‘ভোট দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনও বিকল্প নেই’ -গত জুনে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে ৪০ হাজার মানুষের সমাবেশে একথা বলেছিলেন ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনার সাবেক কোচ পেপ গার্দিওলা। তিনি এখন ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল ম্যানচেস্টার সিটির কোচ।
এফসি বার্সেলোনা জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাবগুলোর মধ্যে বিশ্বের অন্যতম এবং কাতালোনিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান; যেটি তাদের স্বাধীনতার পক্ষের গণভোটের পেছনে কাজ করছে।
যদিও ক্লাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, কাতালানরা স্বাধীনতা বেছে নিলেও তারা নিরপেক্ষ থাকবে। কিন্তু যেখানে মাদ্রিদ গণভোটকে অবৈধ বলছে, সেখানে গার্দিওলার মত কণ্ঠস্বর বলছে, কাতালানদের ভোট দেওয়ার অধিকার রয়েছে। কাতালানরা যদি কখনও স্বাধীন হয় তাহলে এটা মানতে হবে যে, এর পেছনে বার্সা একটা বড় খেলা খেলেছে।
১৮৯৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘকাল ধরে বার্সা কাতালুনিয়া জাতীয়তাবাদের প্রধান প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বার্সার কারণেই ধারণা পাওয়া যায় যে, স্পেন থেকে কাতালোনিয়ার স্বতন্ত্র একটি পরিচয় আছে। বিখ্যাত লেখক ম্যানুয়েল ভাসকুয়েস মোনতালবান বার্সাকে বলছেন, ‘কাতালোনিয়ার নিরস্ত্র সেনা’।
১৯১৯ সালে শুরু হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত কাতালোনিয়ার জন্য বিরামহীনভাবে ‘স্বায়ত্তশাসনের আইন’ চাওয়া হচ্ছে। ১৯২০’র দশকে স্পেনের স্বৈরশাসক জেনারেল প্রমো ডে রিভারের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা ক্লাবের নীল ও লাল পতাকাটিতে জাতীয়তাবাদী প্রতিবাদের অংশে জুড়ে দেয়।
ফ্যাসিস্ট জেনারেল ফ্রানসিস্কো ফ্রাঙ্কোর শাসন অবসানের পর ১৯৬০ সালের শেষের দিকে নিষিদ্ধ কাতালান পতাকা এবং ভাষাটি প্রথমবারের মতো ক্লাবের ন্যু ক্যাম্প স্টেডিয়ামে পুনর্জন্ম লাভ করে। ফ্রাঙ্কোর শাসন পরবর্তী ৪০ বছরে কাতালোনিয়ার দাবি আরও বহুগুণ বেড়েছে।
বার্সেলোনার বেশিরভাগ ক্লাব পরিচালক ঐতিহাসিকভাবে কাতালোনিয়া সম্প্রদায় থেকেই টানা হয়। অন্যরা সবাই স্প্যানিশ ভাষায় কথা বললেও বোর্ড মিটিংয়ে বার্সার পরিচালকরা সাধারণত কাতালান ভাষাই ব্যবহার করেন।
কাতালানরা বার্সাকে ঐতিহ্য এবং ক্লাবের নীতিমালায় ‘মেস ক্যু আন ক্লাব’ বা ‘একটি ক্লাবের চেয়েও বেশি’ বলে ধারণ করে। প্রকৃতপক্ষে, বার্সা এমন একটি শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী প্রতীক হয়ে উঠেছে যে, অনেক ইতালীয়ও তাদের পক্ষে এমন রাষ্ট্রের জন্য আবেগগত উত্তরাধিকারী হিসাবে সমর্থন করে। এই বিষয়টি ক্লাবকে তাদের আবেগ সচল করতে আরও বেশি সাহায্য করে।
মধ্য ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্সেলোনা। ২০০৬ সালের আগে মাত্র একবার ইউরোপসেরা হলেও গত একদশকে রক্তবর্ণ তারা। ইউরোপের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম এখন তাদের। ন্যু ক্যাম্পের ধারণ ক্ষমতা এখন ৯৯ হাজার ৩শ ৫৪! প্রায় প্রতি ম্যাচেই দর্শকে টইটুম্বুর থাকে এই বিশাল গ্যালারি।
