বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ’ শিরোনামে নতুন বাজেট উপস্থান করেন অর্থমন্ত্রী। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেটের প্রস্তাবিত আকার ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা।
বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নের ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী জানান, ২০১৫ সালের পরে যে স্থিতিশীল ও আগুসার অর্থনীতির সূচনা আমরা করেছি তার সুফল হিসেবে বিনিয়োগ প্রসার ও বৈদেশিক বিনিয়োগ অনতিবিলম্বে এদেশের প্রতি আকৃষ্ট হতে যাচ্ছে।
“সদ্য প্রণীত ওয়ানস্টপ সার্ভিস আইন, ২০১৮ বাস্তবায়নের জন্য একইস্থান হতে অনলাইনভিত্তিক ১৫০টি সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে সিঙ্গাপুরের আদলে সফট্ওয়্যার তৈরি করার কাজ প্রায় শেষ করে এনেছি। আশা করছি, এর মাধ্যমে শীঘ্রই যে কোন বিনিয়োগ প্রস্তাব বিষয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এক স্থান হতে সকল প্রাসঙ্গিক সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে।”
“আগামী ৫ বছরের মধ্যে Ease of Doing Business সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ২ ডিজিটে তথা ১০০ এর নিচে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রতিটি উপ-সূচক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ এর সাথে আলোচনার মাধ্যমে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।”
“মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত ‘National Committee for Monitoring and Implementation’ এর মাধ্যমে কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ছোট বড় উৎপাদনমুখী উদ্যোগে অর্থায়ন পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করার দিকে সব সময়ই আমরা জোরালো নীতিসমর্থন দিয়ে আসছি।”
“অর্থনৈতিক অঞ্চলসমূহকে ঘিরেও আমাদের কিছু পরিকল্পনা রয়েছে। এ অঞ্চলগুলির উন্নয়ন ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার অভিপ্রায় আছে আমাদের। এছাড়া, অঞ্চলগুলোর ভেতরে ও বাইরে পশ্চাদসংযোগ শিল্পকারখানা তৈরির মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে চাই। মহানগরীসহ বিভ্ন্নি এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা শিল্পকারখানাকে অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থানান্তরের বিষয়ে ব্যবসায়ী সংগঠনকে উৎসাহিত করতে আমরা সচেষ্ট আছি।”
এছাড়াও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে শিল্পখাতের বিকাশ, দক্ষ মানবসম্পদ গঠন, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের কথা বলেছেন।
‘কর্মসংস্থানে শিল্পখাতের অবদান আশানুরূপ নয়’ উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, শ্রমবাজারে পর্যাপ্ত কর্মক্ষম জনশক্তির উপস্থিতি থাকলেও নতুন শিল্পে অটোমেশন এবং উন্নত প্রযুক্তি প্রবর্তনের ফলে প্রত্যাশানুযায়ী শিল্পখাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না।
“দক্ষতার ঘাটতিজনিত কারণে আমাদের শিল্পখাতে ব্যবস্থাপনার মধ্যম ও উচ্চ পর্যায়ের পদে কাজ করছে প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের কর্মীরা। দেশীয় জনশক্তির প্রতিযোগিতামূলক দক্ষতা সৃজনের মাধ্যমে এদের প্রতিস্থাপন করা হলে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে, অন্যদিকে তেমন আমাদের নিজস্ব জনশক্তির জন্য উৎপাদনশীল শোভন কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে।”
“দেশে প্রতিবছর আনুমানিক ২০ লক্ষ লোক শ্রমবাজারে প্রবেশ করে” উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, তবে, শ্রমবাজারে আসা সকল কর্মী দক্ষ নয়। ফলে, দেশে বিপুল শ্রমশক্তি থাকা সত্ত্বেও দেশিয় শিল্পে দক্ষ শ্রমিকের জন্য আমাদের প্রতিবেশী দেশের কর্মীদের ওপর নির্ভর করতে হয়।
“অন্যদিকে, দক্ষতার ঘাটতির কারণে প্রবাসে বাংলাদেশী কর্মীরা যথাযথ মজুরি পায়না। অভিবাসী শ্রমিকদের সংখ্যানুপাতে বাংলাদেশে প্রবাস আয় প্রবাহ তুলনামূলকভাবে কম।”
