সদ্য প্রয়াত তারামন বিবিসহ পরলোকগত ও জীবিত সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। দীর্ঘ ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভ করে বীর বাঙালি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল চারটা ২১ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লে. জেনারেল নিয়াজী মুক্তিবাহিনীর নিকট ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আত্নসমর্পন করে এবং এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের জয়লাভ সুনিশ্চিত হয়। এই ডিসেম্বরের মাসেই আমাদের পরম কাঙ্খিত বিজয় নিশ্চিত হয়, বাঙালি জাতির জীবনে পরম আরাধ্যের বিষয় মহান স্বাধীনতা প্রাপ্তি। এই বিজয়টি অর্জনের জন্য আমাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। আর প্রত্যেকটি ধাপে বাঙালি জাতি তাদের দেশপ্রেমের সর্বোচ্চ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রণ্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধে জয়লাভ প্রত্যেকটি সংগ্রামে বাঙালি জাতি তাদের সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে এবং যার সামস্টিক পরিণতি আমাদের আজকের বাংলাদেশ।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সমগ্র বিশ্বের জন্য উদাহরণস্বরূপ হিসেবে স্বীকৃত এবং মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বিশ্বে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বাদ পায়। একমাত্র দেশপ্রেমের বদৌলতে যে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভবপর হয়ে উঠে তারও একমাত্র ব্যতিক্রম উদাহরণ বাংলাদেশ।
যুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরির মুহুর্তের শুরু থেকেই বাংলাদেশ সব ধরনের শক্তিমত্তায় পাকিস্তানের তুলনায় পিছিয়ে ছিল এবং ১৯৪৭ সালের পর হতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানকে নানাভাবে অত্যাচার, শোষণ, বৈষম্য, জাতিগত নিপীড়ন ও নির্যাতনের স্টিম রোলার চালিয়েছিল। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালি জাতি সংগ্রামী মানুষের প্রতীক হয়ে তাদের উপর বর্বরোচিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। প্রতিরোধের স্তম্ভ হিসেবে দেশপ্রেমিক বাঙালি মাত্রই যুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকেন এবং তৎকালিন সময়ে ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে জাতীয় নেতা পর্যন্ত জনগণকে একীভূত করে সমর যুদ্ধের সর্ব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। আর যাঁর নেতৃত্বে ছিলেন বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের জগদ্বিখ্যাত ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন এবং ২৬ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন এবং তারই আহ্বানে বাঙালি জাতি সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, ৩০ লাখ মানুষের জীবন, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে পেয়েছি আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ। আর সেই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার দায়িত্ব বর্তমান প্রজন্মের।
মুজিবনগর সরকারের প্রত্যক্ষ দেখভাল এবং সুষ্ঠু পরিচালনায় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে উঠে। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে নিজ উদ্যোগে ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেন। ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রশিক্ষণ শেষে বাংলাদেশে এসে কোথায় যুদ্ধ করবেন তাঁর ব্যবস্থাকরণ মূলত মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমেই হয়। সেসময় যারাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছিলেন তারা প্রত্যেকেই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সারথি। রণাঙ্গনের যুদ্ধের পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে অনেকেই তাদের মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল। কেউ গান গেয়ে, কেউ কবিতা লিখে, কেউবা মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়ে আবার অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সংগ্রহ ও রান্না করে সহযোগিতা করেছেন, পাশাপাশি জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়ে তথ্য আদান প্রদানের কাজও করেছেন। তাদের প্রত্যেকের অবদান বাংলাদেশের মানুষ আজীবন স্মরণ রাখবে স্মৃতির মানসপটে। কারণ আজ আমরা যে বাংলাদেশ দেখতে পাচ্ছি বা বসবাস করছি তা কিন্তু ঐ সময়ে থাকা মানুষদের ত্যাগ ও সংগ্রামের ফলস্বরূপ।
আমরা যারা স্বাধীনতা সংগ্রাম দেখিনি বা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাইনি তারা কিভাবে স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারি। কারণ স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। আমাদের দায়িত্ব স্বাধীনতাকে রক্ষা করা তথা স্বাধীনতাকে অর্থবহ করা অর্থাৎ স্বাধীনতা যে আমাদের প্রয়োজন ছিল সেটার উপযুক্ত স্বাক্ষর সকলের সামনে তুলে ধরার মাধ্যমে দেশপ্রেমের প্রগাঢ়ত্বে দেশের জন্য নিজ যোগ্যতায় অবদান রাখা। তাহলেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানানো হবে, বিজয় দিবস উদযাপনের সঠিকতা নিশ্চিত হবে। দেশপ্রেমের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে দেশের জন্য কাজ করে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের মর্যাদা আরো সুসংহত করতে হবে।
