দিনের মধ্যে তিন/চারবার খোঁজ নিয়ে যায় ফৌজী কমান্ডার। নবজাতক আসার খবরটা তাদের কাছে শেলের মত বিঁধল। ঔর এক মুজিব পয়দা হুয়া। বাঙ্গাল পয়দা হুয়া। কেয়া নাম রাখা হ্যায়!
ইয়াজুজ মাজুজদের কৌতুহলের সীমা নেই। জয় রাখা! ইয়ে ক্যায়সে নাম হ্যায়। সজীব ইয়ে ক্যায়সে নাম হ্যায়। খান্দানি নাম রাখা হ্যায় কি নেহি।
ওয়াজেদ কমান্ডারদের কঠিন জেরার মুখে। জয়। ইয়ে তো জয় বাংলা কি জয়। ঘোর সন্দেহ ইয়াজুজ-মাজুজদের। জয়-কা মতলব ক্যায়া হ্যায়।
জয় মানে খুশি। জয় মানে উইনিং। জয় মানে আনন্দ।
সন্তুষ্ট হতে পারে না ফৌজীগুলো। আসলি খান্দানি নাম ক্যায়া হ্যায়। সজীব। মজিব কা সাথ মিলা কর সজীব! ইসকা মতলব ক্যায়া হ্যায়। সজীব মানে জিন্দা। লাইভলিফুল। অলওয়েজ লিভিং। ওয়াজেদ সাহেব ব্যাখ্যা দিতে দিতে প্রাণান্ত। ফৌজীগুলো গেটে বসে খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। ভেংচি কেটে বলছে – জয়ৌ বেংলা। জেউ বেংলা। ঔর এক জেউ পয়দা হুয়া। কখনও আফসোস করছে – পশ্চিম পাকিস্তানমে কওমী-গাদ্দার মুজিব আভি জিন্দা হ্যায়। ঔর ইধার এক কাফির পয়দা হুয়া। ওয়াজেদকে বাইরে যেতে আসতে এইসব কটুক্তি বক্রোক্তি সহ্য করতে হচ্ছে। কিছুই বলতে পারছে না সে। সর্বক্ষণ ফলো করা হচ্ছে ওয়াজেদকে। মুক্তি কা সাথ কোনো সম্মন্ধ রাখছে কি না। শেখ কামালের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হচ্ছে কিনা। জামাল, ওয়াজেদও মওকা বুঝে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে চলে যায় কিনা। সারাক্ষণ খালি প্রশ্ন আর প্রশ্ন। বাড়ির ভেতর হুটহাট ঢুকে তল্লাশি।
জয়কে পৃথিবীর আলো দেখাতেও কম যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে হয়নি। গর্ভবতী অবস্থায় হাসিনার অবস্থা ক্রিটিকাল হয়ে পড়েছিল। এমনও দিন গেছে ডাক্তার দেখানো অতি জরুরি হয়ে পড়ছিল। আম্মা ক্ষুব্ধ কণ্ঠে ফৌজীগুলোকে দুকথা না বলে পারেনি। বন্দি করে রেখেছে বলে কি ডাক্তারখানায় যেতেও দেবে না। এটা কী ধরণের অত্যাচার। এই দাজ্জালগুলো কি কংসরাজার বংশধর। কোনো শিশুকে জন্ম নিতেও দিবে না। মায়ের পেটেই মেরে ফেলবে।
হাসিনার অবস্থা যখন গুরুতর, অনেক কষ্টে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির পারমিশন মিলল। ফৌজী কমান্ডার কোনোভাবেই রাজি নয়। বন্দির আবার কিসের হাসপাতাল। ওয়াজেদ পাগলপ্রায় হয়ে এখানে ওখানে ছুটলেন। একজন গাইনোকোলজিস্ট সহৃদয়তার সঙ্গে ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এলন। বললেন, পেশেন্টের যা কন্ডিশন। হসপিটাল ছাড়া উপায় নেই।
প্রথম নাতি আসছে দুনিয়ায়। আম্মা বড় কন্যার সঙ্গে হাসপাতালে যেতে চাইলেন। খেঁকিয়ে উঠল মেজর ইকবাল। বলল, নো পারমিশন। হাসপাতালে ওই মহিলা যাবেন কেন। ওই আওরত কি দাইগিরি করেন।
প্রবল যন্ত্রণা চলল। ঢাকা মেডিকেলেও হাসিনার ওপর খুব নজরদারি চলছিল। কক্ষের বাইরে সর্বক্ষণ পাহারা। নার্স ঢুকলেও জিজ্ঞাসাবাদ। বেরুবার সময়েও জিজ্ঞাসাবাদ। মাতৃত্বলাভের দুর্লভ ক্ষণেও হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের পরমধ্যানে লিপ্ত কিনা সে দুশ্চিন্তায় মেজর-কর্নেলদের ঘুম নেই। হাসপাতালে বেশিদিন থাকতে দেয়া হলো না। হাসিনা সুস্থ হওয়ার আগেই বন্দি বাড়িতে আসতে বাধ্য করা হলো। বেশ রক্তক্ষরণ হচ্ছিল প্রসূতির। গুরুতর অসুস্থতার কথা শুনেও কোনো বিকার নেই কমান্ডারের। মরুক। মুজিবের খান্দান মরুক। একটা একটা মরে গোষ্ঠী বিনাশ হোক।
একরাতে হাসিনার অবস্থা অতিরিক্ত সঙ্গীন। মৃতপ্রায় তার অবস্থা। কোন না কোন ডাক্তার দেখানো অতি অবশ্য দরকার। বেয়নেট উঁচিয়ে পাহারায় দাজ্জালগুলো। কমান্ডারটা কিছুতেই কাউকে বের হতে দেবে না। কোনো ডাক্তারকে বন্দিবাড়িতে আনাও যাবে না। ভেতর থেকে কেউ ডাক্তারের কাছে যেতেও পারবে না। বাড়িতে একরকম কান্নাকাটির অবস্থা। চোখের সামনে মেয়েটা বিনা চিকিৎসায় মরবে – আম্মা মানতে পারছেন না কিছুতেই।
বেশ কয়েক ঘন্টা পর শিফটিং-এ এলো বালুচি এক মেজর। ওয়াজেদকে বেরুবার অনুুমতি দিল বটে। পাঞ্জাবি হাবিলদারের ব্যাপারটি পছন্দ হলো না। সে স্টেনগান নিয়ে ওয়াজেদের সঙ্গ নিল। সঙ্গে কয়েকটা জোয়ান নিল। তাদের সঙ্গে সাবমেশিনগান, গুলিগোলা কার্তুজ। ডাক্তারের কাছে যাওয়া তো নয় আজরাইলদের সঙ্গে শহর-সফর। ডাক্তার আয়োজন দেখে বেশ বিব্রত। রীতিমত মিনি ক্যান্টনমেন্ট ঢুকে পড়েছে তার চেম্বারে। বিস্তারিত বৃত্তান্ত তিনি শুনলেন। হাসিনার অবস্থা এতই ক্রিটিকাল, আজরাইলদের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তিনি রোগীকে সচক্ষে দেখতে আসতে চাইলেন। হাবিলদার একদমই রাজি নয়। সে স্টেনগান উঁচু করে ধরল। না। ডাক্তার ফাক্তার কেউ যাবে না। বৃত্তান্ত বলা হয়েছে সেই ঢের। ডাক্তার সাহেব তো রাজিই নন। প্রফেশনালী তিনি কেমন করে এই ঝুঁকি নেবেন। জাহান্নামে হলেও রোগীর সেবার জন্য তার যাওয়া দরকার। কে শোনে কার কথা। শেষে ওয়াজেদের পীড়াপীড়িতে তিনি কিছু ওষুধ লিখে দিলেন। ডাক্তার বিষণ্ণ মুখে বললেন, রিস্ক আপনাদের। এই অবস্থায় রোগীর হালত না দেখে চিকিৎসা রীতিমত ক্রাইম।
প্রেসক্রিপশন আদায় করে বেরুবার মুখে আরও ভয়ঙ্কর বিপদ। কারফিউ শুরু হতে মিনিট দশ পনের বাকি। উর্ধ্বশ্বাসে তিনি ছুটছেন। সারা শহর নিঝুম অন্ধকার। কোথাও কোন ফার্মেসী খোলা নেই। দূরাগত অস্পষ্ট কিছু শব্দ। জয়বাংলা বেতারের ইথারে কান পেতে রয়েছে আলোহীন নগরের বাসিন্দারা।
