চলতি অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসেই বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৭শ কোটি ডলারেরও বেশি। অর্থবছরের বাকি সময়ে এ ঘাটতি ১ হাজার ৩শ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যেও বড় ঘাটতির আশঙ্কা করছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। এর পরিমাণ হতে পারে প্রায় ৪৩৪ কোটি ডলার।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানির তুলনায় আমদানির পরিমাণ আশঙ্কাজনক বেড়ে যাওয়ায় ঘাটতি বাড়ছে। তবে খতিয়ে দেখা দরকার, আসলে বিনিয়োগের জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি হচ্ছে না কি অর্থ পাচার হচ্ছে।
সম্প্রতি চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ার আশঙ্কা করা হয়। ওই সময় গভর্নর ফজলে কবির বলেছিলেন, আমদানি ব্যয়ের আকস্মিক স্ফীতি বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের চলতি খাতে ঘাটতি স্ফীত করে টাকার মূল্যমানে ২ দশমিক ৫ শতাংশ অবচিতির সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতির ওপরও চাপ বৃদ্ধি করেছে।
সাধারণত রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় যেটুকু বেশি, তার পার্থক্যই হচ্ছে বাণিজ্য ঘাটতি। আর চলতি হিসাবের মাধ্যমে দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝানো হয়। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক লেনদেন ভারসাম্যের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশ মোট ২ হাজার ১৯৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার ব্যয় করেছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ে পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় হয়েছিল ১ হাজার ৭২২ কোটি ৪০ লাখ ডলার।
অন্যদিকে এ সময়ে বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ১ হাজার ৪৩৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের একই সময়ে পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছিল ১ হাজার ৩৩৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
এ হিসাবে সামগ্রিক বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭৬০ কোটি ৭০ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জুলাই-নভেম্বর সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৮৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এদিকে চলতি মুদ্রানীতিতে অর্থবছর শেষে বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার ৩১০ কোটি ৪০ লাখ ডলার দাঁড়াবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যে (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।
জুলাই-নভেম্বর সময়ে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৪৩ কোটি ২০ লাখ ডলারে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৭ এবং পুরো বছরের চেয়ে ৪ গুণ বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ হিসাবে ঘাটতি ছিল প্রায় ১৪৮ কোটি ডলার। তার আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে চলতি অর্থবছরে জুলাই-নভেম্বর সময়ে মোট ১৩৮ কোটি ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ১৫ শতাংশ কম। এর মধ্যে নিট এফডিআই এসেছে ৮৫ কোটি ৯০ লাখ ডলার। যা আগের বছরের এই পাঁচ মাসে এসেছিল ৮৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে মোট যে এফডিআই আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যে অর্থ অবশিষ্ট থাকে, তাকেই নিট এফডিআই বলা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই অস্বাভাবিক হারে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। এ কারণেই চলতি হিসাবের ভারসাম্যে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তবে আমদানি ব্যয় বাড়লেও প্রকৃত আমদানির চিত্র নিয়ে সন্দেহ রয়েছে সংশ্লিষ্টদের।
তাদের মতে, দেশে যে পরিমাণ মূলধনী যন্ত্রপাতি ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির তথ্য আসছে, সে অনুযায়ী বিনিয়োগ দেখা যাচ্ছে না। কেউ কেউ নামে বেনামে এলসি খুলছে। তাই আসলে আমদানির আড়ালে কী হচ্ছে তা অনুসন্ধান করা দরকার।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, কিছু কিছু এলসি খোলা বা পণ্য আমদানির জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকেও অনুরোধ আসে। তখন ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও আমরা নিষেধ করতে পারিনা।
“এত পরিমাণ আমাদানি হয়, কিন্তু সেগুলো বিনিয়োগ হয় কোথায়। আর বিনিয়োগ হলে অর্থনীতি গতিশীল নয় কেন? আর এত লাখ লাখ লোকও বা বেকার কেন?”
সাবেক তত্ত্বাবধারক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমদানি বাড়ার মানে হচ্ছে দেশে বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়া। বিনিয়োগ বাড়লে অর্থনীতি গতিশীল হয়। কিন্তু সেভাবে বিনিয়োগ দৃশ্যমান নয়। তাই আমদানির আড়ালে অর্থ পাচার কিংবা আমদানি ব্যয় অতি মূল্যায়িত হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা উচিত।