ডিজিটাল এবং সোশাল মিডিয়ার পৃষ্ঠপোষকতার মূল্য সন্ধান করে এমন দুটি প্রতিষ্ঠান ফোর্বস ম্যাগাজিন এবং হুকিট, গত বছর গণনা করেছিল যে, বার্সার ১৪৫ মিলিয়ন সোশ্যাল মিডিয়ার অনুসারী রয়েছে। এই সংখ্যা পৃথিবীর যেকোনো স্পোর্টস ক্লাব এবং এমনকি আমেরিকার ফুটবল খ্যাত এনএফএল গ্রিডরন লিগের সমস্ত দলের মিলিত সংখ্যার সমান।
রিয়াল মাদ্রিদের বিরুদ্ধে বার্সেলোনার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ফুটবলের সবচেয়ে উচ্চ-প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিশ্বকাপের ম্যাচকেও হার মানিয়েছে। এটা ক্লাবের জাতীয়তাবাদী মাত্রাকেও বাড়িয়েছে বহুগুণ। ফ্রাঙ্কোর আমলে অনেক বার্সার ভক্ত মাদ্রিলিনকে (রিয়াল) কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধি হিসাবে গণ্য করত। কিছু গরম মাথার লোক এখনও তেমনটাই মনে করে।
বেশিরভাগ কাতালানই ন্যু ক্যাম্পে তাদের জাতীয়তা প্রকাশ করে কারণ তারা এটি রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের মাধ্যমে প্রকাশ করতে পারে না। এর মানে এই নয় যে, তাদের অধিকাংশই রাষ্ট্র চায়। ঐতিহাসিকভাবে, কাতালোনিয়ার ভোটে খুব কম লোকই স্বাধীনতার পক্ষে সর্বাধিক সমর্থন দেখিয়েছে। কিছু স্থানীয়দের জন্য বার্সেলোনাকে উত্সাহিত করাই যথেষ্ট মনে হচ্ছে।
সম্প্রতি ক্লাবটি গণভোটের গুরুত্ব তুলে ধরেছে আবারও– সেটা জন্মভূমিতে এবং বিশ্বব্যাপী। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ন্যু ক্যাম্পে ভক্তরা ‘আমাদের ভোট দিতে দাও’ এবং কেউ কেউ গান গাইতে বা স্বাধীনতার জন্য ব্যানার উড়িয়ে ঢেউ তুলেছেন।
প্রায়ই কোনও না কোনও রাজনৈতিক বিবৃতি ক্লাব তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, গণভোটের আয়োজনকারী কাতালান সরকারের কর্মকর্তাদের গ্রেফতারের দ্রুত নিন্দা ও স্থানীয় টিভির খবরগুলোও তারা পরিচালনা করে।
যখন ক্লাবের ডিফেন্ডার জেরার্ড পিকে গণভোটের পক্ষে সমর্থন দেন অথবা গার্দিওলা এটি সমর্থন করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান, তখন চীনে যারা কাতালোনিয়ার কথা শোনেননি তারাও এটি লক্ষ্য করেন।
গণভোটের দিন লাস পালমাসের বিরুদ্ধে বার্সা ম্যাচের আগে কাতালোনিয়ার নিজস্ব ও বিখ্যাত ‘সেনারিয়া’ পতাকার রংয়ের জার্সিতে ওয়ার্মআপ করেছে বার্সা।
সমস্ত কিছুর কারণ কাতালান স্বাধীনতাবাদীদের কেবল গণভোটে জয় লাভ করতে হবে তা নয়। সেইসঙ্গে তারা মাদ্রিদ এবং বিশ্বে তাদের চাহিদাটা গুরুত্বরপূর্ণভাবে তুলে নিতে একটি উচ্চ পর্যায়ের ঝাঁকি প্রয়োজন। যদিও গণভোট ব্যর্থ করার জন্য মাদ্রিদ যা কিছু করতে পারে তার সবকিছুই করেছে।
যদি কোনও একদিন কাতালোনিয়া স্বাধীনতা লাভ করে, তারপরও বার্সা ভক্তদের আস্থা যে, তাদের ক্লাব স্প্যানিশ লিগে খেলতে পারবে। মোটের উপর বার্সাকে ছাড়া শুধু স্প্যানিশ লিগই বঞ্চিত হতে হবে, সেইসঙ্গে রিয়াল বঞ্চিত হবে মাদ্রিদও।
শেষ খবর, কাতালোনিয়ার রোববারের গণভোটে স্বাধীনতার পক্ষে রায় গেছে আবারও। প্রদেশটির নেতা কার্লোস পুজডেমন্ড বলেছেন, স্পেনের কাতালোনিয়া অংশকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার অধিকার অর্জন করেছেন তারা। এমনকি একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার দুয়ারও খুলে গেছে বলে দাবি তার।
লড়াই চলছে। অধিকার আদায়ে। এটা আরও কতদিন চলবে জানা নেই কারও। যাতে নিশ্চিত ভূমিকা রাখছে ন্যু ক্যাম্প। কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার স্বপ্ন স্বার্থক হলে, বার্সার পূর্ণ ভূমিকাটা হয়ত তখনই বেশি করে ফুটে উঠবে।