চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বিবিধ বিধিনিষেধ ও বাঙালির বর্ষবরণ

বাংলা নববর্ষ ১৪২২-এর নারী নিপীড়নের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা রুখতে গিয়ে ১৪২৩ বাংলা নববর্ষ বরণের প্রাণাবেগের ক্ষণকে বিবিধ বিধিনিষেধ দিয়ে অনেকটাই রুদ্ধ করে দিয়েছিল সরকার ও প্রশাসন। মুখোশ মুখে নয় হাতে রাখা, অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারণ করে দেওয়াসহ আরও অনেক কিছু ছিল। আশঙ্কা ছিল এত বিধিনিষেধের বাইরে কীভাবে বাঙালি তার প্রাণের উৎসবকে পালন করে? অবশেষে সব আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বাঙালি মেতেছে উৎসবে, বাঙালি দেশ আর দশকে ভাসিয়েছে রঙে। বাঙালির এ সার্বজনীন উৎসব বর্ষবরণ যাবতীয় হিসেবনিকেশের বাইরেও স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল তা ফের প্রমাণ হলো।

প্রশাসনের বিধিনিষেধের বিপরীতে পহেলা বৈশাখে মনে হচ্ছিল যেন পুরো দেশ নেমে এসেছিল রাস্তায়! রাস্তায় নেমে আসতে গিয়ে মানুষ হয়ত কোনো দৃশ্যমান বাধার মুখে পড়েনি, কিন্তু প্রাণের উৎসবে মেতে ওঠতে গিয়ে ছিল অনাহুত ও অদৃশ্য শৃঙ্খলের বেড়াজাল। তবু মানুষ নেমেছে, মানুষে মানুষে ছেয়ে গেছে বড় শহর, ছোট শহর, শহরতলী থেকে মফস্বল। পহেলা বৈশাখে বর্ণিল মানুষের রঙিন সপ্রভিত উপস্থিতি, চিরায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মিশেলে অদ্ভুত এক রঙ, মনে হচ্ছিল সারা বছরই মানুষ অপেক্ষায় থাকে এই এক দিনের জন্যে। 

আমাদের স্বাতন্ত্র্য, সাংস্কৃতিক উৎসবের উত্তরাধিকার পহেলা বৈশাখের উৎসব আমেজ দিন দিন বাড়ছে। ১০ বছর আগের বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন আর অদ্যকার এ দিনের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। এখন মানুষ এ দিনে প্রাণাবেগে বানের জলের মতো নেমে আসে পথে, উৎসবের রঙে নিজে সাজে, অন্যকেও সাজিয়ে দিতে চায় নিজস্ব ভঙ্গিমায়। ব্যক্তিগত আনন্দকে সমষ্টিতে রূপান্তরের এ অভিপ্রায় ধার করা সংস্কৃতি থেকে উৎসারিত হলে সম্ভব হতো না। প্রাণের উৎসব আর আরোপিত উৎসবের মধ্যে এ পার্থক্য বহতা জলের মতো, তাই এটা আমাদের একান্ত নিজস্ব বলে উচ্ছ্বাসের মাত্রাটা তাই বাঁধভাঙা। 

প্রাণের উৎসব হিসেবে পহেলা বৈশাখের সার্বজনীন রূপে রূপান্তর টের পাওয়া যায় গত কয়েক বছরের ব্যাপকতা দেখে। দিন দিন এ উৎসবের ব্যাপকতা দেশের সকল স্তরে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে করে বছরের এ একটা দিন মানুষের শেকড়ের কাছাকাছি যাওয়ার তুমুল অভিপ্রায় আমাদের আশাবাদী হওয়ার প্রেরণা যোগায়। আগে যে উৎসব একটা শহরের নির্দিষ্ট কয়েকটি জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকত এখন তা শহরের অলিতে-গলিতে ছড়িয়ে গেছে। জেলা শহর, উপজেলা শহর, এমনকি এর বাইরেও বিচ্ছিন্নভাবে উদযাপিত হচ্ছে প্রাণের এ উৎসব। এটা দেখে হয়ত আশাবাদী হওয়া যায়, কিন্তু এ আশাবাদের বিপরীতে শৃঙ্খলের হাতছানি দেখে আতঙ্কের মাত্রাও বাড়ে, সন্দেহ নেই।

এবারের পহেলা বৈশাখে প্রশাসনের যাবতীয় বিধিনিষেধের পেছনে ছিল গত পহেলা বৈশাখের নারী নিপীড়নের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা। গত বছর (১৪২২ বঙ্গাব্দ)পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন স্থানে কতিপয় বিকৃতমনা তরুণের মাধ্যমে নারীর ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা। কিন্তু এক বছরেও পুলিশ এর কোনো কিনারা করতে পারেনি। উপরন্তু সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়েও এ নিয়ে মিথ্যা তথ্য দিয়ে বলেছিলেন একজন দোষি নাকি গ্রেফতার হয়েছিল, অথচ সে সময়ে কেউ গ্রেফতার ছিল না। পুলিশের আইজি এ ঘটনাকে আস্কারা দেওয়ার মতো করে বলেছিলেন এটা নাকি কিছু তরুণের ‘দুষ্টুমি’ ছিল।

