‘আশির দশকের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ কর্মীদের মিছিলে থেকে যে স্লোগানে ক্যাম্পাস প্রকম্পিত হতো সেটি ছিল ‘বিপ্লবের প্রেরণা, শহীদ কমরেড মুন্না’। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময়কালে এই স্লোগানটি জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগ-এর মিছিলের এক অনিবার্য বিষয় ছিল।
কেননা সেসময় ৮৭ সালে জাসদ ছাত্রলীগ হারিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার অত্যন্ত মেধাবী নেতা, স্থীর চিত্তের সৌম্য শান্ত এক সহযোদ্ধা শহীদুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র আসাদ আহমেদ মুন্নাকে। মুন্না ভূ-তত্ত্ব ও খনিজ বিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। এসএসসি আর এইচএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী বিভাগের মেধা তালিকা পেরিয়ে রংপুর থেকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। প্রগতিমনা এই তরুণ অন্যায়ের প্রতিবাদ আর সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে যৌবনের শুরতেই নাম লিখিয়েছিলেন জাসদ সমর্থিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগে।
আজ ১৯ জুলাই আসাদ আহমেদ মুন্নার ২৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের কাছে এটি বড় এক বেদনার দিন। মুন্নার প্রিয় বন্ধুরা এদিন বড় বিষন্ন হয়ে পড়েন। সেদিন তরতাজা মেধাবী মুন্না নিহত হয়েছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের পরিকল্পিত এবং উদ্ভট এক সশস্ত্র হামলার ফলশ্রুতিতে।
৮৭ সালের ১৪ জুলাই মুন্না ছাত্রদলের আক্রমণে এসএম হলে গুলিবিদ্ধ হলে তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজে। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে দুদিন পরে সহযোদ্ধা, বন্ধুদের চোখের জলে ভাসিয়ে চিরবিদায় নেন তিনি।
মুন্নার এই অকাল মৃত্যুর জন্যে শতভাগ দায়ী ছিল ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। নিজ দলের মধ্যে সংঘটিত একটি হত্যাকাণ্ডকে জায়েজ করতে গিয়েই মূলত তারা সেদিন জাসদ ছাত্রলীগের উপর আক্রমণের কুৎসিত পথ বেছে নিয়েছিল। ১৪ জুলাই এসএম হলে আক্রমণের আগের রাতে ১৩ জুলাই সূর্যসেন হল গেটে রাতে আব্দুল হালিম নামে ছাত্রদলের এক কর্মী হঠাৎ করেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। হালিমের গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার ঘটনাটি ছিল ছাত্রদলের নিতান্তই অভ্যন্তরীণ ইস্যু। এর সাথে জাসদ ছাত্রলীগসহ কারোরই কোনো সংশ্লিষ্টতা বা প্ররোচনা ছিল না। কিন্তু রাতেই ছাত্রদলের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকা মহসীন হল, সূর্যসেন হল, জসীমউদ্দিন হলগুলোতে প্রচার চালানো হয়; যে সূর্যসেন হল গেটে হালিম হত্যার যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটা জাসদ ছাত্রলীগ ঘটিয়েছে।
ছাত্রদলের কোনো কোনো নেতা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা মেটাতে রাতেই জাসদ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উপর হামলার উস্কানি দিয়ে বক্তৃতা দিতে থাকে। মহসীন হল গেটেও নিরু-অভি-পাগলা শহীদ-রতন-মালেকের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল শেষে এ ধরনের বক্তব্য দেওয়া হয়। ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে রাতেই জাসদ ছাত্রলীগের উপর হামলার জন্যে বহিরাগতদের মহসীন হল, সূর্যসেন হল, জসীমউদ্দিন হলে জমায়েত করা হয়। সাধারণ ছাত্ররা বুঝতে পারে সকাল বেলা জাসদ ছাত্রলীগের উপর ছাত্রদলের হামলা সময়ের ব্যাপার মাত্র। বাস্তবে ঘটেও তাই।
এদিকে জাসদ ছাত্রলীগও ছাত্রদলের পরিকল্পিত অন্যায়ের কাছে মাথা না নোওয়ানোর প্রত্যয় নিয়ে ক্যাম্পাসে নিজেদের অবস্থানে থাকে। একই সাথে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে পুরো বিষয়টি জ্ঞাত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করে। কিন্তু কে শোনে কার কথা।