তীব্র বর্ষায় মুক্তিসেনারা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল। ঢাকায় ঢুকেই তারা আক্রমন চালানো শুরু করেছে ফৌজী-আস্তানায়। ফাঁড়িতে আক্রমণ চলছে। হানাদারদের ক্যাম্প বাঙ্কারে হামলা করছে । কনভয়ে হামলা করছে। টিক্কা চাক্কা খান্দানিদের তাতেই থরো থরো কম্প অবস্থা। নিয়াজির নাৎসিগিরিতেও কোনো কাজ হচ্ছে না। মুক্তিসেনাদের হামলা তীব্রতর হচ্ছে। যে ফৌজীগুলো গেটে বসে টিটকিরি ভর্ৎসনা করে চলছিল, ওরাই গুলির শব্দ শুনলেই ভয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ত। ছাদে উঠত। ওদের প্রচণ্ড ভয় – জামাল ওদের ওপর হামলার চেষ্টা করে বসে কি না। ওদের নানা বাহানা। নানা অভিযোগ। কখনও কোনো হাবিলদার বন্দুক উচিয়ে ঢুকে পড়েছে ভেতরে। কী ব্যাপার। সে নাকি জয় বাংলা রেডিওর আওয়াজ পেয়েছে। জামাল নাকি জয় বাংলা রেডিও শুনছে। যাচ্ছেতাই ভাষায় সে জামালকে শাসাল। বলল, তার উপর অর্ডার আছে – জামালকে বেঁধে টেনে হেঁচড়ে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়ার। সেখানে জামালের পিঠের চামড়া চেছে তোলা হবে। তারপর লবণ দেয়া হবে। যতক্ষণ না জামাল মরবে ওই অবস্থায় রাখা হবে। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে জামালের চক্ষু তোলা হবে। বিভৎস সব পরিকল্পনা।
আম্মা শুনে খুবই পেরেশান। কখন কী ঘটে যায়। তিনি বুঝতে পারছেন – পাকিস্তানিরা ক্রমশই অস্থির হয়ে উঠছে। ভয়ে আতঙ্কে ওরা বেপরোয়া হয়ে পড়ছে। মুজিব পরিবার বন্দি তাতে কী! এই সময়ে ফৌজীরা নির্বিচারে খুনখারাবি করে বসতে কতক্ষণ। জামালকে নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত আম্মা।
জয় বাংলা বেতার নিয়ে খুব বাড়াবাড়ি চলছিল। সারা বাড়িতে তল্লাশি চালাল। পেল না। আশপাশের বাসাবাড়িতেও তল্লাশি চলছে। বলা নেই, কওয়া নেই। বাড়ি ঘরে ঢুকে পড়ছে তারা। এখানে সেখানে আগানে বাগানে জয়বাংলা বেতারের আওয়াজ শোনা ওদের বাতিকে পরিণত হল। রাতেও শোনে। ভর দুপুরেও শোনে। কখনও শোনে লেকের ধারে ঝোঁপের আড়ালে কেউ শুনছে। কখনও শোনে রেইনট্রি গাছের মগডালে বসে কেউ শুনছে। লেফট রাইট লেফট। সশব্দ মার্চিং করে টহল দেয় সারা পাড়ায়। বিশাল গাছের মাঝখানটায় যেখানে ঘন অন্ধকার – গুলি করে সেদিকটায়। বাতাসে শিস বাজিয়ে বুলেট ছুটে যায়। একদল পাখির কলরবময় ওড়াউড়ি। আহত পাখি মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। গুলিবিদ্ধ সবুজ পাতারা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চলছেই। জয় বাংলা বেতার শোনার মতো কোনো বাঙ্গাল পেলেই হল। পিঠের চামড়া চেছে তুলবে। লবণ মরিচ ঘষবে। কসম পয়দা করনেওয়ালি কো। সবাইকে শুনিয়ে হুমকি ধমকি দিতে লাগল।
পিঠের চামড়া চেছে তোলার ধুন্দুমার অভিযান চলছে গ্রামে-বন্দরেও। টুঙ্গিপাড়ায় ঢুকে পড়েছে ইয়াজুজ-মাজুজরা। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি টার্গেট করে হামলা। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিল শেখ লুৎফর রহমানের বাড়িঘর। রেহাই মেলেনি বয়োবৃদ্ধ দাদাদাদির থাকবার ঘরটিরও। তাদের চোখের সামনেই কিয়ামত। দাউ দাউ আগুন। চারজনকে গুলি করে হত্যা করা হলো। দাদা-দাদী কোনোক্রমে রক্ষা পেলেন। দূর থেকে বিধ্বংস্ত ভিটা দেখে চোখের পানিতে ভাসলেন। দোজখ থেকে আগুনের মস্ত পিপা নিয়ে এসেছিল ফৌজীরা। টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের পর গ্রামকে সেই আগুনে ওরা ঝলসাল। হাজার হাজার মানুষকে জীবন্ত পোড়াল। মালাউন-মুসলমান কেউ রক্ষা পেল না। টুঙ্গিপাড়ায় মালাউনও কাফের। মুসলমানও কাফের। সারা বাংলায় কাফের-মালাউন ছাড়া কাউকেই খুঁজে পেল না। সবুজ প্রকৃতি দগ্ধ হয়ে কঙ্কালসার হয়ে গেল।
জামাল অসম্ভব আম্মাভক্ত। বাবা বলে গিয়েছিলেন, পুরো পরিবারকে জল্লাদের হাতে সপেঁ দিয়ে তিনি দাজ্জালের জাহান্নামে যাচ্ছেন। জামাল যেন জীবনে মরণে তার পরিবার, মাকে ছেড়ে কোথাও না যায়।
দিনের পর দিন জামাল ছিল মায়ের পাহারায়। কিন্তু এভাবে আর কতদিন! অন্তরীণশালায় তার পরিবারের ওপর নিত্য নির্যাতন চলছেই। প্রতি মুহূর্তে হাতছানি দিচ্ছে মৃত্যু। ওরা শেষ ফায়ারটা করার আগে আধমরা করে রাখতে চাইছে সবাইকে। অবশেষে আর নিজেকে সম্বরণ করতে পারে নি। দেশমাতৃকা বিপন্ন। আগুনে বাংলা পুড়ছে। মুক্তিযুদ্ধ জামালকে ডাকছে।
একরাতে শত বেয়োনেট-চক্ষুর অগোচরে, সবাইকে বোকা বানিয়ে অন্তরীণশালা ছেড়ে পগারপার। মাতৃমুক্তির পণ রক্ষায় সে দৃঢ়চিত্ত। রণাঙ্গনের আহবানে সাড়া দিতে কার্পণ্য করেনি জামাল।
একি সুমধুর খাসখবর শুনিয়ে গেল প্রাণের কোকিলায়! এ কি কোকিল না গুয়াচানপাখি! নাকি দম দমা দম ঈগল পাখি। কোন নামে তারে ডাকবে! কি নাম দেবে তারে! আহারে! পুরুষ মানুষ না হইলে একখান চুম্বন খাইত তারে।
