বরিশালের বানারীপাড়ার একটি গ্রাম। ছলিম মিয়া নিজের ছোট ঘরে বসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দুদিন পরে ঢাকা চলে যাবেন। গত ৪ বছর ধরে সে তার তিন ছেলেসহ ঢাকায় একটি বস্তিতে থেকে রিক্সা চালিয়ে জীবন অতিবাহিত করছেন। দুবছর পর এবার গ্রামের বাড়ি এলেন। সবাই মিয়ে ২০ হাজার টাকায় ছোট একটি গরুও কোরবানি দিয়েছেন। হঠাৎ করে ছোট ছেলেটি দৌড়ে বাসায় ঢ়ুকে বলে, ‘আব্বা সব শেষ হইয়া গেলো আগুনে।’ ছলিম মিয়া কিছুই বুঝতে পারেনা। কোথায় আগুন কি শেষ হইছে।
ছেলে বিলাপ করতে করতে বলে, ‘বাবা টেলিভিশনে দেখাইতেছে আমগো ঢাকার বস্তিতে আগুন। শেষ হইয়া গেলো। আমরা কই গিয়া থাকমো?’
ছলিম মিয়া ছেলেকে নিয়ে মোড়ের চায়ের দোকানে গেলো। ততক্ষণে সেখানে অনেক লোক জড়ো হয়ে টেলিভিশনের লাইভ দেখছে। দাও দাও করে জ্বলছে মিরপুরের রূপনগরের চলন্তিকা বস্তি।
মিরপুরের চলন্তিকা স্থানটি ৬ ও ৭ নং সেক্টরের মাঝামাঝি। এক সময়ের রূপনগর এখন চেনার উপায় নেই। অনেক সুন্দর বিল্ডিং হয়েছে। চলন্তিকা বস্তির একদিকে কয়েকটি গার্মেন্টস। আছে বঙ্গবন্ধু স্কুল, আছে মসজিদ। বস্তি উত্তর দিকে বিস্তৃত রূপনগরের শেষ মাথা পর্যন্ত। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে রক্ষা পায়নি মসজিদও। ঝড় উঠলে যে দেবালয়ও রক্ষা পায় না তার যেনো অগ্নিসাক্ষী দিচ্ছে এই মসজিদ।
স্থানীয় সংসদ সদস্যের হিসাব মতে, এখানে ৪ থেকে ৫ হাজার ঘর ছিলো। কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষ থাকতো। আগুন দেখে তিনি এতটাই হতভম্ব যে তিনি বললেন, মুক্তিযুদ্ধের পর এমন আগুন তার দেখা হয়নি।
এ সময় বস্তির মানুষরা ছলিম মিয়ার মতো নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে ঈদের আনন্দ করছিলো। ছলিম মিয়ার মতো যারা এই বস্তির বাসিন্দা। আগুনের শিখা টেলিভিশনে দেখে তাদের কোরবানী আনন্দ মুহূর্তেই পরিণত আগামীর দুশ্চিন্তায়। ছুটি শেষে ঢাকার কোথায় থাকতে যাবে তারা।
ঢাকার আগারগাঁওয়ে একসময় বিশাল এলাকা জুড়ে ছিলো বিএনপি বস্তি। কেনো যে এর এমন নাম হয়েছিলো, তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারতো না। তবে বলাবলি ছিলো, বিএনপির ক্ষমতাকালে ঐ দলের সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য ছিলো এই বস্তি। ৫ বছর আগে প্রায় প্রায়ই এখানে আগুন লাগতো। টেলিভিশনগুলো ঝাঁপিয়ে পড়তো আগুনের লাইভ সংবাদ দিতে। বতর্মানে পুরো এলাকা জুড়ে সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা।
মিরপুরের চলন্তিকা বস্তি ও আগারগাঁওয়ের বিএনপি বস্তির আগুনের মধ্যে আগুনের লাল রং ছাড়া হয়তো কোন মিল নেই। শুধু ‘দুষ্ট লোকেরা’ বলে, আবাসন ব্যবসায়ীদের সাথে রাষ্ট্রকাঠামোর আঁতাতে আগুন লাগে বস্তিতে। নিশ্চিহ্ন স্থানে কয়েক বছরে উঠে অসংখ্য নতুন ভবন। হারিয়ে যায় হাজারো নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনার দ্বিতীয় প্যারায় বলা হয়েছে, ‘এই রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনে শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক , অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য , স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’
ছলিম মিয়ারা শুধু জীবনটুকু টেকাতে ভিড়েছিলো ঢাকা শহরের বস্তিতে। সংবিধান বলছে, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্র নাগরিকের এসব অধিকার দিতে বাধ্য।
দক্ষিণবঙ্গের বরিশাল কিংবা উত্তরবঙ্গে কুড়িগ্রামের ছলিম মিয়ারা যেখান থেকেই ঢাকায় এসে ভিড়ে তাদের এই ভেসে আসা জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই। রাষ্ট্র পুরো বাংলাদেশের দাবি করলেও কুড়িগ্রামের মানুষটির জন্য তার এলাকায় এখনো কোন জীবন ধারণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারেনি। ফলে ঢাকায় জীবনের ন্যূনতম সুবিধা নিয়ে গড়ে ওঠা বস্তিতে হয় তাদের ঠাঁই।
বৈষম্যের ঢাকার চাকচিক্যে বড় বেশি বেমানান এইসব বস্তি। মধ্য আয়ের দেশের রাজধানীতে এমন বস্তির অস্তিত্ব জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সাথে সাংঘর্ষিক।
এমন অস্তিত্ব উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার পর্যালোচনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বাধা হয়ে দাঁড়ায় পুঁজিপতি ভবন ব্যবসায়ীদের মুনাফাও। মুনাফার লকলকে আগুনে তাই কদিন পরপর জীবন পুড়ে পুড়ে হয়ে যায় ছাই।
‘যে জীবন যাপনের সে জীবন পুড়ে যায় আগুনে, তার সাথে আর কভু হয় না তো দেখা মানুষের।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)