সরকার-প্রশাসনের এ ব্যর্থতা, নারী নিপীড়নের ঘটনাকে জাস্টিফাই করার মানসিকতা ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিল দেশে-বিদেশে। গত বছর কেবল টিএসসিই নয়, পুরো দেশের একাধিক স্থানে এভাবে নারী নিপীড়নের ঘটনা ঘটলেও পুলিশ ঘটনার সময়ে এবং এরপর পুরো এক বছরেও কিছু করতে পারেনি। ফলে উদ্বেগ ছিল এবারও কি তেমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে? আশার কথা, এবার তেমন কিছু ঘটেনি। জনমানুষের সচেতনতা, গতবারের ঘটনার পরের প্রতিবাদ ফলপ্রসূ হয়েছে। 

পুলিশের সে লজ্জাজনক ব্যর্থতা, মন্ত্রী-আইজিপির জাস্টিফিকেশন তত্ত্ব, অথবা দায় এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা পুরো এক বছর চলমান থাকলেও এবারের পহেলা বৈশাখের আগে তারা অনুষ্ঠান উদযাপনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে। অপরাধীকে রুখে দেওয়ার জন্যে কার্যকর উদ্যোগ, দ্বিগুণ উৎসব আর উৎসাহে উদযাপনের পরিবেশ নিশ্চিতের বিপরীতে তারা খোদ অনুষ্ঠানকেই টার্গেট করে। এতে করে পহেলা বৈশাখের দিন হয়ত দৃশ্যমান ও প্রকাশ্য-প্রচারিত নিপীড়ন বন্ধ করা গেছে কিন্তু বিধিনিষেধ দিয়ে কি মানুষকে আশ্বস্ত করতে পেরেছিল, পারে নি। উল্টো সমালোচনার মুখে পড়েছে সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার উদযাপনে বাধা প্রদানের অভিযোগে।

এই বৈশাখে সমূহ সীমাবদ্ধতার সময়ে তাই প্রকৃতই মনে হয়েছে আমরা আদতে স্বাধীনতাকে শর্তসাপেক্ষ স্বাধীনতা হিসেবেই উপভোগের পর্যায়ে নিপতিত হয়েছি। অথচ স্বাধীনতা শব্দের অর্থের ব্যাপকতা যেখানে ‘স্বাধীনতা’ শব্দ দ্বারাই বুঝানোর কথা সেখানে অনাহুত শর্ত স্বাধীনতার অর্থকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। শর্তসাপেক্ষ স্বাধীনতাকে তাই পরাধীনতার প্রাথমিক পর্যায়েই নিয়ে যায়। 

গত বছরের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবহেলাজনিত ব্যর্থতা, উদ্দেশ্যমূলক দায় এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা এবং নারী নিপীড়ক দুর্বৃত্তদের কাছে সরকার ও প্রশাসনের পরাজয়কে নির্দেশক হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয় অনুষ্ঠান পালনে এবারের কিছু বিধিনিষেধ। বিকেল পাঁচটার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করা, মুখোশ হাতে রাখা যাবে মুখে পরা যাবে না- এমন নির্দেশনা পুলিশ প্রশাসনের জন্যে যৌক্তিক ও কার্যকর মনে হলেও উৎসব যেখানে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের ধারাবাহিকতা বহন করে সেখানে মানুষের কাছে অযৌক্তিক মনে হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এভাবে আস্তে আস্তে আমরা কি শৃঙ্খলিত উৎসব আয়োজনের পথে পা বাড়াচ্ছি? দুর্বৃত্তরা কি এতখানি শক্তিশালি যে খোদ রাষ্ট্রই মাথা নত করে সন্ধ্যের আগে সকলকে বাড়ি ফেরাতে চায়? 

এবার পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানের সরকারি সময়সীমা পর পুলিশ মাইকে উপস্থিত সকলকে নিজ নিজ গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। পুলিশের এ মাইকিং মনে হয়েছে অসহায়ের করুণ আর্তনাদ! কিন্তু কেন এমন হবে? রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের শক্তির কাছে যেখানে দুর্বৃত্তদের তটস্থ থাকার কথা, সেখানে উল্টো রাষ্ট্রই অসহায়ের মতো আহাজারি করছে। এটা কি দুর্বৃত্তদের বিজয়ী হয়ে যাওয়া নয়?