খোন্দকারের আনন্দ আর ধরে না। উত্তেজনা তুঙ্গে। কোথায় যেন সে শুনেছিল উত্তেজনার পারদ নীচের দিকে নামে। কিন্তু তার পারদ ক্রমশ মাথার দিকে উঠছে। বিবশ-ফানা ফানা করে দিচ্ছে তার চেতনা। এক জীবনে এত আনন্দ; এত সুখ; এত প্রতিষ্ঠা সে স্বপ্নেও কল্পনা করে নাই। মহাভারতের শকুনি তো শেষ পর্যন্ত কুরু-পান্ডবের মহাযুদ্ধে জেতে নাই। কিন্তু কলিকালে খোন্দকার মহাপাকিস্তান যুদ্ধে অনায়াসে জিততে চলেছে। তার হাতে অস্ত্র শস্ত্র বিশেষ কিছু কখনওই ছিল না। খালি মাথা ভরা বুদ্ধি আর বুদ্ধি। তার সঙ্গে পনের আনা তেলবাজি। তার সঙ্গে ষোল আনা হিংসা। তার সঙ্গে মওকাবাজির সুবর্ণ মুহুর্তের সন্ধান। তার সঙ্গে রঙ্গরসবোধ। এসবই অবশ্য বুদ্ধির সঙ্গে মিশ খায়। নিজের সম্পর্কে খোন্দকারের বিচার-বিশ্লেষন সব সময় চাচাছোলা। আবেগ টাবেগ বিশেষ নাই। নিজেকে বিশাল কোন হনুমান এখনও মনে করে না। অতীতেও করে নাই। তার বুদ্ধি কি সুবুদ্ধি না কুবুদ্ধি! হা হা। সুবুদ্ধি আবার কিসের বুদ্ধি। সুবুদ্ধি বলতে জগতে কিছু নাই। নীতিকথা, ধর্মকথা , ধর্ম-ধার্মিকতা এসবই হচ্ছে মওকাবাজের অস্ত্র। যখন তোমার প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্মশাস্ত্রের দরকার। ডাকো পয়গম্বর। তার ইমেজ মাথায় নিয়ে সিজদা দাও। হাতে তুলে নাও ধর্মের তরবারি। কোপাও। কতল করো। রেপ বলাৎকার গণধর্ষণ, গণহত্যা, চান্দে নেতা-আব্বার ছবি – খুনোখুনি সব সাফ সাফ ফতোয়া দিয়ে জায়েজ হালাল করে নাও।
ধর্মশাস্ত্র হচ্ছে সমুদ্র। পয়গম্বরের গালগল্প রুপকথা বেশ সাফ সুতরা করে বললেও নীতিকথা বলেছে বেশ ইঙ্গিতে। এইখানে হচ্ছে আসল সুবিধা। ইঙ্গিতকে যদি ডাইনে টানতে চাও। দাও ফতোয়া। ইঙ্গিতকে যদি বামদিকে টানতে চাও। দাও ফতোয়া। একটা ইঞ্জিলে-তৌরাতে-যাবুরে আর কত কথা ধরানো সম্ভব। হাজারো বছর পুরানা ইঞ্জিন। কত আর হর্স পাওয়ার। বড়জোর চার নয়তো দশ অশ্বশক্তি। ওই ইঞ্জিন দিয়ে এই কালে কেমন করে কাজ চলবে। তাই ইঙ্গিত ধরে ধরে দাও নিত্য নতুন ফতোয়া। খালি খেয়াল রাখবা সবার আগে নিজেকে কিন্তু মহাধার্মিক সাজাবে। ঈমানদার সাজবে। মুসলমান হলে মসজিদে যাবে। হিন্দু হলে মন্দিরে। লোকজনের সামনে আল্লা-বিল্লা করবে। ঘরে নামাজ না পড়লে কোনো ক্ষতি নাই। কিন্তু মাশাল্লাহ মসজিদে গিয়ে অবশ্যই সালাত আদায় করবে। ঘরে মন্দির নাই নো প্রব্লেম। কিন্তু পাড়ার মন্দিরে সর্বসমক্ষে কপালে তিলক লাগিয়ে অবশ্যই সাষ্টাঙ্গ প্রণাম ঠুকবা। ভুল করবে না। কোথাও সামাজিক-পারিবারিক-রাজনৈতিক আচার অনুষ্ঠানে এমন কি শরাবপানের জলসায় গেলেও নামাজের ওয়াক্তে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে আওয়াজ দিবা – জায়নমাজ কই। আজান দিছে। ফরজটা আদায় করা দরকার। আমি কখনও নামাজ ক্বাজা করি না।
ঘরের মধ্যে শরাববাজির ফোয়ারা বইয়ে দাও। সমস্যা নাই। কিন্তু লোকসমাজে বলবা, শরাব শরীয়ায় নিষিদ্ধ। তুমি শরাব খাও কি খাও না সেটা পরিষ্কার করে না বললেও চলবে। নামাজ যখন পড়বা কপালটা মাটিতে ঘষবা। বেশি ব্যাথা বেদনা কপালে লাগানোর দরকার নাই। বেশ কয়েকবার ঘষলেই কপালে দাগ লেগে যাবে। যদি দাগ লাগাতে না পার, কপালে সুরমা গাঢ় করে ঘষে নিবা। একবার কপালে সুরমার দাগ লাগাতে পারলেই কেল্লা ফতে। পাক্কা মুসল্লি। তুমি যাই ওয়াজ নসিহত করো। লোকজন বিশ্বাস করবে পাক্কা। একশ পার্সেন্ট গ্যারান্টি।
তাইলে বুদ্ধির সংজ্ঞা কী! বুদ্ধির সংজ্ঞা হচ্ছেন কুবুদ্ধি।
কুবুদ্ধির সংজ্ঞা! আঙুর তো জান্নাতি ফল। জান্নাতে বসে টপ টপ করে খাওয়া যাবে। শরাব কী দিয়ে তৈয়ার হয়। এই জান্নাতি আঙুর দিয়েই। ঠিক কিনা! কেমন করে শরাব তৈয়ার হয়। ওই আঙুর পঁচিয়ে, গেঁজিয়ে গাঁজন তৈরি করে। কতরকম প্রসেস করে। জান্নাতে পাওয়া যাবে শরাবান তহুরা। সেই জান্নাতি শরাবের ইনগ্রেডিয়েন্স কি! কাঁচামাল কি! অবশ্যই আঙুর। ঠিক কি না!
তেমনি বুদ্ধিকে টসটসে আঙুরের ফর্মে রাখলে চলবে না। মাথার বুদ্ধিকে তেলবাজি, শয়তানি, কুটকচালি, গীবত লোভ – ষড়রিপুর জারকে পচাতে হবে। গেঁজাতে হবে। যত বেশি বছর ধরে পচানো , গেজাঁনো তত বেশি মহামূল্য। চিপকে চিপকে রস বের করতে হবে। তখন তোমার মস্তিষ্ক দিয়ে প্রসেস হয়ে তৈয়ার হবে আসল বুদ্ধি। তোমরা তাকে কুবুদ্ধি-কুটনামি যাই বলো। আঙুরের আর কয় টাকা মণ। এক মণের দাম কত। কিন্তু এক ফোটা শরাব! শরাবান তহুরা। তার স্বাদ নেওয়ার জন্য সমগ্র জাহান মাতোয়ারা। তার জন্য হুতাশনে মানুষের হুঁশ নাই।
খোন্দকারের মাথায় খালি বুদ্ধি গিজ গিজ। শেয়ার করার মতো একটা মানুষ ভূ-পাক বাংলা-ই-স্থানে নাই। যা একজন ছিল – গোলাম পাকিস্তানি – সে আবার দেশেই তশরিফ আনতে পারছে না। কী মুশকিল। খোন্দকার নিজেই স্বীকার করে তার গুনগান-কীর্তন।
আগে কামডা হোক – অপারেশন খাস-খতম কামিয়াব হোক – গোলাম পাকিস্তানিকে জেট বিমান পাঠিয়ে মহাইজ্জতে দেশে ফেরত আনা হবে। অমন একটা বুদ্ধিধর। সে দেশের বাইরে থাকলে চলবে কেমন করে। তারপর বঙ্গভবন – থুক্কু প্রেসিডেন্ট হাউজে বসে জম্পেশ আড্ডাবাজি হবে। একলা একলা সদরে পাক-বাংলাস্থান – প্রেসিডেন্ট হলে তো চলবে না। তার ইয়ারি দরকার। দোশত দরকার। তাছাড়া গোলাম লন্ডন-পিন্ডি-মক্কামদীনা-কুয়েত-কাতার দৌঁড়ে ছুটে যে আজরাইলি সার্ভিস দিচ্ছে – মুজিবের ব্যাঙ্গাদেশ – মজিবল্যান্ডকে সবজায়গায় এরাবিয়ান ওয়াশ দিচ্ছে – দেশে ফেরত এনে তাকে অবশ্যই বিশাল গণসংবর্ধনা দিতে হবে। ওয়াদা পাক্কা। তার জন্য একটা জেট ভাড়া করা হবে। যত টাকা লাগুক। মানি ইজ নো প্রব্লেম। বন্দুকের নল সকল টাকার উৎস। টাকা দেবে ভুট্টা। টাকা দেবে পাকিস্তান। ভুট্টা তাকে তো কথা দিয়েছেই – পাকবাংলাস্থান কিংবা পাক-বাংলা কনফেডারেশন টাইপ কিছু করা গেলে সে চব্বিশ বছরের পাওনা সোনা দানা সব ফেরত দেবে। পাক-বাংলাকে সোনায় মুড়িয়ে দেবে। আর খালি খোন্দকারের প্রেসিডেন্ট একাউন্টে কলমের এক খোঁচায় পঞ্চাশ হাজার টন চাউল, পঞ্চাশ হাজার গজ পাকিস্তানি ক্লথস দোশতির নিশানা হিসেবে সঙ্গে সঙ্গে দেবে। আর রুপেয়ার চিন্তা যেন খোন্দকাররা না করে!
