আমাদের বিল্ডিং এর পিছনে সবুজঘেরা ছোট্ট একটি পার্ক আছে। বিকেল হলে মাঝেমধ্যে সেখানে গিয়ে বসি। বাচ্চাদের ছোটাছুটি দেখি। একটি সৌম্য শান্ত পরিবেশ। এমনই এক বিকেলে বসে আছি পার্কের বেঞ্চিতে। বেঞ্চির অপর পাশে বসে আছেন বয়স্ক এক ভদ্রলোক, বুকে একটি পপিফুলের ব্যাজ লাগিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদ হওয়া সৈন্যদের স্মরণে নভেম্বর মাসে পপিফুলের ব্যাজটা কানাডায় রিমেবারেন্স ডে উপলক্ষে অনেকেই বুকে লাগায়। অথচ এখন গ্রীষ্মে পপিফু্লের ব্যাজ বুকে লাগিয়ে বসে আছেন বয়স্ক এই ভদ্রলোক।
কৌতূহলবশতঃ একটু কাছে ঘেঁষে ‘হাই’ বললাম। সাথেসাথে ফিরে তাকিয়ে আমাকেও ‘হাই’ বললো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি যদি কিছু মনে না করো,তাহলে একটা প্রশ্ন করতে পারি?’ তখন সে উৎফুল্ল হয়ে বললো,’সিউর’। বললাম,’তুমি এখন পপিফুল পরে আছো কেন?’ ততোধিক খুশি হয়ে সে বললো, ‘ আমি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একজন সৈনিক। আমার নাম জন।
তুমি কি অনুমান করতে পারবে, আমার বয়স কত?’ বলেই আমার দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। আমি অপারগতা প্রকাশ করে হেসে বললাম, ‘না বলতে পারবোনা।’ কিন্তু ভিতরে ভিতরে অবাক কৌতূহলে থিরথির করে কাঁপছিলাম। কারণ আমার সামনে ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী উজ্জ্বল কিংবদন্তী বসে আছেন। কতকিছু জানতে ইচ্ছে করছে, তাঁকে একটু ছুঁয়েও দেখতে ইচ্ছে করছে। তখন জন ধীরেধীরে বলতে শুরু করলো, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমার সহযোদ্ধাদের হারিয়েছি, তাদের প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত স্মরণ করি। আমার বয়স এখন এক’শ সাত। এখনো বেঁচে আছি সেই সমস্ত স্মৃতি বুকে নিয়ে।
অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনছিলাম। হঠাৎ জনের ছেলে এসে আমার দিকে তাকিয়ে ‘সরি, আমাদের এখন যেতে হবে’, বলে, জনের হাত ধরে তুলে নিয়ে গেলো। পরে আরো কয়েকদিন বিকেলে পার্কে গিয়ে জনের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম , কিন্তু জন আর আসেনি। প্রতিবছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হারানো সৈন্যদের কথা কানাডা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে নভেম্বর মাসব্যাপী বুকে পপিফুল পরে এবং ১১ নভেম্বর সকাল এগারোটা এগারো মিনিটে সমস্ত কানাডায় এক মিনিটের নীরবতা পালন করা হয়। জনকে আর কখনো দেখিনি তবে পপিফুলের মতো আমাদের বিজয়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বিজয়ফুলকে পেয়েছি, যার প্রণেতা কবি শামীম আজাদ।
দেশের স্বার্থে, মানুষের স্বার্থে যারা যুদ্ধ করে মৃত হয়েও বিজয়ীবেশে বেঁচে আছেন কোটিকোটি জনতার মাঝে তাঁদের স্মৃতি বুকের মাঝে জ্বলজ্বল করবে, এটাই স্বাভাবিক। যদিও তারা মননে মগজে জেগে আছেন, তারপরেও শ্রদ্ধার একটু বহির্প্রকাশ এই পপিফুল বা বিজয়ফুল। ঠিক এমন একটি বিষয় কবি শামীম আজাদের মাথায় খেলে গেলো।
পপিফুল নিয়ে কোনো এক লেখায় তিনি উল্লেখ করেন, “ক’বছর আগের এক শীতার্ত নভেম্বর। হুইল চেয়ারে করে ব্রিটিশ রয়্যাল লিজিওনের হয়ে মহাযুদ্ধের স্মারক টুকটুকে লাল কাগজের পপি বিক্রি করছিলেন ইংরেজ বৃদ্ধ টেড স্টকওয়েল। নিজেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ফেরত আহত সেনা। তার কাছেই শুনেছিলাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পর প্রাণহীন বিশুষ্ক ভূমিতে প্রথম ফোটা ফুলের নাম ছিল পপি। সেই থেকেই হাতে তৈরি পপি বিক্রি করে এক ক্যানাডিয়ান নারী তার বিক্রয়লব্ধ অর্থে মৃত সৈনিকদের সন্তানদের জন্য কিনেছিলেন প্রথম ক্রিসমাস উপহার। সেইতো শুরু।
তারপর খুব জানতে ইচ্ছে করে, একাত্তরের ডিসেম্বরে সেই বিস্ময়কর সময়ে গাছে গাছে অথবা কাননে ছিল কি অনুরূপ কোন লাল ফুল? না হলেও ক্ষতি কী? ডিসেম্বরেইতো ফুটেছিলো বাংলাদেশের সবচাইতে সুন্দর ফুল। পতাকার ঘন সবুজে যে রক্তিম সূর্য উঠেছিল, তারই রূপকল্পেই তো হতে পারে আমাদের ’বিজয় ফুল’।’
নয়মাস যুদ্ধে ঘনসবুজের উপর রক্তাক্ত দাগ,যা রক্তিম সূর্য হয়ে ফুটে উঠলো আমাদের লালসবুজ পতাকায়। পপিফুলের ধারণা থেকে পাঁচটি সবুজ পাপড়ি এক লাল বৃত্তে অর্থাৎ সূর্যটাকে ঘিরে বাংলার সবুজ বনানী ধরা পড়ে আছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রতীক হিসেবে যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘বিজয়ফুল’। বিশ্বযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারীদের স্মরণে বৃটেনে পপিফুলের আদলে ’বিজয় ফুল’ চালু করার ধারণা মূলত বৃটেন প্রবাসী কবি শামীম আজাদের।
পপিফুল বিক্রি করে সে অর্থ যুদ্ধে আহত কিংবা নিহত পরিবারের হাতে তুলে দেয়ার রীতি। ঠিক তেমনই বিজয়ফুল বিক্রি করে সেই অর্থ আমাদের মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের হাতে তুলে দেয়ার রীতি প্রচলন করা হোক। বছর ঘুরে এলেই প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের এক তারিখ থেকে ‘বিজয়ফুলের’ কর্মসূচি নেওয়া হয়।
প্রথমে এর যাত্রা লন্ডনে শুরু হলেও এখন বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রবাসী বাংলাদেশীরা বিজয়ফুল কর্মসূচি গ্রহণ করে বিজয়দিবসের মাহত্ম তুলে ধরছেন। কাগজের তৈ্রি হলেও এটি বহন করছে আমাদের ঐতিহাসিক একাত্তরের বিজয়ের স্মৃতি। এই বিজয়ফুলকে ঘিরে প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসে নতুন প্রজন্মের কাছে অনেক ঐতিহাসিক কথা উঠে আসবে, উঠে আসবে একাত্তরের বিজয়গাঁথা। তাই বিজয়ফুল হোক আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের প্রতীক।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)
আঞ্জুমান রোজী