জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে শুরু করে মেয়র, চেয়ারম্যান ও মেম্বার পর্যন্ত বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার নজীর স্থাপন হতে শুরু করল। একদিকে নানা লবিং, গ্রুপিং ও অর্থের বিনিময়ে মনোনয়ন কেনার চেষ্টা অন্যদিকে কেউ মনোনয়ন প্রত্যাশী না হওয়া। এই পরস্পর বিরোধী অবস্থান বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে কেন ঠাঁই করে নিলো এবং এটা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করলে আগামী দিনে নির্বাচনী লড়াইয়ের ভবিষ্যত কী।
এ বিষয়টা রাজনীতি,গণতন্ত্র ও নির্বাচন চিন্তকদের ভাবা ও প্রাসঙ্গিক দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ দেয়া খুবই জরুরি হয়ে ওঠেছে। উপর হতে নিচ পর্যন্ত সর্বস্তরের নাগরিকরাই নির্বাচনমুখী। ঢাকায় অবস্থানকারী পদস্থ আমলা, শিল্পপতি, কেন্দ্রীয় রাজনীতিক ইউপি নির্বাচনে এলাকায় যোগাযোগ করা শুরু করে হয়তো তার ভাই, শ্যালক কিংবা বন্ধুকে জেতানোর জন্য।
এলাকায় কখনো যান না গেলেও কারও সাথে দেখা না করে দ্রুতই ঢাকা ফিরে যান যিনি তিনিই নির্বাচন এলে মানুষের দ্বারে দ্বারে ভোট চাইতে যান। মোবাইল নম্বর জোগার করে করে ঢাকায় বসে অনেককে ফোনও দেন। তার পছন্দের প্রার্থীকে জেতানোর জন্য অর্থও খরচ করেন। একজন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী নির্বাচন উপলক্ষ্যে স্থানীয় ব্যবসায়ী, আত্মীয়, বন্ধু ও দলীয়, নির্দলীয় শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিকট হতে অর্থ সহায়তাও পান।
এক কথায় প্রতিটা নির্বাচনেই দেশজুড়ে বিরাজমান থাকে উৎসবের আমেজ। হাটে, মাঠে, ঘাটে, চায়ের দোকানে সর্বত্রই চলতে থাকে নির্বাচনী আলাপ। চায়ের চাহিদা এতবেশী বেড়ে যায় যে চিনি ও চাপাতা কম দেয়া শুরু করে। মানুষ এটাতেও বিরক্ত হয়না বলে নির্বাচনী চা এরকমই হবে। ভাইয়ের সাথে ভাই,চাচার সাথে ভাতিজা, অনেক ক্ষেত্রে পিতাপুত্রের মধ্যেও নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে দেখা যায়।
এমনই একটা সার্বজনীন নির্বাচনী উৎসবে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়া খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত,আশ্চর্যময় ও গনতন্ত্রের লজ্জাজনক ঘটনা। যারা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন এলাকায় জনগণ,নিজের দল ও বিরোধী দলে তারা এতটাই জনপ্রিয় যে তার বিপরীতে দাঁড়ানোর মত কেউ নেই,বিষয়টা কী এরকম। নাকি তার পেশিশক্তিতে ভীত হয়ে কেউ নির্বাচনে দাঁড়ায়নি, বিষয়টা সেরকম।
আরেকটা বিষয় বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করছে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা। দেশজুড়ে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করার মত জনপ্রিয়তা কি বিরোধী দলে একজনও নেই? কিন্তু বাস্তবতা কী বলে। বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় যারা নির্বাচিত হয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলে তাদের অনেকের ভরাডুবি হত। যেখানে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হলেন সেখানে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ কিংবা অপর কোনো দলের প্রার্থী হওয়ার মত কেউ নেই সেটা কে বিশ্বাস করবে।
সব দলের প্রার্থী হওয়ার মতো লোকেরা বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী ব্যক্তিকে পছন্দ করে সমর্থন দিয়েছে সেটাও কে বিশ্বাস করবে। ক্ষমতাবাদী রাজনৈতিক নির্বাচনে ভোটারদের ভোটদান বিষয়ক ভাবনাতেও অনুপ্রবেশ করেছে অগণতান্ত্রিক ধ্যাণধারণা। যেমন অনেক ভোটাররা মনে করছেন যে দল ক্ষমতায় নেই সে দলের প্রার্থীকে বিজয়ী করে লাভ নেই।
বিরোধী দলের এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে এলাকার উন্নয়ন হবেনা। তারা মনে করছেন উন্নয়ন করতে হলে সরকারি দলের জনপ্রতিনিধি লাগবে। এই ভাবনা কি বিরোধী দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মাঝেও সংক্রমিত হয়ে তাদের প্রার্থীতা ঘোষণায় নিরুৎসাহিত করল। এজন্যই কি তারা প্রার্থী না হয়ে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়ার সুযোগ করে দিল?
তারা কি এমনটি ভেবে বসে আছেন যে, দল ক্ষমতায় নেই সুতরাং আমরা এমপি, মেয়র কিংবা চেয়ারম্যান হয়ে কী করতে পারব এলাকার জন্য, কী করতে পারব নিজের জন্য। বাস্তবতা অনেকটা এরকমই বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধির কথা প্রশাসন, পুলিশ কেউ শুনেনা। তার কোনো সালিশের রায়ও কেউ মানতে চায় না। সুতরাং ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার মার্কা এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যান কিংবা মেম্বার হয়ে লাভটা কী।
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার পেছনে যে এরকম ভাবনাই দায়ী তাও নয়। অনেক জায়গায় বিরোধী দল নির্বাচনী প্রচারে যেতে পারেনা। নানা ভয় ভীতি দেখিয়ে বিরোধী প্রার্থী সমর্থকদের সরকার দলীয় প্রার্থীর পক্ষে আনার ঘটনাও ঘটে। সেই সাথে ঘটে প্রার্থীদের চুপসে যাওয়ার ঘটনা। আরও আছে সরকার দলে দল, উপদলীয় বিরোধে নিজ দলীয় প্রার্থীদের প্রার্থিতা বাতিল করানোর ঘটনা।
সব মিলিয়ে এদেশীয় গনতান্ত্রিক নির্বাচনী ধারাটি ক্রমশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে। ৫জানুয়ারির নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি অগ্রসরমান পথে যাত্রা শুরু করেছে এটা যেমন সত্য নির্বাচন ও গণতন্ত্রের সুষ্ঠু বৈশিষ্ট্যও হারাচ্ছে এটাও সত্য। গণতন্ত্র ও নির্বাচন যদি তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হারায় এর পরিণতি ভাল হওয়ার কথা না।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা,উন্নয়ন প্রভৃতির কথা বলে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের চরিত্র খুইয়ে বসলে পরিণতি ভাল হওয়ার কথা না। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার অবস্থা হতে আমাদের বেরিয়ে আসা দরকার। দরকার অবাধ সুষ্ঠু ভোটাধিকার ভিত্তিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনী আবহ।
যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন বিজয়ের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় সেখানে সাময়িকভাবে নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহ সৃষ্টির চেষ্টা করা যেতে পারে। কারণ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতার বিজয়ী প্রার্থীরা জনগণকে তেমন তোয়াক্কা করেনা। এই সুযোগে গণভিত্তিহীন অসাধু লোকরাও জয়ী হয়ে যেতে পারে। গণতন্ত্রের এই লজ্জাটি অবসান করা দরকার এবং সেটি গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থেই জরুরি।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)