গোলামের জন্য বিমানের মধ্যে একটা সোনার পাল্কি রাখা হবে। গোলাম সেই পাল্কিতে চড়ে সদ্য পাক-পবিত্র সাফসুতরা করা পাক-বাংলায় নামবে। কেননা, এই যে ভুট্টা-কানেকশন; আরব-কানেকশন-লন্ডন কানেকশন সবকিছুই তো গোলামবাবার জন্য হচ্ছে। ভুট্টার সঙ্গে তো গোলামের এখন সহবাস টাইপ সহবত।
খন্দকার ঠিক কল্পনাই করতে পারছে না। যা হতে চলেছে – তা কি সত্যিই কি ঘটবে। নাকি মিছে মায়া। কেবলি মরীচিকা। নাকি সেটা দিবাস্বপ্ন মাত্র!
স্বপ্নটাকে ঠিক মস্তিষ্কের বাগে আনতে পারছে না খোন্দকার।
একি সুমধুর খাসখবর শুনিয়ে গেল প্রাণের বাজপাখি। মুজিবর রে মুজিবর – তুমি আর নাই। ওরে মুজিবর, তুমি আছো বাপগিরি লইয়া। তুমি আছো ভাবগিরি লইয়া। ওইসব বাপগিরি-ভাবগিরি এই জগতে অচল। এইটা আইয়ামে জাহিলিয়ত না। যে তুমি পয়গম্বরির পাবন্দি করে ইউটোপিয়া প্রতিষ্ঠা করবে। পয়গম্বরির পাবন্দির দিন শেষ। তুমি বুঝলা না মুজিবর – এখন পয়গম্বরির ধর্ম নিয়ে ব্যবসাবাজির জমানা। তোমারে আড়েঠারে এত বুঝাইলাম, বুঝলা না রে বুঝলানা! হাতে বানাইয়া এত পান সাধিলাম – খাইলা না রে পুরাডা খাইলা না। এইটা মহাভারতের জাহিলিয়তও না। যে তুমি ধর্মপ্রতিষ্ঠা করবে। তুমি কৃষ্ণও না। তুমি পয়গম্বরও না। এখন হচ্ছে ঘোর কলিকাল। তুমি ট্রেন মিস করিয়াছ মুজিবর।
কিসের তুমি বাবাগিরি করো। কিসের বাপ! কার বাপ! পিতৃত্ব হচ্ছে দায়। দুর্বল, অসহায়, অকর্মন্য, কামচোর বেকার, ভুখানাঙ্গা গরীব সন্তানদের দায় হচ্ছে বাপগিরি। এই মহাগরীবের দেশে বাপগিরি অচল। এই দেশে সবাই ধনী হতে চায়। সবাই আমীর হতে চায়। রাস্তার যে ফকির – সেও স্বপ্ন দেখে আমীরবাদশা হওয়ার কোনো শর্টকাট পলিসি আছে কি না। কাজকামের খবর নাই – সবাই সোনারুপার পালঙ্কে ঘুমাতে চায়। সেই দেশে তুমি সবার বাবা হবে। জাতির পিতা হবে। হা হা হা । সবাইকে তুমি সোনা রুপার পালঙ্ক বানিয়ে দিবে! হা হা।
বাবায়ে পাকিস্তান কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহই পারে নাই। তুমি পারবা কেমনে! তার কর্মফল কি তুমি জান না। বাবায়ে পাকিস্তান হইছিল। মাথায় কিস্তি টুপি পরে সেও প্রথম প্রথম রিলিজিয়াস পাকিস্তান চায় নাই। হিন্দুস্থান স্টাইলে মাল্টি-রিলিজিয়ন পাকিস্তান চেয়েছে। কুখ্যাত সেকুলারিজম চেয়েছে। কংগ্রেসের খান্দানি প্রডাকশন কিনা – ধর্মকর্ম্মেও তো ছিল নিচু কমজাত মুসলিম।
পাকিস্তানিদের ইজ্জত কা সওয়াল যে দুই আন্ডা – একটা ধর্মের জিগির আর একটা হলো এক গন্ডা বিবি নিকাহ – সেইটা জিন্নাহর মতো পাক্কা মেট্রিক-ব্যারিস্টার পর্যন্ত বোঝে নাই। সেও তো বাবায়ে পাকিস্তান হয়েছিল। কিসের বাবায়ে পাকিস্তান! শেষ পর্যন্ত সে তো তার একমাত্র কন্যার বাপও হতে পারে নাই। পরমা সুন্দরী রত্নার স্বামীও থাকতে পারে নাই। তার বউ রত্না বাই – কন্যা দীনা সবাই তাকে তালাক দিয়েছে। দিলে দাগা দিয়েছে। জিন্নাহ কামের কাম দুইটাই করেছে। একটা হলো লেডি স্টেনো আর লেডি মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে সহবত-সহবাস করে একটা পাকিস্তান হাসিল করেছিল। হোক তা পোকায় কাটা – তারপরও গান্ধী-নেহেরুর নাস্তার টেবিলে খাবলা দিয়ে দেড় টুকরা রুটি ছিনিয়ে আনা সে কম কথা নয়। হাতো মে ছড়ি মুমে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। এই লেঙ্গুট মুসলমানদের পক্ষে জিন্নাহ ছাড়া কোনোভাবেই পাকিস্তান হাসিল সম্ভব ছিল না। মওদুদিও মত মহাশৃগাল ধুরন্ধর পর্যন্ত ধারণা করতে পারেনি জিন্নাহ শেষ অব্দি পারবে। জিন্নাহ তার বৃটিশ বোধ-বুদ্ধি দিয়ে সেটা পেরেছে। তার আরেকটা কর্ম হলো পারসি জোরাথুস্টিয়ান রত্না বাই পেটিটকে ধর্মান্তর করে কলেমা পড়িয়ে মুসলিম মরিয়াম জিন্নাহ বানাইছিল – পাকিস্তানকে যে নামকাওয়াস্তে বংশীয় রিলিজিয়াস রাষ্ট্র বানান দরকার – জিন্নাহ তার ইঙ্গিত দিয়েছে এই কাজে। এই রাষ্ট্রে ধর্মকর্ম কোনো বিষয় না – কিন্তু মুসলমানি মার্কা সিলছাপ্পড় অত্যন্ত দরকার। জিন্নাহর ট্রাজেডি হলো – সে নিজেই বিষয়টি অন্তরে উপলব্ধি করে নাই। তারপর আবার ভড়ংবাজি করতে গেছে বলেই ধরা খেয়েছে। কংগ্রেস ইজ কংগ্রেস। মুসলিম লীগ ইজ মুসলিম লীগ। কংগ্রেসগিরি আর মুসলিম লীগগিরি তো এক না। মুসলমান কওমিয়াতে কিসের সেকুলারিজম। মুসলিম লীগের নামে কায়েম রাষ্ট্রে মুসলমানিয়াত হলো ব্রান্ডিং-ট্রেডমার্ক। মুসলমানের আবার বহুধর্ম সমন্বয় কেন! একটা ধর্ম সামলাইয়াই পারি না – তার আবার সকল ধর্মের প্রতি সম্মান।
খোন্দকারের চোখে ঘুম নাই। আজ একখানা অটোবায়োগ্রাফি রচনা শুরু করবে ভাবছে! আজ এই খোশ-জলসা রাতে নিজের সব তত্ত্বকথা কচলাতে যে মুঞ্চায়। শেখ মুজিবরকে কত কথা শোনাতে তার মুঞ্চাইতেছে। মনকে কোনোভাবেই বশে রাখতে পারছে না। আজ তার সব কথা কবুল করতে হবেই। নইলে কাল কেমন করে বিশাল কর্মভার গ্রহণ করবে। ওরে বাবারে – প্রেসিডেন্ট হাউজ। আর্মি তোপধ্বনি, গার্ড অব অনার। জন্ম জন্মান্তরের গোপন স্বপ্ন। আজ পেছনের সব হিসাবপাতির মিটমীমাংসা দরকার। শেখ মুজিবরের সঙ্গে একটা দ্বন্ধ-মোকাবেলা দরকার। নইলে সারাজীবন এই মজিবর জ্বালাবে। দুই কান্ধে মুনকার নাকীর হয়ে বসে থাকবে। আর খালি সাতই মার্চের মহাগর্জন করবে – এবারের সংগ্রাম বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম।
