দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার ৯৮ ভাগ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্ভর। এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য সরকারি বিধি অনুযায়ী একটি ম্যানেজিং কমিটি রয়েছে। নিয়মানুযায়ী এই কমিটির রয়েছে ব্যাপক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অনেক বেশি থাকায় এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় আসতে আগ্রহী লোকের খুব একটা অভাব হয় না।
বেসরকারি এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, চাকরিচ্যুতি, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন প্রদান, আর্থিক, প্রশাসনিক ও একাডেমিকসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির ওপর। এক সময় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বহন করতেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি। তাই সে সময় শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, চাকুরিচ্যুতির ক্ষমতা পরিচালনা কমিটির ওপর থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক।
এখন অর্থ যোগানের সিংহভাগ আসে সরকারি কোষাগার থেকে। বিশেষ করে, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার শতভাগ সরকার বহন করছে। এছাড়াও, বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ ও সংস্কারসহ অন্যান্য অনেক কিছুতেই সরকারি অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। শিক্ষা বাজেটের বরাদ্দকৃত অংশের একটা বিরাট অংশ খরচ হচ্ছে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে।
এতদসত্ত্বেও, বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির ‘সম্মতি-সই’ এর উপর নির্ভর করে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা। সভাপতি ইচ্ছে করলে যে কোনো শিক্ষকের বেতন-ভাতা বন্ধ করার ক্ষমতা রাখেন । সরকারি কোষাগারের অর্থ ব্যায়ে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হলেও পরিচালনা কমিটির কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বিন্দুমাত্র কমানো হয়নি ।
নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে আশা জাগানিয়া অনেক ভালো কথার মধ্যেও দু’টি সাংঘর্ষিক অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে – ১) ‘বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটিকে প্রয়োজনে অধিকতর ক্ষমতা দিয়ে জোরদার করা হবে,’ ২) ‘মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনের ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তৃত্বকে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যন্ত বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে’। শিক্ষানীতির এ দু’টো অঙ্গীকার স্পষ্টতই সাংঘর্ষিক ও অবাস্তব। এমনিতেই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটির যে ক্ষমতা, তার প্রেক্ষিতে অনেক ক্ষেত্রেই শিক্ষা প্রশাসন বিদ্যালয় দেখভাল করায় তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে গঠিত বাছাই কমিটিতে সরকারি প্রতিনিধি থাকলেও বাছাই কমিটির সুপারিশ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি মানতে বাধ্য নন। তারপরও পরিচালনা কমিটিকে আরও অধিকতর ক্ষমতা দেয়া হলে শিক্ষা প্রশাসনের ক্ষমতাকে খেলো করা হয়! যা মোটেই ঠিক হবে না।
বেসরকারি পরিচালনা কমিটিতে যারা আসেন, প্রচলিত নিয়মানুযায়ী তাদের যোগ্যতা বিশেষ করে কমিটির সদস্য ও সভাপতির শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে কমিটি গঠন সংক্রান্ত বিধিতে স্পষ্টত কোনো আলোকপাত করা হয়নি। অভিভাবক সদস্য হতে হলে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে কোনো একজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক হলেই চলে। কিন্তু সভাপতি হতে গেলে তারও প্রয়োজন পড়ে না।
আমাদের সমাজের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটির সভাপতির পদ দখলের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় এমপি/মন্ত্রী মহোদয়কে ব্যবহার করা এখন স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও সভাপতি নির্বাচনের ক্ষমতা বিভিন্ন ক্যাটাগরি থেকে নির্বাচিত সদস্যের ওপর বর্তিত। তা সত্ত্বেও প্রায় সকল জনপ্রতিনিধিই এ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে থাকেন।
বিদ্যালয়ের সভাপতি নির্বাচনে স্থানীয় জনপ্রতিনিধির প্রভাব বা ডিও লেটার প্রদানের ঘটনা নতুন কিছু নয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির আস্থাভাজন না হলে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতির পদ পাওয়া কঠিন ব্যাপার। এক্ষেত্রে স্থানীয় এমপির মনোনীত ব্যক্তি – তিনি ব্যক্তিগত যোগ্যতায় যত নগণ্যই হোন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে তার নিয়োগ ঠেকানো কারও পক্ষেই সম্ভব হয়ে ওঠে না!
যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বর্তমান শিক্ষানীতিতে অনেক ভালো ভালো অঙ্গীকার ও স্বপ্নের কথা বলা হয়েছে! এসব অঙ্গীকার ও স্বপ্নের দিকে নজর দিলে নিজের আত্মবিশ্বাসটা শক্ত ভিত্তি খুঁজে পায়। একটি শিক্ষিত প্রজন্ম গড়ে তোলার পেছনে নিজের শিক্ষক সত্ত্বাটিকে গর্বিত মনে হয়। কিন্তু একই সঙ্গে চরম হতাশা বিরাজ করে, যখন দেখি বিদ্যালয় পরিচালনা সংক্রান্ত কমিটির ব্যাপারে বহু আকাঙ্ক্ষার শিক্ষানীতি একেবারেই পশ্চাদপদ নীতি আঁকড়ে ধরে রেখেছে! অবিশ্বাস্য ঠেকে যখন দেখি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় যারা থাকবেন, তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে মোটেই আমলে নেয়া হয়নি !
বলা বাহুল্য, দেশের অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে একদল অশিক্ষিত কিংবা অর্ধ শিক্ষিত গোষ্ঠী দ্বারা যারা বর্তমান দাপুটে রাজনীতির বাহুবলে একেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে রূপ দিয়ে যাচ্ছে! শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেন এখন আর শিক্ষা বিস্তারের বাতিঘর নয়, বরং কিছু নির্দিষ্ট মানুষের টাকা কামানোর আড়তদারি! দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থার পিছনে খোদ শিক্ষামন্ত্রণালয়ের নীতি নির্ধারকদের নীরব সমর্থন রয়েছে!
সরকার দেশের শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে অনেক ভালো কথা বলছে। যুগোপযোগী শিক্ষানীতি চালু করেছে। আধুনিক ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বড় বড় প্রকল্প হাতে নিচ্ছে। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারীদের আর্থিক সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি করেছে। এর সবই ইতিবাচক দিক। কিন্তু বর্তমানে প্রচলিত বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা বহাল রেখে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ কখনোই নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। এজন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কমিটির কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা কমানোর লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনের সংস্কার ও সংশোধন আনতে হবে।
বর্তমানে চালু কমিটির ‘দাপুটে ক্ষমতা’ দিয়ে জাতিকে মান সম্পন্ন শিক্ষা দেয়া প্রায় অসম্ভব, এই বাস্তবতা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে মানতে হবে। না হলে, উত্তম শিক্ষানীতিও উত্তম শিক্ষা ব্যবস্থার গ্যারান্টি দিতে পারবে না। এটা মোটামুটি নিশ্চিত।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)