দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাজেট উপস্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থমন্ত্রীর অসুস্থতার কারণে বাজেট ঘোষণার মাঝপথে স্পিকারের অনুমতি নিয়ে তিনি সংসদে বাজেট পেশ করেছেন।
আর দেশের ৪৮ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বাজেট এটি। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটের আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে আগামী বাজেট ১২ দশমিক ৬১ শতাংশ বড়।
এবারের বাজেট পেশ করা হলো ‘বিপর্যস্থ ব্যাংক ব্যবস্থা’ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে। আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় ‘ব্যাংকিং সেক্টর’ হলো ‘হৃদপিণ্ড’। হৃদপিণ্ডের কাজ হলো দেহে রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখা। আমাদের দেশে গত কয়েক বছরে এই ‘হৃৎপিণ্ডে’ বিরাট ‘ক্ষত’ সৃষ্টি হয়েছে। তার মানে ‘অর্থনীতির দেহ’ ভালো নেই। রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক নেই। দেহের কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে। শরীর অসুস্থ। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পোৎপাদনে ব্যাংকগুলো টাকা দিতে পারছে না।
তাদের হাতে ঋণ দেওয়ার মতো টাকা নেই। ঋণ না দিতে পারলে তো এক পর্যায়ে ব্যবসা বাণিজ্যই বন্ধ হয়ে যাবে। আর ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া বা গতি কমে যাওয়ার সরাসরি প্রভাব পড়বে সরকারের আয়ের ওপর। এনবিআর কোথা থেকে টাকা তুলবে? এ ছাড়া মানুষের আয়-কর্মসংস্থান এসব বিষয়তো আছেই।
বাস্তবতা হলো আমাদের দেশে ব্যাংকের হাতে টাকা নেই। কেন? এর অনেকগুলো কারণ রয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক বেশি, তার মানে যারা টাকা নিয়েছে তারা ‘কিস্তি’ পরিশোধ করছে না। ফলে ব্যাংকে টাকা জমা পড়ছে না। আমানত কমে যাচ্ছে। আবার মানুষ ব্যাংকে টাকা জমা রাখতেও আগ্রহী হচ্ছে না। এর একটা কারণ ব্যাংকে সুদের হার কম; আস্থার সংকটও আছে।
পাশাপাশি দেশ থেকে দেদারসে টাকা পাচার হচ্ছে। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) গত ২৯ জানুয়ারি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০১৫ সালে বাণিজ্যে কারসাজির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার বিদেশে পাচার হয়ে গেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এটি প্রায় ৫০,০০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ। বাংলাদেশ থেকে টাকা বেরিয়ে গেছে দুইভাবে- একটি উপায় হচ্ছে, পণ্য আমদানির সময় কাগজপত্রে বেশি দাম উল্লেখ করে টাকা পাচার, আরেকটি হচ্ছে, পণ্য রপ্তানি করার সময় কাগজপত্রে দাম কম দেখানো।
রপ্তানির সময় কম দাম দেখানোর ফলে বিদেশি ক্রেতারা যে অর্থ পরিশোধ করছে, তার একটি অংশ বিদেশেই থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আসছে শুধুমাত্র সেই পরিমাণ অর্থ, যে পরিমাণ অর্থের কথা দেখানো হচ্ছে অর্থাৎ কাগজপত্রে যে দাম উল্লেখ করা হয়েছে সেটা। অনেক সময় পণ্য আমদানি-রপ্তানির ঘোষণা থাকলেও বাস্তবে খালি কন্টেইনার আসা-যাওয়া করেছে, এমন উদাহরণও রয়েছে। শুধু উন্নত দেশের সাথে বাণিজ্যের ভিত্তিতে এ পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশে থেকে বেরিয়ে গেছে।
গত বছর জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে প্রায় ৭ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। ২০১৫ সালে পাচার হয়েছে আরও ৫৯০ কোটি ডলার। সেই হিসাবে গত ১১ বছরে মোট পাচার হয়েছে ৮ হাজার ১৭৫ কোটি ডলার। বর্তমান বাজারদরে এর মূল্যমান ৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। যা এবারের বাজেটের আকারের চেয়েও বড়।
আর উল্লিখিত হিসেবগুলো সবই পুরানো। ২০১৬-২০১৯ এই সময়ে নিশ্চয়ই টাকা পাচারের ঘটনা আরও বেড়েছে। কারণ এই তিন বছরে দেশে এনবিআর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব আরও খর্ব হয়েছে। জিএফআই বলছে তারা যে পরিসংখ্যান তুলে ধরেছে সেটি খুবই কম হিসেব, কারণ তারা যতটুকু আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান পেয়েছে সেটির ভিত্তিতে অর্থ পাচারের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আরও অনেক কারসাজি হয় যেগুলোর প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না।
যে প্রতিষ্ঠানটির এসব তদারকি ও দেখভাল করার কথা সেই বাংলাদেশ ব্যাংক ক্রমেই ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন তদারকির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। ঋণপত্র (এলসি) খোলা হচ্ছে, কিন্তু দেশে পণ্য আসেনি কেন—এ বিষয়ে নজরদারি করা হলে টাকা পাচার কমে যেত। আবার কত টাকার পণ্য দেশে আনা হয়েছে, বিদেশে কত টাকার পণ্য যাচ্ছে—এসব সঠিকভাবে নজরদারির কোনো ব্যবস্থা নেই। সবখানে রাজনৈতিক প্রভাব।
সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা তৎপর হলে হুমকি আসে। বদলি এমনকি চাকরিচ্যূতির হুমকি দেওয়া হয়। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের যোগ এখন অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদরাই সামনে একজনকে রেখে পেছন থেকে ব্যবসায়ার কলকাঠি নাড়েন। ফলে আইন মানানো সহজ হয় না।