না। মুজিবকে এভাবে কাঁধে বসিয়ে নতুন বাদশাহীর কর্মজীবনে সে সুস্থভাবে কাজকাম করতে পারবে না। মুজিবকে আজকেই চিরতরে বিদায় করে দেয়া দরকার। ফারুক রশীদ দৈহিক মুজিবকে নিশ্চিহ্ন করুক। তার আগে খোন্দকারের দরকার মুজিবের আত্মাকে চিরতরে জিন্দানখানায় নির্বাসিত করা।
ওরে মুজিব! তোমাকে আর কত কথা বলবো! কত সুন্দর দিন কাটিয়েছি তোমার সঙ্গে। তোমার সঙ্গে আমি শকুনির মতো ধুরন্ধর হয়ে থাকতে চেয়েছি। তুমি যথার্থ মূল্যায়ন করো নাই। কোথার কোন হারামজাদা তাজুদ্দিন। কমিউনিস্ট। মালাউন কাফির মুশরিক। হিন্দুস্থানের খাস দালাল। তুমি তার সঙ্গে আমাকে একপাতে খাওয়াতে চেয়েছো। তুমি তার সঙ্গে আমাকে মিলমিশ করে রাখতে কোশেশ করেছো। সব জায়গায় খালি বাপগিরি। বাবাগিরি আর ভাবগিরি। তুমি কি জান না মুজিব আমি তোমার বয়েসে জ্যেষ্ঠ। বয়েসেও বড়। বুদ্ধিতেও পাকা। তাজুদ্দিনের সঙ্গে আমার তুলনা। নাউজুবিল্লাহ মিন জালেক। অসতাগফিরুল্লাহ মিন জালেক। তুমি মজিবর, তাজুদ্দিনের পরামর্শ নিয়েছ – আবার আমার কথাও শুনেছ। তাজুদ্দিনকে মিনিস্টারি থেকে বের করে দিয়েও তুমি তাজুদ্দিনমুক্ত হতে পার নাই।
জিন্নাহর মতো পাকা ব্যবসাদার লিডারের ভরাডুবিতে তোমার শেখার উচিত ছিল মুজিবর। তুমি শেখ নাই। আমি শিখব। আমি রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিখেছি। বাবায়ে পাকিস্তান জিন্নাহর পরিণতি কী! সে মরছে কেমনে! বউ কন্যা কেউ পাশে ছিল না। বউ পরমাসুন্দরী রত্না বাই তো কাটায় কাটায় উনত্রিশ বছরেই অক্কা। একদিন কমও না। বেশিও না। বিশে ফেব্রুয়ারি দুনিয়ায় আসছিল। বিশে ফেব্রুয়ারিতেই দুনিয়ার বাইর। বাকি রইল মাইয়া দীনা আম্মাজান। বাবায়ে পাকিস্তান হতে গিয়ে আপন ঔরসজাত কন্যার বাপও থাকতে পারে নাই। মাইয়া যখন শুনছে তার বাপ সারা পাকিস্তানি গো আব্বা – তার একলার বাপ না – সে তখন মনের দুঃখে অগ্নিউপাসক জোরাথুষ্টিয়ানদের সঙ্গে ভাগছে। আর ইহজীবনে বাপজান কিংবা সাধের লাউ পাকিস্তানের ধারে কাছে ঘেষে নাই। জিন্নাহর মরণ হইলো কেমনে! মনের কষ্টে। বহুত বহুত কষ্ট পাইয়া মরছে বাবায়ে পাকিস্তান। গুমরাইয়া মরছে। রাইতের পর রাইত ড্রইংরুমে হাঁটছে। ঘুমাইতে পারে নাই। ঘুমের বড়ি খাইয়াও কাম হয় নাই। পায়ে বাত ধরছে। হাঁটা থামায় নাই। সিগারেটের পর সিগারেট খাইয়াও কাম হয় নাই। বাবায়ে পাকিস্তান হইতে গেছিল। হায়। আর সে কিনা একটা মাইয়ারও বাপ হইয়া টিকতে পারে নাই। জিন্নাহ সাব না পারল পাক-কওমের পাক্কা-বাবা হইতে; না পারল তার স্বপ্নের পাকিস্তান বানাতে।
হায় রে মানুষ। তারপরও কি কেউ জাতির বাবা হতে চায়! ইতিহাস গিলিয়ে দিলেও অনেকে ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। মুজিবর তুমিও নেও নাই। আমি তোমারে এত কইরা বললাম, তাজুদ্দিনের আকথা কুকথা শুনিও না। ওকে স্নেহ করিও না। সবাইকে স্নেহ করা ভালো না। সবাইকে অপত্য স্নেহ দিতে গেলে শেষে আপন জান বাঁচানো কঠিন কর্ম্ম হয়ে দাঁড়ায়। তুমি তো মুজিবর, গ্রামের সামান্য মাতুব্বরের চেয়েও তোমার বিষয়বুদ্ধি কম পাকা। কেমনে যে এত বড় লিডার হইলা। গ্রামে দেখবা, কোনো বুদ্ধিমান বাপ কখনওই ইন্তেকালের আগে তার জায়গা জমিজিরাত, সহায় সম্পত্তি সন্তানদের হাতে দাখিল বন্দোবস্ত করে না। করলেই তো শেষ। জমিজিরাত ভাগবণ্টন হয়ে গেলে সহায় সম্পদহীন বাপকে কোনো সন্তানই দেখে না। আমি তোমারে আকারে ইঙ্গিতে কত বুঝাইলাম, তোমার হইবে সেই অবস্থা। সন্তানরে সব দিয়া তুমি হবা নিঃস্ব-অসহায় হীনবল। কেউ তোমার ভরণপোষণ করবে না।
কে কইছিল তোমারে বাবায়ে বাঙ্গালাস্থান হইতে। জাতির বাবা হতে গিয়া তুমি কী করলা। দেশটারে ভাবলা তোমার তাল্লুক। ঠিক করলা জীবিতাবস্থায় সারাদেশটারে সকল সন্তানের মধ্যে ভাগ করে দিবা। এইটা কি সম্ভব বাবাজীবন। তোমার সন্তান সংখ্যা কত। সাড়ে সাত কোটি। পঞ্চান্ন হাজার পাঁচশ ছাপ্পান্ন বর্গমাইলরে তুমি সাড়ে সাত কোটির মধ্যে সমান ভাগ করে দিবা। কাউরে একটু বেশিও না। কাউরে একটু কমও না। ওরে পাগল। এইটা আদৌ কি সম্ভব। তুমি তাজুদ্দিনরে আমার রিকোয়েস্টে মন্ত্রীগিরি দিয়া সরাইলা। খুশি হইছি আমি। কিন্তু তাজুদ্দিনের ভূত ঘাড্ডি দিয়া নামাইলা না। তুমি গণতন্ত্র গণতন্ত্র করতে ছিলা। ভালো কথা। যত ইচ্ছা গণতন্ত্র করো। কিন্তু তুমি লাইনটা ধরলা ভুল। গণতন্ত্র দুই প্রকার। শোষকের গণতন্ত্র। আর শোষিতের গণতন্ত্র। শোষকের গণতন্ত্র হলো বাস্তব। বিশ্বের দেশে দেশে এই গণতন্ত্র আজ শাসন-সিস্টেম হিসাবে মজবুত ও সফল। দেশ শাসন করবা – ভাওতাবাজি করবা না; শোষণ করবা না – সেটা হয় না রে পাগল। দেশ শাসন মানেই আসলে একপ্রকার শোষণ। গণতন্ত্রের নিশান উড়িয়ে শোষণ। আমেরিকা শতাব্দীর বেশি কাল ধরে এই শোষণ-গণতন্ত্র চালু রেখে বিশ্ব দাবড়াইয়া ফিরছে। তারা কি তোমার-আমার চেয়ে কম বুঝে!
