দুবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করা দলটি একাদশ সংসদ নির্বাচনে মাত্র ৬টি আসন পেলো৷ কেন বিএনপির এই অবিশ্বাস্য ভরাডুবি? তাদের দাবি ছিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন৷ তারা বলে আসছিলো দলীয় সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে অংশ নেবে না৷ কিন্তু এ দাবিতে অনড় থাকতে না পেরে দলীয় সরকারের অধীনেই ইউপি নির্বাচন, পৌর নির্বাচন, উপজেলা নির্বাচন, সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে সর্বশেষ একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে এই অবিশ্বাস্য ভরাডুবির মুখোমুখি হলো৷ এই পরাজয়ে থমকে গেছে দলটি৷
বিএনপি নেতারা বলছে, সরকারি দলের ভয়ভীতি প্রদর্শন, মামলা হামলা, এজেন্ট শূন্য কেন্দ্র ও কেন্দ্র দখলের কারণে ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি বলেই তাদের এই পরাজয়৷ যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে ২০১৪ সালে নির্বাচন বর্জন করেছিল ২০১৮ সালে এসে সরকার দলের প্রতি বিশ্বাসযোগ্যতার এমন কী অর্জন তারা পেল যে, যার প্রেক্ষিতে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল দলটি? নির্বাচন নিয়ে তাদের অভিযোগগুলো কোথাও কোন পাত্তা পেল না৷ আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক, বিভিন্ন দেশ এমন কি জাতিসংঘও এ সরকারকে মেনে নিল৷ দলটির কেন এই বেহাল অবস্থা?
বিএনপির যুদ্ধাপরাধী ও জামাত সঙ্গের কারণে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষগুলো এ দলটির প্রতি বিমুখ ছিল৷ আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সাফল্যের সাথে প্রচার করতে সক্ষম হয়েছে যে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আবার জেগে উঠবে জঙ্গিবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি৷ তাই তাদের ক্ষমতায় যাওয়া ঠেকাতে হবে৷ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের জঙ্গি কানেকশনের তথ্যও তারা অত্যন্ত সাফল্যের সাথে আন্তর্জাতিক মহলকে তুলে ধরে বিএনপির প্রতি তাদের নেগেটিভ দৃষ্টিভঙ্গী সৃষ্টিতে সক্ষম হয়৷ বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশে রক্তগঙ্গা বইবে ইত্যাদি কথা বলে নেতাকর্মীদের তুমুলভাবে সক্রিয় করতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ৷ তাই হয়তো তাদের নেতাকর্মীদের মাঝে এই বোধ জাগিয়ে দেয়া হয় যে গণতান্ত্রিক নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে হলেও বিএনপির ক্ষমতা যাওয়া ঠেকানো প্রয়োজন৷বিএনপিও সাংগঠনিক ও জোটগতভাবে এগুলো মোকাবেলা করতে পারেনি৷
যে জামাতকে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করল বিএনপি তাদেরকেই ধানের শীষ প্রতীক দিয়ে দিল৷ এতে ক্ষুব্ধ হলো জামাত বিরোধীরা৷ বিএনপির কি এটি না করলে হতো না? জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন এখন বলছেন, জামাত আছে জানলে তিনি ঐক্যফ্রন্টের দায়িত্ব নিতেন না৷ তবে কি বিএনপির জামাতকে প্রতীক দেয়া প্রসঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের সাথে কোন আলোচনাই হয়নি? নাকি ড. কামাল দায় এড়াতে এমন কথা বলেছেন? ২০ দল, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এই ভরাডুবির জন্য দলীয় সরকারের দলীয় ক্ষমতাবাজী যেমন দায়ী তেমন দায়ী তাদের ভুল রাজনীতি ও সাংগঠনিক দুর্বলতাও৷
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবিকে কেন্দ্র করে দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের প্রতি অনাস্থা, ভাঙন, পরস্পর বিরোধিতার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে৷ বিএনপির এই বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে ফেরাতে তারেক রহমানকে কমপক্ষে ২ বছরের জন্য রাজনীতি থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী ও বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত এই রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে দলটির উচিত এখন কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা যেখানে বেগম জিয়া থাকবেন এমিরেটাস চেয়ারপার্সন। নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিএনপির সাংগঠনিক সামর্থ্যের বিষয়টি। এ নিয়ে দলের অভ্যন্তরেই চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এ অবস্থায় দ্রুত কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব তৈরির তাগিদ দিয়েও চলেছেন নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কেউ কেউ। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীরও মত দল ঢেলে সাজানোর পক্ষে। বর্তমান পরিস্থিতি, বয়স ও তার শারীরিক সামর্থ্যের বিষয়টি বিবেচনা সাপেক্ষে বেগম জিয়াকে এমিরেটাস চেয়ারপার্সন রেখে দলের যোগ্য কাউকে চেয়ারম্যান করার তাগিদ তার।