জহির রায়হান বলেছিলেন, এই ফাগুনে আমরা দ্বিগুণ হবো। এই দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ী তেজোদৃপ্ত বাণী বিজয়ী হওয়ার অভিপ্রায়কে নির্দেশ করে। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে এমন পদক্ষেপ যেখানে ছিল কাঙ্ক্ষিত, সেখানে দ্বিগুণ হয়ে যাওয়া নয়, যে একগুণ অথবা বর্তমান অবস্থা থেকে সরকারিভাবে যখন আরও কমে যাওয়ার কিংবা ছোট হয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয় তখন সেটা বিজয়ী, বিজয়প্রত্যাশীর ঋজু অবস্থাকে উপস্থাপন করে না। এটা অনাকাঙ্ক্ষিত!

যদিও মানুষজন ছিল সচেতন, তবু এ সচেতনতার মাঝেও পুলিশি হয়রানির ভয় ছিল। আশঙ্কা ছিল প্রশাসন কি কড়াকড়ির নামে পহেলা বৈশাখকেই বিধিবদ্ধ করে দেয়? দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষের আনাগোনা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সেখানে প্রশাসনের কঠোর বিধিনিষেধের কারণে অনেক অনুষ্ঠান হয়নি, কিন্তু রুখে দেওয়া যায়নি মানুষের উপস্থিতি, পুরোপুরি ম্লান হয়ে যায়নি বর্ষবরণের আনন্দ। 

গত বছরের দুঃখজনক ঘটনার বাইরে এবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে এবার অনেক বেশি ইভেন্ট হয়েছে উৎসবের আমেজকে দ্বিগুণ করার নিমিত্তে। এ দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার ঘোষণা ও আহ্বানের মাঝে একদিকে যেমন ছিল নারী নিপীড়কদের প্রতি ঘৃণা আর প্রতিবাদের প্রকাশ, একইভাবে ছিল সরকার-প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ক্ষোভ। ফেসবুকের মাধ্যমে বেশ কিছু লোক ‘স্বেচ্ছাসেবক প্রহরী’ হয়েছেন যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা মোকাবেলায়। এধরনের বেশ কয়েকটি গ্রুপ পুরো পহেলা বৈশাখের দিন মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে শুরু করে টিএসসি এলাকায় সক্রিয় থেকেছে। এটা স্বপ্রণোদিত মানবিক আর বাঙালিয়ানাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ঘটেছে। তারা তাদের বর্ণিল ও সতর্ক উপস্থিতির মাধ্যমে অনেকের কাছে এ বার্তা অন্তত পৌঁছে দিতে পেরেছে বাঙালি সংস্কৃতি আর পহেলা বৈশাখের আনন্দকে অব্যাহত রাখতে এদেশের তরুণেরা প্রস্তুত রয়েছে; কেবল তাই নয় যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিরোধেও রয়েছে ব্যক্তিগত ও গ্রুপপ্রস্তুতি। এটা আশাবাদী হওয়ার বিষয়। 

পহেলা বৈশাখকে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন প্রকার ধর্মোদ্ভূত সামাজিক প্রতিবন্ধকতা দিয়ে বাধাদান করার একটা অপচেষ্টা চলছে। ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম, আওয়ামী ওলামা লীগসহ কয়েকটি সংগঠন সরাসরি পহেলা বৈশাখের বিরুদ্ধাচরণ করেছে প্রবলভাবে। এ ধরনের প্রচারণা ধর্মের নামে পরিচালিত, এবং মিডিয়ায় প্রচারিত হওয়ার কারণে শহরের বাইরে মফস্বলেও ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে। বর্ষবরণের দিন শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত আশঙ্কা ছিল। কিন্তু সব আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণ করেছে জনস্রোত, যা ছিল একান্তই বাংলা আর বাঙালি সংস্কৃতির টানে।

এবারের বর্ষবরণে কেবল তাই শহরই মাতে নি, এর ছোঁয়া লেগেছে গ্রামেগঞ্জেও। বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের পাশাপাশি রঙ খেলার উৎসব ছিল। এর সাথে ছিল হালখাতার উৎসব, মিষ্টিমুখ-সঙ্গে ছিল নিজেদেরকে রঙিন করে তোলার অনবদ্য প্রয়াস।

বাঙালি সংস্কৃতি তথা পহেলা বৈশাখের প্রধান শত্রু সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ। উৎসবে উজ্জীবিত লক্ষ প্রাণ তাই এ অদৃশ্য শৃঙ্খল ভেঙে আলোর পথে চলার শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বরণ করে নিয়েছে বাংলা নববর্ষকে। সাম্প্রতিক সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা উগ্র মৌলবাদী হামলার ভীতি তুচ্ছ করে তেজোদৃপ্ত বাঙালি সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে রুখতেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার গান গেয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে। রাস্তায় বেরিয়ে আসা মানুষের চোখেমুখে প্রস্ফুটিত হচ্ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়।