এক্ষেত্রে, কর্মসংস্থানবান্ধব কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো এবং এধরনের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা এবং মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন অর্থমন্ত্রী। বলেন, আধুনিক ও বস্তুনিষ্ঠ মাদ্রাসা শিক্ষাও দীর্ঘমেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যসহ আরবদেশগুলোতে মানসম্মত কর্মসংস্থানের সুযোগ লাভের ক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করতে পারে।
অর্থমন্ত্রী জানান, সারাদেশে ১০০টি উপজেলায় ১টি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ নির্মাণ এবং অবশিষ্ট ৩৮৯টি উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
“উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়নের যুগের চাহিদার সাথে সংগতি রেখে তরুণদের নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও উদ্যোগ গ্রহণে উৎসাহিত করা, তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উদ্ভাবিত সামগ্রী ব্র্যান্ডিং ও বাণিজ্যিকীকরণ, মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরির লক্ষ্যে আমরা ‘উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমি’ প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি। উদ্ভাবনভিত্তিক ব্যক্তি উদ্যোগের বিকাশ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প গড়ে তোলা ও কর্মসংস্থানে এটি কার্যকর ভূমিকা রাখবে।”
অর্থমন্ত্রী জানান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/প্রতিষ্ঠান বিভিন্নমুখী ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করার ফলে আত্ম-কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর অর্থাৎ নারীদের উৎপাদন সম্ভাবনার পূর্ণ ব্যবহার করতে আমরা বদ্ধপরিকর বলে জানান অর্থমন্ত্রী। বলেন, যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং আবাসন, সন্তানদের জন্য দিবাযত্ন কেন্দ্র, নারী-বান্ধব গণপরিবহন ইত্যাদি সুবিধা প্রদানের কথা বলেন তিনি।
“গণপরিবহনে নারীদের জন্য নির্দিষ্ট হারে আসন সংরক্ষণ ২০২০ সালে কার্যকর করার জন্য এবারে এক বছর সময় দেওয়া হচ্ছে।”
“ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল নির্মাণ ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র স্থাপন/সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলায় কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল ও শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র নির্মাণ, মিরপুর ও খিলগাঁও কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ, ঢাকার নীলক্ষেতে ১০তলা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলের নতুন ভবন নির্মাণ এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, যশোরে ৪টি হোস্টেলের অবকাঠামো উন্নয়ন।”
“৬৪টি জেলার ৪৯০টি উপজেলায় ১ কোটি গ্রামীণ সুবিধাবঞ্চিত মহিলাদের জন্য তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রবেশাধিকার এবং তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সেবা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।”
বৈদেশিক কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, অভিবাসন ব্যয় হ্রাস এবং অভিবাসন প্রক্রিয়া সহজ ও নিরাপদ করার জন্য আমাদের তৎপরতা অব্যাহত রেখেছি। পূর্ব ইউরোপসহ ৫২টি দেশে শ্রমবাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে গবেষণাসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। বিদ্যমান ৬টি ইন্সটিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি ও ৬৪টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের ৪৮টি ট্রেডে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।
৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার আলোকে অভিবাসনে পিছিয়ে পড়া জেলাসমূহ হতে কর্মী প্রেরণের হার বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান অর্থমন্ত্রী।
অর্থমমন্ত্রী বলেন, জিডিপি ও কর্মসংস্থানে শিল্পখাতের অবদান শক্তিশালী হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই হয় এবং ঝুঁকির আশঙ্কা কম থাকে। আমরা জাতীয় আয়ে শিল্পখাতের অবদান বর্তমান ৩০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে চাই। একই সাথে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানোও আমাদের লক্ষ্য।