ডাঃ জাফরুল্লাহ মত দেন, খালেদা জিয়া এমিরেটাস চেয়ারপার্সন হতে পারেন, যেহেতু উনি দেশেই আছেন, উনার পরামর্শ মধ্যে-সধ্যে পেতে পারবেন তারা। আশা করি ২/১ মাসের মধ্যে তিনি বেরিয়ে আসবেন। উনার শারীরিক অবস্থা এবং সবকিছুর কারণে, আমি মনে করি তার নতুনভাবে করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমিরেটাস অধ্যাপক থাকে না? এখানেও উনি এমিরেটাস চেয়ারপার্সন হবেন।কিন্তু খালেদা জিয়া এমিরেটাস চেয়ারম্যান হবেন আর তারেক রহমান ২/১ বছর রাজনীতি হতে দূরে থাকবেন এটাই কি সমাধান?তারা কি পারবে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও জামাতকে ত্যাগ করতে?তারেক রহমানের জঙ্গি সংশ্রবের দাগ কিভাবে মুছবে তারা?বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক ভোটাররা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির বিজয়ও চায় গণতন্ত্রও চায়৷ এবারের নির্বাচনে অগণতান্ত্রিক আচরণগুলোকে সমর্থন করেনা তারা? বিএনপি কি পারবে তাদের এতদিনের ভুল রাজনীতিকে পরিহার করে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় একটি যথার্থ গণতান্ত্রিক দলে পরিণত হতে? তা হতে না দিয়ে বিরোধিতার জন্য বিরোধিতার বাহুল্য কথাবার্তায় দলের কী উপকার হবে? দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আরাফাত রহমান কোকো কোনো রাজনীতিবিদ ছিলেন না। তিনি একজন ক্রীড়া অনুরাগী ও ক্রীড়া সংগঠক ছিলেন। রাজনীতি থেকে দূরে থেকে ক্রীড়াঙ্গনকে শক্তিশালী করতে কাজ করেছেন। বিশেষ করে ক্রিকেটের উন্নয়নে তার অবদান জাতি স্মরণ করবে। কোকোর মৃত্যু স্বাভাবিক হয়নি। তাকে মানসিকভাবে নির্যাতন করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে৷
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অবশ্য বলেছেন, জিয়ার পরিবার, জাতীয়তাবাদের ধারক বাহক ও জাতীয়তাবাদী শক্তির উপর আওয়ামী লীগ বারবার আঘাত করেছে। তারা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেছিলো। খালেদা জিয়াকে দীর্ঘদিন করাগারে আটকে রেখেছে। তারেক রহমানকে নির্যাতন করেছে। কোকোর উপর নির্যাতন করে মৃত্যুর পথ রচনা করেছে।
তিনি আরও বলেছেন, আওয়ামী লীগকে পরাজিত করতে হবে, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে হবে, তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে৷
এসব কথার মানে কী? জিয়াকে কি আওয়ামী লীগ হত্যা করেছে? তারেক রহমানকে নির্যাতন করেছে ওয়ান ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার৷ এতদিন পর কেন বলছে, আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুও কোন স্বাভাবিক মৃত্যু নয়৷ এসব কথায় বিএনপির কি দলীয় কোন লাভ হবে? তবে কেন অযথা এই বাহুল্য কথন? বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা ও বাহুল্য কথা না বলে বিএনপি কি পারবে পরাজয় হতে শিক্ষা নিয়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষার সাথে নিজেদের মেলাতে? তারা কি পারবে জনগণের দাবি নিয়ে সরকারের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় রাজপথে সরব হতে? তারা পারবে কি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে বর্জন করতে? পারবে কি জামাতকে ২০ দল হতে বাদ দিতে?
দলটির উত্থান হয়েছিল ক্ষমতার মাধ্যমে পতনও হতে যাচ্ছে ক্ষমতা হাতছাড়া হওয়ায় অন্যের ক্ষমতার মাধ্যমে৷ জিয়া ক্ষমতাগ্রহণ করে দলটির প্রতিষ্ঠা করেন৷ তখন তিনি রাজনীতিকে কঠিন করে তোলার কথা বলতেন৷ আজ সেই রাজনীতি বিএনপির জন্যই কঠিন হয়ে গেছে৷ তারা কি পারবে এই কঠিন অবস্থা হতে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে?কেবল সম্মেলন করে নেতৃত্ব বদল করলেই এই কঠিন অবস্থা সহজ হবে না৷ আদর্শিক গতিপথ ও সঙ্গ ঠিক করতে হবে৷ একটি পুরনো কথা আছে যে লোক চিনতে হয় সঙ্গ চিনে৷ সঙ্গ দোষেই দেশিবিদেশি সমর্থন পেতে ব্যর্থ হয়েছে বিএনপি৷ কোন সে সঙ্গ? সে সঙ্গ হচ্ছে জঙ্গিবাদ, জামাত ও স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি৷ তাই নয় কি? বাংলাদেশে গণতন্ত্রও আজ কঠিন সময় পার করছে৷ যেখানে জনগণের সরকার দল ও বিরোধী দল নির্ধারণ করে দেয়ার কথা সেটিও হচ্ছেনা৷ স্বাধীনভাবে ভোটারদের ভোটদানের রীতিও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে৷
দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র দুটোই চায়৷ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের ভিত্তিতে জয়লাভের পরও সরকার গঠন করতে না দেয়ার অগণতান্ত্রিক রীতির মধ্য দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা৷ সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্র একে অপরের পরিপূরক৷ তাই লক্ষপ্রাণের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রীতি পদ্ধতি বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাদ দিয়ে গণতন্ত্র দুটোর কোনটাই সঠিক নয়৷ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মানুষ স্বাধীন ভাবে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিয়েছে সেখানে কোনপ্রকার ভীতিপ্রদর্শন ছিল না৷ কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই স্বতঃস্ফূর্ত ভোট দানে ব্যত্যয় ঘটেছে বলে অভিযোগ আছে৷ এগুলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্র দুটোর জন্যই ক্ষতিকর৷ দেশের ভালো ভবিষ্যতের জন্য সরকার দলের যেমন উচিত এগুলো পরিহার করা তেমনই বিরোধী দলেরও উচিত এগুলো মোকাবেলা করার সাংগঠনিক শক্তি অর্জন৷ সরকার ও বিরোধীদলের কার্যকর অংশগ্রহণে দেশ এগিয়ে যাবে, জনগণ এমনটিই প্রত্যাশা করে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)