বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিনিধি জনাথন হেডের সঙ্গে আমাদের দেখা হয় শাহপরীর দ্বীপে। এর আগে বলে নেই জনাথন হেড সম্পর্কে। সারাবিশ্বেই তখন মিয়ানমার সরকারের সমালোচনা করে খবর প্রচারিত হচ্ছে নিয়মিত। যেসব খবরে তুলে ধরা হচ্ছে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের বাস্তব চিত্র। রোহিঙ্গাদের সাক্ষাৎকার, তাদের শরীরে ছুরির আঘাতের চিহ্নসহ চিত্র অথবা ভিডিও প্রচারিত হচ্ছে। তখনই মিয়ানমার সরকার একটা কৌশল নেওয়ার ছক আঁকছে। যা দিয়ে তারা বোঝানোর চেষ্টা করলো যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে যে খবর প্রচারিত হচ্ছে তা ঠিক নয়। রোহিঙ্গারা নিজেরাই নিজেদের ঘরে আগুন দিচ্ছে। এজন্য বেশ কিছু সাজানো ছবি তৈরি করে দেশী-বিদেশী কিছু সাংবাদিককে রাখাইনে নিয়ে যায় মিয়ানমার সরকার।
রাখাইনে প্রবেশের এ দুর্লভ সুযোগ হয়েছিলো জনাথন হেডের। তবে হেডকে যে ছবিগুলো দেয়া হয়েছিলো এবং একা ঘোরাফেরা করা যাবে না এমন যে শর্তগুলো দিয়ে সফরসঙ্গী করা হয়েছিলো সে নিয়মের বাইরে গিয়ে কিছু ঘটনা তুলে ধরেন হেড। হেডের প্রতিবেদনে উঠে আসে কীভাবে তাদেরকে বোকা বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। হেডের প্রতিবেদনেই প্রথমবারের মত রোহিঙ্গাদের জ্বলন্ত ঘরবাড়ি পোড়ার দৃশ্যের ছবি দেখতে পায় বিশ্ব।
শাহপরীর দ্বীপে হেডের দেখা পেয়ে রীতিমত আপ্লুত হলাম। বাংলাদেশে তখন বিশ্বের নামী-দামী সব গণমাধ্যমের সাংবাদিকরাই অবস্থান করছেন। তবে তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশের কোন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিতে চাইতো না। এমনকি ক্যামেরা তাদের দিকে তাক করলেও তারা অন্যদিকে সরে যেতো। হাতের কাছে পেয়েও তাই হেডের সাক্ষাৎকার পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় ছিলো। তবে হেড বিষয়টি সহজ করে দিলেন। কাছে গিয়ে কিছু কুশল বিনিময়ের পরেই একটি সাক্ষাতকার নেওয়ার ইচ্ছার কথা জানালে রাজি হয়ে গেলেন তিনি। জানালেন, মিয়ানমারে তিনি কী কী দেখেছেন এবং বাংলাদেশে কী কী দেখছেন। সংকটের আশু সমাধান না হলে এটা বাংলাদেশের জন্য বড় ধরণের সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে বলে একটা আশংকার কথাও তখন জানান হেড।
যদিও বাংলাদেশের মিত্র বলে পরিচিত ভারত এক্ষেত্রে মিয়ানমারের পক্ষ নেওয়ায় বিষয়টা যে বাংলাদেশের জন্য বড় ধরণের সমস্যা বয়ে আনতে পারে তা অনেকই বলা শুরু করেছেন। আবার মিয়ানমারের জন্য চীনের শক্ত সমর্থন থাকার পরও জাপান-নেপালের মত বাংলাদেশের প্রতিবেশী ও বন্ধু রাষ্ট্রগুলো এক্ষেত্রে ধরি মাছ না ছুঁই পানি টাইপের আচরণ করছে। যাতে এটা অনেকটাই স্পষ্ট যে রোহিঙ্গারাই বাংলাদেশের জন্য মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হতে যাচ্ছে। স্থানীয় কক্সবাজারবাসীও ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাদের এ ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি, গণপরিবহণ সংকটসহ নানান সমস্যায় পড়েছেন স্থানীয়রা। সংখ্যার দিক দিয়েও তখন টেকনাফ এবং উখিয়ার স্থানীয়দের থেকে রোহিঙ্গাদের সংখ্যাই বেশি হতে চলেছে। টেকনাফ এবং উখিয়ার মোট জনসংখ্যা ৪ লাখ ৮০ হাজার (সর্বশেষ আদমশুমারী)। হেডের সঙ্গে তখন এপি, রয়টার্সসহ আরও কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সাংবাদিকরাও ছিলেন। তবে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হলোনা।
রোহিঙ্গাদের ঢল তখন প্রতিদিনিই বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন তথ্য দেওয়া হচ্ছে তখন। তবে সবই ধারণার ওপর ভিত্তি করে, বলা চলে অনেকটা আন্দাজ করে। কয়েকদিন পরপর জাতিসংঘও একটি সংখ্যার হিসাব তুলে ধরছে। তবে জাতিসংঘের এ হিসাবের সঙ্গে বাস্তবের সংখ্যার হিসাবে ছিলো বেশ ফারাক। রোহিঙ্গাদের নিয়ে জাতিসংঘ যে হিসাবগুলো তুলে ধরছে তার থেকেও রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ছিলো প্রায় দ্বিগুন। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নির্ধারণে বায়োমেট্রিক নিবন্ধনও চলছে তখন। তবে শুরুর দিকে কেবলমাত্র উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে মাত্র ১০টি কম্পিউটার দিয়ে চলে বায়োমেট্রিকের কাজ। যার কারণে দিনে মাত্র এক থেকে দুই হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন সম্পন্ন করা গেছে। এমনও দেখা গেছে সারাদিন লাইনে বসে থেকে অনেক রোহিঙ্গাই নিবন্ধন করাতে পারেননি। পরবর্তীকালে কম্পিউটার সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০টি উন্নীত করা হয়।
আবার অনেক রোহিঙ্গা ইচ্ছা করেই নিবন্ধন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হননি। উখিয়া ক্যাম্পে দায়িত্বরত পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিবন্ধন না করে কিছু দালালের সহযোগিতায় অনেকে কক্সবাজার ছাড়ার চেষ্টা করছেন। তবে নিবন্ধন শুরু হওয়ার পর থেকেই উখিয়ার বেশ কয়েকটি পয়েন্টে বিজিবি সদস্য ছাড়া পুলিশের চেকপোস্টের সংখ্যা বাড়ানো হয়। র্যাব সদস্যরাও চেকপোস্ট বসায়। বাসে করে শহর ছাড়ার পথে ১১ সেপ্টেম্বর রাতে ৭০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠায় র্যাব। (চলবে)