তোমার গণতন্ত্রের নাম কি মুজিবর। শোষিতের গণতন্ত্র। এইটা খায় না, মাথায় দেয়। এইটা যে আসলেই ইউটোপিয়ান তুমি বোঝ নাই!
নিজহাতে পান সাজিয়ে বানিয়ে খেতে দিলাম তোমাকে। তুমি খাইলা না ;তা খাইলা না। তুমি খাইতে গেলা তাজুদ্দিনের পয়জন। আরে ও তো একটা ইবলিশ। সে একবার কারও কান্ধে চড়লে তারে আর নামানো যায় না। হারামজাদা শাকচুন্নি। বদ।
তোমার শোষিতের গণতন্ত্রের কথা যখন শুনলাম। শব্দটা কানে লাগল। তারপরও ঘাবড়াইালাম না। ভাবলাম তুমি পোড় খাওয়া পলিটিক্যাল লোক। নিশ্চয়ই মুখে বলবা শোষিতের গণতন্ত্র। আর কায়েম করবা শোষকের গনতন্ত্র। কিন্তু তুমি যখন তোমার নৌকা দিয়া বাকশাল নামাইলা, তখন বুঝলাম তুমি ঘড়েল না। তুমি করেল হইতে চাইতেছ। তুমি ইউটোপিয়ান লাইন ধরছ। তখনই বুঝলাম তোমার বত্রিশ নম্বরে আজরাইল পচিঁশে জানুয়ারি তারিখ ধরেই ডিউটি দেওয়া শুরু করেছে।
তোমার এই বাকশাল কি জিনিস। নাম একখান জব্বর বাছিয়া লইছো। শুনলেই কেমন শালগাছ শালগাছ মনে হয়। তুমি পত্রিকা কমাইয়া দিলা। চাইরখান মাত্র পত্রিকা। কাজ ভুল করো নাই। গনকন্ঠ মার্কা পত্রিকার কি দরকার। তারায় লিখছে কিনা কামালে ব্যাঙ্ক ডাকাতি করছে। আবে হালার পুতপ্রেসিডেন্টের পোলার ব্যাঙ্ক ডাকাতির দরকার কি! সে চাইলে ব্যাঙ্কই তো বাড়িত আইসা হাজির হইবো। কিন্তু পাবলিকে ফালতু গুজব খায় বেশী। তুমি ভাবলাম গুজব রটনা বন্ধ হইলো। পত্রিকা কম । গুজব মিথ্যা সাংবাদিকতা কম। তোমার কী সরল সোজা হিসাব। এইখানেও ভুল করলা। ভাবলাম রুশিরা পারলে বাংলাদেশ কেন পারবে না।
আরে রুশতে যেটা সম্ভব সেটা বাংলাদেশে সম্ভব না। ইউরোপিয়ানরা হইছে কম কথার জাত। আর বাঙালি হইছে মুখরা জাত। এই জাতটারে প্রতিজনে একটা কইরা পত্রিকা কইরা দেয়া দরকার। তোমার দরকার ছিল গোপনে ছলাকলা করে পত্রিকা নিয়ন্ত্রণ। গুষ্টি গুষ্টি পত্রিকা বাইর করুক। সমস্যা কি। খালি খেযাল রাখা দরকার সেগুলা যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়। তাগোরে ব্যবসা দাও। ইলেট্রিকের খাম্বার কনট্রাক্ট দাও। শিপিং দাও। তেজগাঁওয়ে জমি প্লট দাও। লঞ্চ-বাস-ট্রাকের লাইসেন্স দাও। দেখবা কী সুন্দর তোমার পা চাটতে থাকে।
তুমি তা দিলা না। কী দিলা। বাকশাল। হেতারা সাম্বাদিক। বড়ই সাঙ্ঘাতিক। কী কইলো তারা। রটাইতে লাগল। বাক স্বাধীনতায় শাল মারছে শেখ মুজিবে। কোথায় তাগোওে দিবা ব্যবসাবানিজ্য-টাকাপয়সা। তা না। দিলা শালগাছ।
বাকশালটা কি জিনিস। তুমি বললাম ব্যবসা বানিজ্য আর বাইশ পরিবারের হাতে থাকবে না। বাইশ পরিবারের জায়গায় বাইশপরিবার তৈরী করতে চাও না। সমবায় করতে চাও। জনগনের শিল্প করতে চাও। সবকিছুর মালিক হবে বাইশশ পরিবার না। মালিক হবে সোয়াকোটি পরিবার। মালিক হবে কৃষক; মালিক হবে শ্রমিক। এইটা কি তুমি খলিফা ওমরের আমল ভাবছো। নাকি ভাবছ এইটা সোভিয়েত ইউনিয়ন।
পাশের হিন্দুস্থান কায়েম করছে শোষক গণতন্ত্র। আর তুমি কিনা তার পেটের তলায় কায়েম করবা শোষিতের গণতন্ত্র। এইটা কি সম্ভব। এটা দেশের পয়সাঅলারা মানবে। এইটা কি আর্মির বীরভাইজানেরা মানবে। এইটা কি মধ্যবিত্ত মানবে। কেউ মানবে না। তারপরও তুমি ইউটোপিয়াখানা করলে। মনি সিং আর তাজুদ্দিনের বদনষ্ট বুদ্ধিতেই করলে। তুমি দেশের মানুষের বাপ হইছো তাগোরের মধ্যে সম্পদের সমবন্টন করার তালে বাবাগিরির জন্য করলে। একবারও ভাবলা না সম্পত্তির ছোট শরীক আছে। বড় শরীক আছে।
রাক্ষুসী শরীক আছে। এদের সকলের চাহিদা এক না। আমি তোমার কাছে ছুইটা গেলাম। বারে বারে কইলাম তাজুর বুদ্ধিতে এই কর্ম কইরো না। এইটা বাকশাল না। এইটা সর্বনাশ। এইটা গলার ফাঁস হইবে। তোমারে বললাম গণতন্ত্র-প্রজাতন্ত্র করছো। ভাল কথা। এই ফ্যালাসির মধ্যেই থাকো। গণতন্ত্রের লগে সমাজতন্ত্র মিশাইয়া দিও না।তোমারে তখন বাবাগিরির নেশায় পাইছে। সমবন্টনের নেশায় পাইছে। কিছু করার ছিল না। নেশাগ্রস্তকে নেশার উপকরণ দিতে হয়। ভাল বুদ্ধি দিলে কাজে লাগে না।
কী আর করা । আমি তখন নিরুপায় গোলাম হোসেন। দেখলাম বুদ্ধি অনেক দিছি মুজিবররে। আর দেওনের কাম নাই। তার চাইতে তারে তাল দেই। বাকশালের ট্রেন স্টার্ট দিছে। মিস করন ঠিক হবে না। দৌড়ে ছুটে ট্রেন ধরাই বুদ্ধিমানের কাজ। বাকশালের স্টেশনে দেখলাম ধান্দাবাজ-মাঞ্জাবাজ সবাই আসছে। যে আর্মির জেনারেলদের ভাবছিলাম বাকশালের ধারে কাছেও থাকবে না। কেননা বাকশাল চায় জনগনের আর্মি। জনসেবক উৎপাদনমুখী প্রতিরক্ষাবাহিনী।
আইয়ুব খান-ইয়াহিয়া খানশাহী কায়েমের নবাবী অর্ডারলি আর্মি চায় না বাকশাল। অবাক হয়ে দেখলাম জিয়াউর রহমানও বাকশালে দাখিলের জন্য বিশাল একখান দরখাস্ত নিয়া হাজির। তখনই মনে মনে হাসছি বাকশালের লাইনে গ্যাঞ্জাম লাগতে বেশী দেরী নাই। এই ট্রেন লাইনচ্যুত হতেও বেশী দেরী নাই।
একি সুমধুর খাসখবর শুনিয়ে গেল প্রাণের কোকিলায়! খবর যে এত দ্রুত এত মাধুর্যপূর্ণ হবে খোন্দকারের সারা শরীর আনন্দ শিহরণে কেঁপে কেঁপে উঠছে। খোন্দকার রশীদ তারই জ্ঞাতিগুষ্ঠিরই লোক। বড় কুটুম্ব। বদের বদ। বদের হাড্ডি। কিন্তু বজ্জাতিতে যে সে এইরকম কুলশিরোমনি সেটা সত্যিই খোন্দকার আন্দাজ করতে পারে নাই। রশীদ যখন এসে বলছে ভাষণ একখান ড্রাফট করেন কায়েদ সাব কখন যে রেডিও স্টেশনে গিয়ে রেকর্ড করাতে হয় বলা যায় না।
