জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক রহমানের কারাদণ্ড হলো। একজন চেয়ারপার্সন আরেকজন সহসভাপতি। চেয়ারপার্সনের শরীরী অনুপস্থিতির জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন করা হলো দীর্ঘদিন ধরে পলাতক আরেকজন শরীরী অনুপস্থিত সহসভাপতিকে।কেন? শরীরী উপস্থিত আর কোন সহসভাপতি কি ছিল না চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব নেয়ার মতো? যিনি দেশেই নেই ও যার দেশে আসার কোন সুযোগই নেই তিনি কিভাবে দলের দায়িত্ব পালন করবেন? এ ছাড়া আইনের দৃষ্টিতে একজন অপরাধী ও সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তি দলের প্রধানের দায়িত্ব নিলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা কি নীতিনির্ধারকদের ভাবা উচিত ছিল না? আর যে অভিযোগে তারা দণ্ডিত হলো সে অভিযোগটা কি মিথ্যে? যদি মিথ্যে না হয় তাহলে একজন সত্যিকারের অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে বিক্ষোভ, মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচি কি যৌক্তিক? কী বলেন নীতিবোদ্ধারা?
তারেক রহমান দেশে নেই ও তার দেশে আসার সুযোগও নেই। এলে মায়ের মতো তাকেও কারাগারে যেতে হবে। তাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়েছে দলের ইচ্ছায় না খালেদা জিয়ার ইচ্ছায়। খালেদার ইচ্ছায় হলে তিনি যে নিজ পুত্র ছাড়া অন্য কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না তা কি প্রমাণিত হয় না? না কি তিনি পুত্রের আবদার রক্ষা করেছেন? না হয় তারেক রহমানের জন্মের আগে থেকে যারা রাজনীতি করে আসছেন তাদের বাদ দিয়ে তাকেই কেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন করা হলো? এতে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যাদের প্রতি কোন আস্থাই নেই তাদের দিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে কি কোন ভরসা করা যায়? তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন করায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। একজন সাজাপ্রাপ্ত পলাতক ব্যক্তি দলের দায়িত্বে থাকলে তা তাদের জন্য ভালো হবে না এমন মন্তব্য করছেন তারা। ইতোমধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ভারত তারেক রহমানকে দায়িত্ব প্রদানের সিদ্ধান্তের প্রতি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে।
বিএনপি যেন বারবার ভুলেরই পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল দাবি করেও তারা গাঁটছড়া বাঁধল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামাতের সাথে। বারবার জামাতকে ত্যাগ করার কথা উঠলেও তারা তা শোনেনি। ৫ জানুয়ারীর নির্বাচন এই জামাতী সঙ্গেই তারা বর্জন করলো। জামাত দলীয় পরিচয় ও দলীয় প্রতীকে আর নির্বাচনে অংশ নিতে পারছে না। তাই নির্বাচনটা তাদের কাছে মুখ্য নয়। জামাতী মদতেই তারা সেসময় অনির্দিষ্টকালের অবরোধ ডাকল। সে অবরোধ তারা আজও প্রত্যাহার করেনি। সেটা বুঝি স্বয়ংক্রিয়ভাবেই প্রত্যাহার হয়ে গেল! সেই জামাত দেশজুড়ে পেট্রোল বোমা মেরে বিপন্ন করেছে মানুষের জনজীবন। তারা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলোকে পর্যন্ত মুছে দিতে তৎপর রয়েছে। বিয়ানী বাজার উপজেলার লাউতা ইউনিয়নের গজারাই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দেয়াল থেকে সাদা রং দিয়ে সাত বীরশ্রেষ্ঠের প্রতিকৃতি মুছে দিয়েছে জামাতীরা। কিশোরগঞ্জ জেলার তাড়াইল উপজেলায় নারী মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য পরিবর্তন করে দাঁড়িওয়ালা পুরুষের মূর্তি লাগিয়েছে তারা। হাইকোর্টের সামনে হতেও ভাস্কর্য সরানোর চাপে তারা সফলকাম হয়েছে। বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সাথে আঁতাত করে তাদের রাজনীতিকেই আজ প্রশ্নবিদ্ধ করলো। তারেক রহমানের আইএস সম্পৃক্ততার কথাও শোনা যায়। আমাদের স্বাধীনতার চির দুশমন পাকিস্তান তারেককে তাদের দেশের নাগরিকত্ব দেয়ার খায়েশও ব্যক্ত করেছেন। এই খায়েশের প্রতিক্রিয়ায় তিনি কেন বললেন না যে তার এরকম খায়েশ নেই।
অনেকেই বলছেন বিএনপির সাংগঠনিক পরিণতি হতে চলেছে ন্যাপ, মুসলিম ও জাসদের মতো। ন্যাপ সমাজতন্ত্রের কথা বলতো আবার ইসলামী সমাজতন্ত্রের কথাও বলতো। জাসদ সমাজতন্ত্রের সাথে জুড়ে দিয়েছিল ‘বৈজ্ঞানিক’ কথাটি। মুসলিম লীগের উৎপত্তি ধর্মীয় দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে। ইসলাম পন্থী ও সমাজ তন্ত্রীদের টানাটানিতে সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য ব্রাকেট বন্দী ন্যাপ। নিজস্বতা হারিয়ে সংমিশ্রণ ঘটলে যা হবার তাই হলো তাদের। একসময়ের সমাজতন্ত্রীরা দলে দলে যোগ দিল সমাজতন্ত্র বিরোধী জিয়ার বিএনপিতে। ডান বাম, মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার সকলকেই বিএনপিতে স্বাগতম জানানো হলো। এমন বহু মতের ও বহু পথের মানুষদের নিয়েই বিএনপির যাত্রা। বিএনপি হতে বেরিয়ে আলাদা বিএনপি গঠন করলো একসময়ের দলটির মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমান, বিএনপি থেকে বেরিয়ে বিকল্পধারা নামের একটি দল গঠন করল দলটির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এ কি এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, অলি আহমদের নেতৃত্বে গঠিত হলো এলডিপি, বিএনপি নেতা আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে গঠিত হলো বিএনএফ, বিএনপি হতে বেরিয়ে আলাদা সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে শাহেদা ওবায়েদ ও ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদাও।
মাতা-পুত্রের সাজা ঘোষণায় দলটি কি দ্রুতই বহুধাবিভক্ত হতে চলেছে? তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব হতে সরিয়ে দিয়ে আর কাউকে এ পদটি দিলে কি তুমুল গৃহদাহ শুরু হবে না? তারেক রহমানকে ঘিরে তখন হয়তো দেখা দেবে চরম উপদলীয় সংঘাত। তখন হয়তো ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অনেক নেতাই হতে চাইবে। তারেক রহমানও নিশ্চয়ই এ পদে বহাল থাকতে চাইবে। পদ দিয়ে পদ কেড়ে নেয়া চরম অপমানজনক। পদটি দেয়ার আগে যদি সম্ভাব্য বাস্তব প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে নীতিনির্ধারকরা একটু ভেবে নিতেন তাহলে এই জটিলতার সৃষ্টি হতো না নিশ্চয়ই। কী ঘটতে চলেছে বিএনপিতে? চরম ভাঙনের পদধ্বনি কি তাহলে খুবই নিকটে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)