্রিয় দশপদ রান্না করে পরিবেশনের জন্য শাহানা রহমানকে শুধু তারিফ করা বেমানান। পারিবারিকভোজন শেষে ছবি-সেলফি তোলার পর পল্লব-শায়লাকে যখন আলাস্কার ফ্লাইট ধরাতে আতিয়ার রহমান লাবু গাড়িতে উঠিয়েছেন, তখন তারা ছিল অনেকটাই নির্ভার। দীর্ঘ ভ্রমণবিভ্রাটের মাঝের কয়েকঘন্টার সানফ্রান্সিসকো ট্রিপ তাদের জীবনের জন্য হয়ে রইল স্মরণীয়, তৃপ্তিকর ও স্বপ্নময়’।