কিসের ভাষণ; কিসের ড্রাফট খোন্দকার কিছুই বুঝতে পারে নি।
রশীদের সঙ্গে এমনিতেই তার রস-রঙ্গের সম্পর্ক। রশীদের এই কায়েদ সাব সম্বোধন, সেও অনেক পুরানা। ষাট দশকের মাঝামাঝি খোন্দকার কি এক কাজে রাওয়ালপিন্ডিতে পার্ল ইন্টারন্যাশনালে অবস্থান করছিল। হঠাৎ কোত্থেকে এক উর্দিঅলা হাজির। রিসেপশন থেকে কল দেয়া হল খোন্দকারকে। বলা হলো ক্যান্টনমেন্ট থেকে এক ক্যাপ্টেন এসেছে। কথা বলতে চায়। বলছে তার সঙ্গে আপনাকে ক্যন্টনমেন্টে যেতে হবে।
খোন্দকারের ভিরমি খাওয়ার দশা। ক্যান্টনমেন্টের দাওয়াত খেতে সে পশ্চিম পাকিস্তান আসে নাই। নিতান্তই পার্সোনাল কিছু কাজ। ইস্ট পাকিস্তানে কেউ কিছু জানে না। বিশেষ কাউকে বলে কয়েও আসে নাই। এর মধ্যে এই উটকো উৎপাত আবার কোত্থেকে। ক্যান্টনমেন্টে যেতে হবেই বা কেন! পশ্চিম পাকিস্তান মানেই কি ক্যান্টনমেন্ট। আশ্চর্য! আইয়ুবের সেই জমানা।
খোন্দকার রিসেপশনকে জানাল ক্যান্টনমেন্টের কারও সাথে তার আজ এপয়েন্টমেন্ট নাই। সে বিশেষ ব্যস্ত। নীচে নামতে পারবে না।
কিন্তু নাছোড়বান্দা সেই ক্যাপ্টেন। জরুরি তলব। ইমার্জেন্সি এত্তেলা। ক্যাপ্টেনের চেয়েও বেশী ব্যতিব্যস্ত হোটেলের লোকজন। তারা পারলে তুলে নিয়ে যায় খোন্দকারকে। বয় বেয়ারা এসে বেল টিপতে লাগল। কলফোনও অবিরাম বাজছে। মহাযন্ত্রনা। দরজা খুলেই আবার বন্ধ করে দিল অজানা আতঙ্কে। উর্দিঅলা দেখছি খোদ দরজায় এসে দাঁড়িয়ে। কেস কি! এত তাড়া কিসের।
অবিরাম দরজা ধাক্কানো চলছে। দরজা ভেঙেই তাকে তুলে নেবে বুঝি। খোন্দকারের ব্যাক্তিগত রেওয়াজ হল কেউ ভয় দেখালে সে ভয় পায়। অতি সাহস দেখায় না। বিশেষ উচ্চবাচ্য করে না। মানুষের একটা কোমল স্বভাব হল ভীরু প্রতিপক্ষের প্রতি সে বেশ সহানভূতিশীল। কাপুরুষকে সাধারনত প্রথম ধাক্কায় মারে না। প্রতিপক্ষ ভয় পেলে-কান্নাকাটি করলে সে কোমল হয়। আর সবসময় আক্রমন করে বীরকে। কেননা সে জানে আক্রমণ না করলে বীরপুরুষ অবশ্যই তাকে ছাড়বে না। পাল্টা আক্রমণ করবেই।
খোন্দকার ভয় খেয়েছিল প্রচন্ড। সে কিছুতেই দরজা খোলে না। অনেক ধাক্কাধাক্কির পর রনাঙ্গন শান্ত। কোন সাড়া শব্দ নাই। হঠাৎ আবার ডোরবেলের শব্দ।
কে! কে!
তালুই সাব , আমি রশীদ।
কোমল বাঙ্গালি কন্ঠ।
এ আবার কোন রঙ্গ। ক্যন্টনমেন্ট কেসের মধ্যে রশীদ তালই ঢুকল কেমন করে! দরজা না খুলেই সে জানতে চায় রশীদ! কোন রশীদ!
আমি রশীদ। কুমিল্লার খোনকার।
এবার আর দরজা না খুুলে পারে না। আশ্চর্য কান্ড! সেই লম্বা উর্দিঅলাই দাঁড়িয়ে। উঁচা লম্বা। দরোজা ঠেলে সে ঢুকে পড়ে। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হল উর্দিটা তার পা ছুঁয়ে কদমবুচি করল।
খোন্দকার এবার একটু ধাতস্থ হয়ে বসে। ভাল কলে উর্দিটাকে দেখে। বেশ সেয়ানা সেয়ানা চেহারা। চোখে সানগ্লাস।
আমাওে চিনতে পারছেন কায়েদ সাব।
কায়েদ সাব!
হে হে । অল পাকিস্তানে কায়েদ সাব হলেন কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। আর ইস্ট পাকিস্তানের কায়েদ সাব কেবল আপনি। আপনার ওপর আর লিডার কই।
এতক্ষণে খোন্দকার হালে পানি পায়।
ও তুমি কায়েদ বলতে লিডার বুঝাইতেছ। হে হে ..কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। হে হে। আমি হইলাম কায়েদে বাঙ্গাল। সেইটা আগে বলবা না। উর্দু জবান তো আমাদের বিশেষ আসে না। আমি তো ভাবলাম কায়েদ সাব কি জিনিষ। হে হে।
হে হে। আপনি হইলেন গিয়া কুমিল্লার ডায়মন্ড। কায়েদে ইস্ট পাকিস্তান।
রশীদের পূনরাবৃত্তিতে খোন্দকার বেশ খুশি হয়। উর্দিঅলা হলে কি হবে ছেলেটা দেখা যাচ্ছে সহবত, আদব-লেহাজ জানে ।
-তা তুমি কুমিল্লার খোনকার , কোনহানকার! বুড়িচং না দাউদকান্দির। হে হে। চরের খোনকাররা তো আর আসল খোন্দকার না। কুমিল্লা টাউনে গিয়া গোর-খনন করে । মিউনিসিপালিটির খানাখন্দ খোঁড়ে। আর বিলে গিয়া খোন্দকার নাম ভাঙাইয়া বিয়াশাদী করে। হে হে।
তালই সাব, বিল বা চরের না;আমি দাউদকান্দির খোনকার। ইস্ট পাকিস্তানের কায়েদে আজম হইছেন বইলা কি কুমিল্লা-দাউদকান্দির খান্দান সব মিটাইছেন। কুমিল্লা দিয়া ঢাকা আর কয় মাইল।
হে হে হে। অনেকক্ষণ ধরে হাসে খোন্দকার। আরে বুরবাক রসিকতা করলাম আর কি! রস-রঙ্গও কি বোঝ না। উঠে দাঁড়িয়ে গলা মিলায় সে। বুরবাকটা অনেক লম্বা। তার বুকের ওপর পড়ে থাকে খোন্দকারের মস্তক। বিস্তারিত আলাপে খোলাসা হয়রশীদ মিয়া আসলে খোন্দকারের নিকট কুটুম্ব। পশ্চিম পাকিস্তানে পোস্টিং বলে সখ্য-সাক্ষাৎ নাই।
সেই থেকে রশীদের মুখে খোন্দকার সব সময় কায়েদ সাব। ওর মুখে বড় মিঠে লাগে শুনতে। প্রায় এক দশকের বেশী হয়ে গেল রশীদ তাকে ওই নামেই ডাকে। কখনওই ভুল করে নাই।
গেল দশ-এগার বছরে তারা আরও কাছাকাছি এসেছে। রশীদের আদবলেহাজ বরাবর আগের মতই আছে। তবে ইদানিং সে টিকাটিপ্পনি দিতে ছাড়ে না। তালুই সাব, শেখ মুজিবের খালি পাও টিপলে কিন্তু আসল কায়েদ সাব হওন যাবে না। শেখ হইছে হিন্দুস্থানি পয়জন। বেশী টেপাটেপি করলে হাতে গ্যাংগ্রিন হইতে পারে। আসল কায়েদ সাব হইতে হইলে একটু রিস্ক নেওন দরকার।