নতুন প্রজন্মের নিকট বিজয়ের মাসের বার্তা কেমন হওয়া উচিত? আমার যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, তাদের কী করা উচিত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্ন পূরণে? এক কথায় বললে বলা যায়, নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করলেই দেশপ্রেমিক বীরদের প্রতি সম্মান জানানো সম্ভব হবে। ধরুন, একজন সাব-ইন্সপেক্টর যদি আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, জনগণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখে, জনবান্ধব পুলিশিং এর জন্য কাজ করে থাকে, ভিক্টিমের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার থাকে, অপরাধীকে আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করে থাকে তাহলেই তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের সার্থকতা রক্ষা করার প্রচেষ্টায় একজন সৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ।
আর তিনি যদি কর্তব্যের প্রতি অবহেলা করে, ঘুষ খেয়ে মামলা ভিন্ন দিকে ছড়িয়ে দেন তাহলে সেটা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি চরম অসম্মানের। এ রকমভাবে আমাদের প্রত্যেকের পেশার কর্মদক্ষতা ও দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বিজয়ের মাসের যথার্থতা মূল্যায়ন করতে পারি আবার কাজের প্রতি অবহেলা ও দায়িত্বহীন কর্মকান্ডের মাধ্যমে বিজয়ের মাসের অবমূল্যায়ণ করতে পারি।
রাষ্ট্রের নিকট বিজয়ের মাসের বার্তা কেমন হওয়া উচিত? এককথায় উত্তর দেওয়া যায়, সকল ধর্ম, বর্ণ, পেশা, শ্রেণির মানুষের সহাবস্থান নিশ্চিত করা। সকল মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করা। হত্যা, গুম, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, অপহরণ, চাঁদাবাজি সহ যে কোন ধরনের সহিংস অপরাধকে রাষ্ট্র থেকে দূর করতে হবে। প্রত্যেক মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, মৌলিক অধিকারগুলো সকলেই যেন সমানভাবে ভোগ করতে পারে তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তা না হলে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ ও শহীদদের রক্তের সাথে বেইমানি করা হবে। কাজেই রাষ্ট্রকে মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে এবং কল্যাণকর রাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করতে হবে। চিকিৎসার অবহেলায় যেন কারো মৃত্যু না হয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে যেন কারো মৃত্যু না হয় সে ব্যাপারগুলোও নিশ্চিত করতে হবে রাষ্ট্রকেই।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণকে কেন্দ্র করে সারাদেশের প্রতিটি জায়গায় আলোচনায় সরগরম হয়ে উঠছে প্রতিটি এলাকা। এখনো প্রচারণা শুরু না হলেও প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা ও নির্বাচনের বাতাস বইতে শুরু করেছে। এ নির্বাচনের একটি বিশেষত্ব হচ্ছে নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়ার্জনের মাসে। নির্বাচনে কেমন প্রার্থীদের ভোট দিবে নতুন প্রজন্ম সে নিয়ে বেশ হিসাব নিকাশ কষছে নির্বাচনে আসা দলগুলো। কারণ, প্রত্যেক দলের নিজস্ব একটি ভোট ব্যাংক রয়েছে। এর বাইরে বড় অংকের ফ্লোটিং (ভাসমান) ভোটার রয়েছে যাদের অধিকাংশই তরুণ প্রজন্ম এবং এদের ভোটের মাধ্যমেই অনেক সময় প্রার্থীর জয় পরাজয়ের হিস্যা নির্ধারিত হয়ে থাকে। নানামুখী হিসাব নিকাশ করেই তরুণরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন।
তবে আমার কাছে মনে হয়, নতুন প্রজন্মের ভোটাধিকার প্রদানের পূর্বে বেশ কিছু মানদণ্ডকে সামনে রেখে ভোট প্রদান করা উচিত।
প্রথমত: যারা বাংলাদেশের জন্মে বিশ্বাস করে না, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করে না তথা যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত ইস্যুতে সম্পৃক্ত তাদেরকে ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকা।
দ্বিতীয়ত: যে সকল প্রার্থীরা জঙ্গীবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত কিংবা জঙ্গীবাদের মদদদাতা হিসেবে চিহ্নিত তাদেরকে ভোট না দেওয়া।
তৃতীয়ত: ঋণখেলাপী, দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত, ভূমিখেকো, ভূমিদস্যু, হলফনামায় মিথ্যা তথ্য দিয়ে মনোনয়ন ফরম জমাদান, পূর্বে কোন গুরুতর অভিযোগে প্রমাণিত তাদেরকে ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকা।
চতুর্থত: বর্ণচোরা প্রার্থী অর্থাৎ যারা কিছুদিন পর পর ব্যক্তিগত চরিতার্থ সাধনের জন্য দলীয় খোলস পাল্টিয়ে ক্ষমতাকে মুখ্য হিসেবে বিবেচনা করে তাদেরকে অবশ্যই ভোট প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ, এ সকল প্রার্থীরা ভোটে জিতে আসলে দেশের জন্য মঙ্গলজনক কিছু বয়ে আনবে না, তা হলফ করেই বলা যায়।
শেষত: জনগণের সাথে যাদের সম্পৃক্তায়ন নাই অর্থাৎ মৌসুমি পাখির ন্যায় প্রার্থী যে দল থেকেই মনোনয়ন দেওয়া হোক না কেন তাদেরকে অবশ্যই বর্জন করা উচিত। কারণ, রাজনীতি একটি সাধনার বিষয়, সাধনা করেই জনগণের মন জয় করতে হবে। অন্যথায়, এরূপ রাজনীতিবিদেরা রাজনীতির জন্য ইতিবাচক উদাহরণ হবেন না, নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে তরুণ প্রজন্মের উপর। কাজেই ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া উচিত বলেই মনে করি।
উপরোক্ত আলোচনায় ইহাই প্রতীয়মান হয়, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার দায়িত্ব বর্তমান প্রজন্মের। মুক্তিযোদ্ধাদের আত্নত্যাগ ও এই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পটভূমিকায় যে সকল মহান মানুষ তাদের জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছেন তাদের সকলের প্রতি বিজয়ের মাসের লগ্নে আন্তরিক অভিবাদন ও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। নতুন প্রজন্মের প্রত্যেক সেনানিকে নিজস্ব দায়বদ্ধতা প্রতিপালন ও পেশাগত কর্তব্য পালনের মাধ্যমেই বিজয়ের মাসে বীর সেনানীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানানো হবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)