চির নতুনের ডাক দিয়ে আসা পহেলা বৈশাখ যেন রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে বাঙালির মনে, যার প্রকাশ ঘটেছে নারী-পুরুষের রঙিন সাজে, শিশুদের মুখে ফুটে ওঠা আনন্দের হাসি আর বর্ণিল পোশাকে। সে সঙ্গে হাতে-মুখে ছিল বাহারি বাদ্য। গত কয়েক বছরের মতো বিরক্তি উৎপাদনকারী ভুভুজেলা এবার ছিল না। সরকারী ঘোষণায় নিষিদ্ধ ছিল আফ্রিকান সংস্কৃতি থেকে আমদানিকৃত এ বাদ্য, তাই মানুষের মাঝে ছিল অপরিমেয় তৃপ্তি।

পহেলা বৈশাখে আমাদের বাঙালির স্বাতন্ত্র্যের স্মারক। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ফসলি সন নামে বাংলা বর্ষ গণনা চালু হয়েছিল কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে। এটি চালু করেছিলেন মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮৪ সালে। এখন মোগল সম্রাটরাও নেই, চৈত্র মাসের শেষ দিনে খাজনা আদায়ও হয় না; কিন্তু বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষের প্রথম দিন উদযাপন এখন বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান উৎসব। সব ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণের দিক দিয়ে প্রধান উৎসব এটি, সে হিসেবে সার্বজনীন। এক সময় কেবল চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হতো আর এখন সব বিভাগীয় শহরে, এমনকি জেলা শহরগুলোতেও চলে এমন আয়োজন। রমনা বটমূলের বৈশাখকে স্বাগত জানিয়ে অনুষ্ঠানের মতো এখন সারাদেশেই চলে বৈশাখ বন্দনা, উদযাপন আর স্বাগত জানানোর বিবিধ আয়োজন।

আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখ এখনকার মতো অনেকের মাধ্যম থেকে হুমকির উপলক্ষই কেবল নয়, বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আক্রান্ত হওয়ারও নজির আছে। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বোমা হামলার শিকার হয়েছিল। সেদিন ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন রমনার বটমূলে। বৈশাখকে স্বাগত জানিয়ে যখন শুরু হলো অনুষ্ঠান তখনই হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে রমনার চারপাশ। ঘড়িতে সময় তখন সকাল আট। সেটা ছিল বোমা বিস্ফোরণের ভয়ঙ্কর শব্দ। সেই বোমায় নিহত হন ১০ জন। এমন দিন পেছনে ফেলে এসেছে বাংলাদেশ। অপরাধীদের বিচারে নিম্ন আদালত থেকে শাস্তি ঘোষিত হয়েছে, মামলা এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়! 

২০০১ থেকে ২০১৬- এই ১৫ বছরে ছায়ানটের বৈশাখ বরণ অনুষ্ঠানের বোমা হামলায় নিহতদের স্বজন এখনও বিচার পায় নি। অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না পাওয়ায় আরও দুঃখজনক ঘটনার আশঙ্কা উঁকি দেয়। গত ১৫ বছরে এধরনের অনুষ্ঠানে এমন বড় বোমা হামলা আর না হলেও অপ্রীতিকর ঘটনা, নারী নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এবং বিচার না হওয়ায় এর রাশ টেনে ধরাও হয়ত সম্ভব হয়নি। কারণ বড় কোন ধরনের ঘটনার বিচার হলে অন্তত শাস্তির এবার্তা পৌঁছাত। বিচার হয়ে গেলে যে চিরতরে এ পথ বন্ধ হয়ে যেত তা না, কিন্তু দুর্বৃত্তরা কিছুটা হলে শাস্তির ভয় পেত। 

পহেলা বৈশাখ বাঙালি আর বাঙালিয়ানার প্রতীক। দেশব্যাপী এই দিনটিকে উৎসাহ উদ্দীপনার মাধ্যমে পালিত হয়েছে। দিন যত যাবে ততবেশি মানুষ এ উৎসবে সম্পৃক্ত হবে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এ একটা দিনই জাতিসত্তা ও দেশকে ধারণ করা বাঙালির অন্যান্য সকল আনন্দ ও উৎসব ম্লান হয়ে পহেলা বৈশাখের কাছে এসে। 

সার্বজনীন এ উৎসবে তাই বিধিনিষেধ নয়, প্রাণখুলে উদযাপনের পরিবেশ নিশ্চিত করা সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্ব। অহেতুক বিধিনিষেধ আরোপ দুর্বৃত্তদের কাছে পরাজয়ের নির্দেশক। আগামীতে এভাবে দুর্বৃত্তদের কাছে মাথানত করা রাষ্ট্রের উচিত হবে না!

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)