চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

বিজ্ঞানী হতে চাওয়া মেয়েটির সাহসী পুলিশ কর্মকর্তা হয়ে ওঠার গল্প

হালকা পাতলা গড়নের সদা হাস্যোজ্বল একটি মেয়ে। গড়ন ও হাসিতে সাধারণ মনে হলেও বড় বড় অপরাধী ঘায়েল করতে সিদ্ধহস্ত বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে যোগ দিয়ে বর্তমানে র‍্যাবে কর্মরত শাহেদা সুলতানা। বড় বড় অভিযানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তিনি। সাহসিকতার জন্য ২০১৬ সালে পেয়েছেন ‘র‌্যাব সাহসিকতা পুরস্কার’। ২০১৭ সালে পেয়েছেন ‘প্রেসিডেন্সিয়াল পুলিশ মেডেল’। ছিপছিপে গড়নের এই নারীকে দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি র‌্যাবে থেকে এতোসব গুরুত্বপূর্ণ সাহসী কাজ করে যাচ্ছেন সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে।

তবে ছোট থেকে বিজ্ঞানী হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তার জীবনের প্রথম চাকরি শুরু করেন বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে। ৩০তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত এ কর্মকর্তা বর্তমানে র‌্যাব-৭ এর একমাত্র নারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ভীষণ ইতিবাচক এই নারী বিশ্বাস করেন, অসম্ভব বলে কিছু নেই।

চট্টগ্রামের লোহাগড়ার মেয়ে শাহেদার বাড়ি চুনতি গ্রামে হলেও তার বেড়ে ওঠা বন্দরনগরী চট্টগ্রাম শহরের চকবাজারে। ড. খাস্তগীর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০০ সালে এসএসসি ও চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ২০০৩ সালে এইচএসসি পাশ করেন। অসুস্থতার কারণে ১ বছর পড়াশোনায় বিরতি পড়ে যায়। সেসময় কিছুটা বিষণ্ণ হয়ে পড়লেও নিজের দৃঢ় মনোবলে ঘুরে দাঁড়ান তিনি। এরপর পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিদিন শাটল ট্রেনে চেপে যাওয়া আসা করতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

ইচ্ছে ছিল স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে গবেষণা করার। সে লক্ষ্যেই নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন। কিন্তু এর মাঝে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াকালে জানতে পারেন বিসিএস সম্পর্কে। সেসময় ট্রেনে চেপে বিশ্বদ্যিালয়ে যাওয়া আসার পথে দেখতে পান, পুরো ট্রেনের সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে কী যেন পড়ালেখায় ব্যস্ত। পড়াশুনায় সবার দক্ষতা দেখে ভীষণ অবাক হয়ে যান শাহেদা।

শাহেদার ভাষায়: ‘আমার বন্ধুরা দেখতাম সবাই সব দেশের রাজধানীর নাম একনাগাড়ে বলতে পারতো’, আমি কিছুই পারতাম না। আর সেখান থেকেই শুরু। এরপর গভীর মনোযোগে তিনি শুরু করেন বিসিএসের প্রস্তুতি। তবে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী হওয়ার সুবাদে অংক, ইংরেজি ও বিজ্ঞান নিয়ে ভাবতে হয়নি খুব বেশি। বাংলা, বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী আয়ত্ত্বের বাইরে থাকায়, সেসব বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করেছেন বিস্তর।

তার মাস্টার্স পরীক্ষা এবং বিসিএস লিখিত পরীক্ষা চলছিল একসাথে। বিপাকে পড়ে যান সেদিন, যেদিন একই দিনে তার মাস্টার্স ও বিসিএস লিখিত পরীক্ষার তারিখ পড়ে যায়। সেদিন শিক্ষকদের অনেক বুঝিয়ে, অনুরোধ করে মাস্টার্সের সেদিনের পরীক্ষার তারিখ পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী শাহেদা।

তবে নিজের স্বল্প ওজন নিয়ে বেশ টেনশনে ছিলেন শাহেদা। বিসিএস মৌখিক পরীক্ষার কিছুদিন আগেই ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক পদে মৌখিক পরীক্ষা দেন তিনি। সেসময় ভাইভা বোর্ডে তাকে প্রথম যে কথাটি বলা হয়েছিলো তা হলো: ‘ইয়ং লেডি, ডু ইউ নো ইউ আর সো স্লিম’।

তবে আশঙ্কা থাকলেও বিসিএসের ভাইভা বোর্ডে এ ধরণের কোন কিছু শুনতে হয়নি তাকে। নিজের প্রতি বিশ্বাস, একাগ্রতা আর স্বামী সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরীর সহযোগীতায় চূড়ান্তভাবে সফল হন তিনি।

মুক্তমনের অধিকারী স্কুল শিক্ষক বাবা শামসুল হুদা ও মা লায়লা বেগমের ৪ সন্তানের মধ্যে শাহেদা দ্বিতীয়। ছোট থেকেই সন্তানদের উপর কিছু চাপিয়ে দেননি বাবা-মা। তবে কৌশলে আলোকবর্তিতা হয়ে কাজ করেছেন সবসময়।

বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে সফল হয়ে, বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে যান সারদা পুলিশ একাডেমিতে। তবে একাডেমিতে গিয়ে প্রথম দিনই তীব্র জ্বরে আক্রান্ত হন তিনি। জ্বরের কারণে প্রথম তিনদিন প্রশিক্ষণে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকতে হয় তাকে। তবে দিনশেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত রুমমেটের কাছে সারাদিনের বিবরণ শুনে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন তিনি।

ট্রেনিং শুরু করার পর দুর হয়ে যায় সব ভয়। কোনরকম শারীরিক অসুস্থ্যতা, আঘাত ছাড়াই সম্পন্ন করেন ট্রেনিং। তার এ দক্ষতার কারণে ব্যাচমেটরা তাকে ‘আয়রন লেডি’ বলে ডাকতো।

প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দেন কর্মক্ষেত্রে। শুরুতে পুলিশে থাকলেও ২০১৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যোগ দেন র‌্যাব সাতে। বর্তমানে তিনি র‌্যাব সাতে সিনিয়র এএসপি হিসেবে কর্মরত।

র‌্যাব সাতের নানা অভিযানে নেতৃত্ব দেয়া এ নারী দেশের জন্য, রাষ্ট্রের জন্য কাজ করতে পারার মাঝেই খুঁজে পান আনন্দ। সময়টাকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হসেবে উল্লেখ করেন এ কর্মকর্তা। প্রচণ্ড ধৈর্যশীল এ নারীর কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ তার সহকর্মীরা।

নারী দিবসে সকল নারীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি বলেন: ‘কোনকিছুতেই ভয় পাওয়া যাবে না। ভয়কে জয় করে এগিয়ে যেতে হবে নারীদের।’

পিছিয়ে পড়া বলতে কিছু নেই উল্লেখ করে র‌্যাবের এ নারী কর্মকর্তা বলেন: ‘প্রত্যেকের আলাদা আলাদা গুন রয়েছে। প্রত্যেক মানুষই সম্ভাবনাময়। তবে তাদের নিজেদের ভেতরের শক্তিটা আবিষ্কার করতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে সেই শক্তির ব্যবহার করলে সফলতা আসবেই।’