আবার ব্যবসায়ীদের চাপে দেশে প্রধান প্রধান আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক কর নেই বললেই চলে। দিন দিন শুল্ক কর হার আরও কমে যাচ্ছে। তাই টাকার পাচারের ঘটনায় এনবিআরের সংশ্লিষ্টতা তুলনামূলক কমে যাচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা নিজের ইচ্ছে মতো বিদেশে টাকার পাহাড় গড়ছেন। বাণিজ্য কারসাজির বাইরে একটি বড় অংকের টাকা দেশ থেকে পাচার হয় হুন্ডির মাধ্যমে এবং এই পাচারের কোনো তথ্য-প্রমাণ ও পরিসংখ্যান নেই।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কেউ যদি বাংলাদেশ থেকে টাকা বিদেশে পাচার করতে চায় তাহলে সে সেই টাকা কোনো হুন্ডি ব্যবসায়ীকে দেয়। ওই হুন্ডি ব্যবসায়ী তার কোনো এজেন্টের মাধ্যমে একই পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা বিদেশে অবস্থানরত ওই ব্যক্তির কোনো আত্মীয়-স্বজন কিংবা মনোনীত ব্যক্তিকে দিয়ে দেয়। এই প্রক্রিয়ায় টাকা পাচার এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
এই অবস্থায় সরকার কী করছে? সরকার আপাতত: হৃদপিন্ডে ‘রিং’ পড়ানোর চেষ্টা করছে। ঋণখেলাপিদের কিছু ‘ছাড়’ বা ব্যাংগুলোর হাতে নগদ কিছু টাকা গুজে দেওয়া-এসবই ‘রিং’ পড়ানোর মতো ব্যাপার। এসব করার পরেও রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া স্বাভাবিক হবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
এই অবস্থায় সরকার সোয়া পাঁচ লক্ষ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা দুশ্চিন্তার বিষয় বটে! এবারের বাজেটের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, স্মরণকালের সর্বোচ্চ ঘাটতি। ঘাটতির পরিমাণ ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। আয়ের চেয়ে দেড়গুণ বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে এবারের বাজেটে। এই বিপুল টাকার ঘাটতি মেটানো হবে ঋণ করে, যা বাজেটের এক-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি।
নতুন বাজেটে ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক উৎস থেকে প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৬০ হাজার কোটির কিছু বেশি, আর অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে আসবে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে নেওয়া হবে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা, আর সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া হবে ২৭ হাজার কোটি টাকা।
বিদেশ থেকে টাকা পাওয়া গেলে অর্থনীতির জন্য ভালো। এতে খরচ কম। বিপদ অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ নিলে। ব্যাংক থেকে বেশি টাকা নিলে বেসরকারি খাত বঞ্চিত হয়, মূল্যস্ফীতি বাড়ে। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে টাকা নিলে বিপদের মাত্রা আরও বেশি। চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্য ছিল ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। অথচ মাত্র ৯ মাসেই সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা।
সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার বেশি। বিকল্প ও নিরাপদ জায়গা না থাকায় সাধারণ মানুষের আগ্রহ সঞ্চয়পত্রেই অধিক। যাহোক, বিদেশ থেকে কাঙ্ক্ষিত টাকা পাওয়া না গেলে অভ্যন্তরীণ উৎসের দিকেই সরকারকে হাত বাড়াতে হবে। এতে টান পড়বে বেসরকারি ঋণপ্রবাহে। এমনিতেই ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার ফলে সুদ-আসল পরিশোধ করতেই বিশাল ব্যয় হচ্ছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাতে রাজস্ব ব্যয়ের ১৮ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এবার এই হার আরও অনেকটাই বাড়বে।
বাজেট প্রস্তাবে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা কীভাবে অর্জিত হবে তা সুস্পষ্ট নয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল তা অর্জিত হয়নি। প্রায় পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি রয়ে গেছে। ঘোষিত বাজেটের ক্ষেত্রে ভিন্ন পরিণতি হবে-এমন আশা কম।
ভ্যাটসহ পরোক্ষ কর থেকে বর্ধিত রাজস্ব আদায়ের যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা সব পণ্য ও সেবার মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে মূল্যস্ফীতির হারকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। আর এ দুঃসহ ভারের সবটাই বহন করতে হবে গরিব-মধ্যবিত্তসহ সাধারণ নাগরিকদের। অথচ বিত্তবানদের উপর ধার্য প্রত্যক্ষ কর মূলত একই পর্যায়ে রাখা হয়েছে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর রেয়াত অব্যাহত রাখা হয়েছে। খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার পরিবর্তে সুদের হার কমানো হয়েছে।এবারের বাজেটের শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ: সময় এখন আমাদের, সময় এখন বাংলাদেশের’।
কিন্তু ঘোষিত বাজেটে আয়ের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ছাড়া কেবল ঋণ ঋণ এবং ঋণ-এই বিপুল ঋণের ভরসায় যে বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতে ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ’কে কোথায় দাঁড় করাবে-তা নিয়ে দুশ্চিন্তার অবকাশ আছে বৈকি!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)