এর আগে বলে নেওয়া ভালো মুন্না নিহত হওয়ার কিছুদিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় কাম্পাসে ছাত্রদল কর্তৃক সংঘটিত বিভিন্ন অপকর্মের প্রতিবাদ ও আপত্তি করলে জাসদ ছাত্রলীগের সাথে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের চরম মতবিরোধ তৈরি হয়। সাংগঠনিকভাবে বেশি শক্তিশালী হওয়ার কারণে এবং বেশিরভাগ হলগুলোতে প্রায় একচ্ছত্র অবস্থান থাকার কারণে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন ইস্যুতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কর্মীরা বরাবরই অসহিষ্ণু আচারণ করতে থাকে। হলগুলোতে ছাত্রদলের কতিপয় কর্মীরা রামরাজত্ব তৈরি করে এক বিশ্রী পরিবেশের উদ্ভব করে। জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীরা বরাবরই ছাত্রদলের এ সব বিষয়ের প্রতিবাদ জানাতে থাকে।
এরকম প্রেক্ষিতে জাসদ ছাত্রলীগ এবং জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল মুখোমুখি অবস্থান নিলে ক্যাম্পাসে এক ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়। এক পর্যায়ে জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীরা আওয়ামী ছাত্রলীগের সহায়তায় ক্যাম্পাসের পূর্বদিকের চারটি হল-যেগুলোতে ছাত্রদলের প্রায় একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল সেই এফ রহমান হল, মহসীন হল, সূর্যসেন হল এবং জসীমউদ্দিন হল দখল করে নেয়। বেশ কিছুদিন জাসদ ছাত্রলীগ সাধারণ ছাত্রদের সমর্থন নিয়ে হলগুলো নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে। এই ঘটনায় ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা মারাত্মকরকম ক্ষুব্ধ হয়।
এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সাথে দেনদরবার শুরু করে ছাত্রদলের নেতারা। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃৃপক্ষ এবং অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের হস্তক্ষেপে এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা যে যার হলে সহঅবস্থান করবে। সেই মোতাবেক নিজ নিজ হলে সবাই ফিরে আসে। কিন্তু কয়েক দিনের ব্যবধানেই ছাত্রদলের নেতা কর্মীরা চোখ উল্টে দেয়। তারা হঠাৎ করেই এফ রহমান হল, মহসীন হল, জসীম উদ্দিন হল, সূর্যসেন হলসহ বেশ কয়েকটি হলে সশস্ত্র হামলা চালিয়ে হলগুলো থেকে জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীদের অবস্থান ত্যাগ করতে ব্যর্থ হয়। এমতাবস্থায় জাসদ ছাত্রলীগের কর্মীরা এসএম হল, জগন্নাথ হলে আশ্রয় গ্রহণ করে।
ঘটনাটি এমন ছিল সূর্যসেন হলের গেটসহ ছাত্রদল নিয়ন্ত্রিত হলগুলোর গেট তখন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সশস্ত্র ক্যাডাররা পালাক্রমে পাহারা দিত। ক্যাম্পাস তখন নিয়ন্ত্রণ করতো জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জনপ্রিয় নেতা সানাউল হক নিরু এবং গোলাম ফারুক অভি অনুগত ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এর আগে ঐ বছরেই ৮ মার্চ মুহসীন হলের ৪২৬ নম্বর কক্ষে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হক বাবলু এবং দুই সহযোগী মঈনুদ্দিন ও নুর মোহাম্মদ নিহত হন। মঈনুদ্দিন ও নুর মোহাম্মদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের রাজনীতির বিপুল কর্তৃত্ব তৈরি হয় তারই আপন ছোট ভাই ছাত্রদল নেতা সানাউল হক নিরুর।
এদিকে ১৪ জুলাই সকালেই মহসীন হল, জসীম উদ্দিন হল, সূর্যসেন হলের ছাত্রদলের নেতাকর্মী এবং তাদের স্বপক্ষের সশস্ত্র বহিরাগতরা এসে মহসীন হল গেটে জড়ো হয়। সেখানে নেতারা সূর্যসেন হল গেটে আব্দুল হালিমের মৃত্যুর জন্যে সুপরিকল্পিতভাবে জাসদ ছাত্রলীগকে দায়ী করে হামলার জন্যে উস্কানি দিতে থাকে। অথচ আব্দুল হালিম নিহত হয়েছিল ছাত্রদলের নেতাদের হাতেই।
এরপর বেলা নয়টা দশটার দিকে ছাত্রদলের সশস্ত্র নেতা-কর্মীরা মহসীন হল থেকে অগ্রসর হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলের সামনে গিয়ে, ফুলার রোড ধরে এসএম হলে জাসদ ছাত্রলীগের অবস্থানের উপর বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করতে থাকে। কয়েকঘণ্টা ধরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে গুলিবিদ্ধ হন ছাত্রলীগের মেধাবী নেতা আসাদ আহমেদ মুন্না। পাঁচদিন পর ১৯ জুলাই সকালে মুন্নার মৃত্যু ঘটে। নিভে যায়-একটি মেধাবী জীবন।
শহীদুল্লাহ হলের তৎকালীন জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রোকনুজ্জামান রোকন স্মৃতিচারণ করে বলেন,‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা পায়ের তলায় পিষে সেদিন ছাত্রদলের পরিকল্পিত এবং ঘৃণিত হামলার কারণেই প্রিয় সহযোদ্ধা মুন্নাকে হারাতে হয়। মুন্না আজও আমাদের হৃদয়ে আছে এবং থাকবে।’
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)