২০১৮ সালকে জাতীয় নির্বাচনের বছর হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ কোন জটিলতা কিংবা অপ্রত্যাশিত কিছু না ঘটলে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় এ বছরের শেষের দিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। বছরের শেষের দিকে নির্বাচনী জোয়ারে ভাসবে দেশ।
তবে নির্বাচন কোন স্টাইলে হবে, হলেও সুষ্ঠু হবে কিনা কিংবা অংশগ্রহণমূলক ও নিরপেক্ষ হবে কিনা তা নিয়ে সর্ব মহলেই কানাঘুষা আছে, আছে সন্দেহ এমনকি অবিশ্বাসও।
কানাঘুষা, সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের পেছনের কারণ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। বেশ কিছু অনিয়মের সঙ্গে সবচেয়ে আলোচিত ছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জন সংসদ সদস্য হওয়ার বিষয়টি। মূলত এই নির্বাচন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচনগুলোর উপর দেশের ভোটারদের মনে বিশ্বাসহীনতার এক কালো ফলক স্থাপন করে দিয়েছে বললে ভুল হবে না।
স্বাধীনতার পর কোন সরকারের পক্ষেই জাতীয় নির্বাচনের মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনটি সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানের যোগ্যতা দেখাতে পারেনি। বিশেষ করে, প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোর কেউই নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে বিশ্বাস করেনি। রাজনৈতিক দলগুলোর এ ধরণের আচরণ স্পষ্টত গণতন্ত্রের মৌলিক চেতনার পরিপন্থী।
প্রকৃতপক্ষে, গণতন্ত্রের মতো উন্নত মূল্যবোধ ধারণের শিক্ষা আমাদের রাজনীতিকরা অর্জন করতে পারেননি বলেই, নির্বাচিত অনির্বাচিত যে সরকারই যখন ক্ষমতায় গিয়েছে, আপাদমস্তক একঘুয়েমি মনোভাব নিয়েই তারা দেশ শাসন করেছে।
এটা বলতেই হবে, এদেশে সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার একমাত্র যোগ্যতা দেখিয়েছে অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর অসততার প্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। আবার নানা ঘটনাবহুল কারণেই তা এখন সংবিধান থেকে বাদ পড়েছে।
নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য তত্ত্বাবধারক সরকার ব্যবস্থা এখনো দেশের সিংহভাগ মানুষের আস্থার প্রতীক এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি সরকার ব্যবস্থা। যতদিন না রাজনৈতিক দলগুলো আদর্শিকভাবে গণতান্ত্রিক চেতনার আধার হতে পারবে, ততদিন পর্যন্ত আমাদের নির্বাচনী সিস্টেমটাকে টেকসই ও মজবুত ভিত্তি দেওয়ার জন্য তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বহাল রাখা উচিত ছিল। উচ্চ আদালতও কিন্তু ‘অন্তত’ আরো দুই মেয়াদ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার জন্য ‘সুপারিশ’ রেখেছিলেন।
রাজনীতির জটিল ও কুটিল হিসেবী খেলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এখন সাইডলাইনে। রাজনীতির মাঠে তাকে আর না দেখার সম্ভাবনাই বেশি। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার একমাত্র প্রবর্তক একই সাথে সংহারক হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে মর্যাদাপূর্ণ স্থান দখল করবে।
রাজনীতি যদি জটিল কৌশলের মিশেল হয়, তাহলে সেই রাজনীতি বুঝে উঠতে বিএনপি এখনো বিরাট মিসিং লাইনেই আছে। এদিক থেকে আওয়ামী লীগ এই মুহূর্তে বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে বটে, তবে নিষ্কণ্টক রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে স্লিপ খেয়ে পা হারানোর নজির নাই, এমন কেউ বলতে পারবে না।
আওয়ামী লীগ
অনেক সমালোচনার মধ্যেও গণতন্ত্র ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের যে অর্জন তা ধরে রাখতে হলে আগামী নির্বাচনে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপিকে ছলচাতুরী করে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার দুরভিসন্ধি থেকে সরে আসতে হবে। বরং দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে শক্তিশালী করার বৃহত্তর স্বার্থে বিপর্যস্ত বিএনপিকে নির্বাচনে আসার পথ সুগম করা উচিত।
এটা মনে রাখা দরকার আওয়ামী লীগ দেশের মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দানকারী প্রধান দল। তাদের নেতৃত্বেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর অভিভাবক হিসেবে আওয়ামী লীগের দায়-দায়িত্ব অনেক। দেশের বহু সংকটকালে আওয়ামী লীগ মুক্তির মশাল উড়িয়েছে।
আগামী সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে জাতীয় সংকটের আভাস স্পষ্ট হচ্ছে। কোন অন্ধকার সুরঙ্গ’র দিকে আমাদের পথ যাতে অবধারিত না হয়, সেই মহা দায়িত্ব নিয়েই অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে সঠিক ভাবনাটিই ভাবতে হবে।
এবং বিএনপি
এক্ষেত্রে বিএনপিকেও বিরাট ভূমিকা নিতে হবে। দলীয় প্রধানকে নির্বাচনের আগে মুক্ত করার জন্য আইনি প্রচেষ্টার পাশাপাশি সস্তা ইমোশনকে বস্তাবন্দী করে কার্যকর ও সময়োপযোগী উদ্যোগ নিতে হবে। বিএনপির বর্তমান হাইকমান্ডকে মনে রাখতে হবে, বেগম জিয়াকে যারা ‘মা তোমাকে জেলে যেতে দেব না’ বলে ফেসবুকের হোমপেজকে নতুন কারবালায় পরিণত করেছিল, এমন কথিত দরদী লাখ লাখ হলেও বিএনপির একজন সাধারণ সমর্থক যিনি অন্তত কাণ্ডহীন নন, তার গুরুত্ব বেশি। এরাই কিন্তু বিএনপিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কারণ বিপদের সময় ওইসব আহাজারি করাদের খুঁজে পাওয়া যায় না বলে কথিত আছে।
আগামী দিনের পরিস্থিতি যত প্রতিকূলই হোক, বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবেই। নির্বাচনে না আসার কোন বিকল্প নেই। যদি কারো প্ররোচনায় বিএনপি আবারো ভুলের গর্তে পরে, তবে সেই গর্ত থেকে উঠে আসা অনেক কঠিন হবে।
পাদটিকা
গণতন্ত্রের সুফল কার্যকরভাবে ছড়িয়ে দিতে ও একে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে রাষ্ট্রকে গণতন্ত্রের মন্ত্র সঠিকভাবে বুঝতে হয়। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যাদের উপর বর্তায়, সেই রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রমনস্ক না হলে রাষ্ট্র গণতন্ত্রের চরিত্র ধারণ করতে পারে না।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)