রশীদের টিটকিরি বিশেষ গায়ে মাখে না খোন্দকার। বরং ওর কথায় বাজি ও বারুদের গন্ধ পায়।
রিস্ক! কিসের রিস্ক।
পাও টেপা কায়েদ সাব হইয়া আর কতদিন থাকবেন! একবার সদরে কায়েদ সাব হওনের চেষ্টা করতেছেন না কেন।
উর্দু ফুটাইও না মেজর। সদরে কায়েদ সাব ভাইঙ্গা কও বুরবাক।
রশীদ যখন ভেঙ্গে বিস্তারিত বলল শুনে শিউরে ওঠার দশা হয়েছিল খোন্দকারের। পিন্ডির সেই নওজোয়ান ক্যাপ্টেন পার্ল হোটেলে যখন প্রথম কদমবুচি করেছিল মনে হয়েছিল তার পায়ের ওপর চুমু খেতে পারলেই সে মহাকৃতার্থ হবে সেই কিনা মাত্র দশ বছরের মাথায় তাকে প্রায় অসম্ভব স্বপ্ন দেখাচ্ছে। স্মার্ট! ওভার স্মার্ট। ছেলেটা আবার মুজিবরের সিক্রেট এজেন্ট নয় তো। কুত্তার মত সে সতর্ক করে কান। রশীদ যা বলছে প্রতিটা শব্দ মাথায় নিয়ে জারিত করা দরকার। বেশ একটা গোলমেলে কান্ডকারখানা ঘটতে চলেছে।
কিন্তু রশীদ কায়েদ সাবের পিছু ছাড়ে নাই। তার সঙ্গে কুমিল্লায় সিটিং দিয়েছে। বার্ডে সিটিং হয়েছে। নানা খোশ গল্প করেছে। দেখা গেল রশীদ নেপথ্যে একলা না। এটা কোন এক কবর-খন্দক মেজরের সিঙ্গেল মিশন না। তার সঙ্গে লোক আছে। চাষী আছে। ঠাকুর আছে। মেজর ফারুক আছে। ডালিম, শাহরিয়ার,বজলু, হুদাবেশ কয়েকটা মেজর-ক্যাপ্টেনও রয়েছে। জেনারেল জিয়াও আছে সঙ্গে। দল ভারী খারাপ না। তারপরও খন্দকার বেশ সতর্ক। জেনারেল জিয়া আছে কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়া দরকার। জিয়া থাকলে কনসপ্রিসি অনেক গভীরে।
দ্য ফিশ ইজ ইন ডিপ সি।জিয়ার সঙ্গে এ নিয়ে একটা ডায়ালগ করতে পারলে ভাল হত। কিন্তু পরিস্থিতি যেরকম তাতে সেইরকম রিস্ক নেয়া সম্ভব না। বাঙ্গালি হইছে হুজুগের পাগল। যেদিকে বাতাসের বেগ বেশীরভাগ ক্ষেত্রে পাল উড়ায় সেইদিকে। শঙ্কর জাত। কালা আছে , ধলা আছে। নাক বোচা আছে। আবার বংশী-নাসিকাও আছে। এই জাতের নির্দিষ্ট কোন চরিত্র নাই। যদি আর্মি মুজিব খান্দানকে মেওে কেটে ফানা ফানা করে ফেলে এই বাঙ্গালি চুপচাপ চেয়ে চেয়ে দেখবে বলে তার বিশ্বাস।
কিন্তু বাইচান্স যদি রশীদ-ফারুক ধরা খায় বাঙ্গালি ওদের চৌদ্দ গোষ্ঠি বাইন্ধা ধইরা পিটাইয়া মারবে। ওদের কোর্টমার্শালে দেওয়া লাগবে না। পাবলিকেই গনপিটুনি দিয়া মারবে। ফারুক-রশীদের নেপথ্যে কারা তাদেরকেও খুঁজে তল্লাশি করে রেসকোর্সে ফাঁসিতে ঝুলাবে। বাঙ্গালির চরিত্র বড় বিচিত্র। সুতরাং সাধু সময় থাকতে সাবধান। ধরা খাইলে মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না। কোনদিকে হাওয়া খন্দকারকে শোচ-সমাঝ করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হল রশীদ খোনকার তার পশ্চাতে কাউট্টা কচ্ছপের মত কামড় দিয়ে পড়ছে। তার পেছন ছাড়ান নাই। মেজর ফারুককে দিয়েছে আর্মির জেনারেল কানেকশন কালেকশন আর রশীদ নিয়েছে পলিটিশিয়ান কানেকশন। কায়েদে ইস্ট পাকিস্তানের ওপর তার বড় আশা ভরসা।
কিন্তু আশা ভরসা তো মিয়া ভাল কথা। সদরে বাংলাদেশ বানাতে চাও। আরও ভাল কথা। কিন্তু সবকিছু ভাল কওে বাজিয়ে না দেখে খন্দকার ঝুঁকি নেওয়ার লোক না। রশীদকে নিয়া আরেক সমস্যা সে আবার বোঝে বেশী। তার বিশ্বাস পিস্তল একটা কপাল বরাবর ধরলেই সিভিলিয়ান পলিটিশিয়ানরা সব টাইট। কথাও ইদানিং বেশী বলে। অঅর খালি কথায় কথায় ইসলামি বিপ্লবী সরকার।
রেভিউলিউশনারী ইসলামিস্ট গভর্নমেন্ট। তার ভাষায় জমহুরিয়া। এই সব চিন্তাভাবনা লিবিয়া থেকে আমদানি। গাদ্দাফির ভুত মাথায় চাপছে। আরে বলদ! বাঙ্গালিরা আরবও না। আফ্রিকানও না। বাঙ্গালিরা হচ্ছে নমশুদ্র চাড়াল দিয়া কনভার্টেট মুসলিম। এই দেশে চাড়ালচামুন্ডাও কনভার্টেড হইয়া দাবি করে সে নাকি আরব ইরান তুরান থেকে আসছে। এই দেশে তাই সৈয়দের কোন অভাব নাই। খোদ নবীর মক্কামদীনায় যত না নবীর সৈয়দানি বংশধর তার চেয়ে অনেকগুন বেশী সৈয়দ আছে এই বাংলায়। কেমনে এটা সম্ভব। নবীর খান্দান সবাই কি সৌদী আরব- কাতার-কুয়েত ফালাইয়া এই মিসকিন দেশে খান্দান গাড়ছে। আসলে সব হচ্ছে ভুয়া সৈয়দ। বাপের নাম ছিল সাইদ্যা। পোলায় হইছে সৈয়দদ্যা।
রশীদকে অবশ্য এইসব জাতিতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব বুঝাইয়া ফায়দা নাই। ওর মাথায় কিছুই ঢুকবে না। তার গোবরপোড়া মাথায় একটা জিনিসই ঢুকছে দেশটার নাম পাল্টাতে হবে। ইসলামিক বিপাবলিক রাখতে হবে। তাহলেই দেশের মানুষ যেমন আফিংটা গিলবে। তেমনি আরব ওয়ার্ল্ডে ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা পাবে। স্বীকৃতি কোন বিষয়ই হবে না। রশীদের মধ্যে খালি জজবা আর জোশ ভরপুর। বাস্তববুদ্ধি বিশেষ নাই। তবে রশীদের ইউটোপিয়ান পরিকল্পনা আর সদরে বাংলাদেশ হওয়ার দাওয়াত শুনতে মন্দ লাগে না খোন্দকারের। তাই মেজরটাকে নিয়ে বেশ কয়েক দফা বৈঠক করেছে। শলাপরামর্শ করেছে।
রশীদের খালি বক বক আর বক বক। তার গালগল্পের শেষ নাই। একদিন দেখা গেল সে পিতলের মেডেল টাইপের একটা চাকতি নিয়ে আসছে। বলল নেন কায়েদ সাব, কোমরে সব সময় বাইন্ধা রাখবেন।
পিতলের চাকতি কোমরে বাধতে হবে কেন! এটা কি কিলার গ্রুপের কোন সিক্রেট আইডি। আশ্চর্য! এই হালারা শেষ পর্যন্ত যদি কামটা সহিসালামতে সারতে না পাওে; রশীদের আর্মি ক্যুপ যদি ভন্ডুল হয়! খোন্দকার তখন মুজিবের হাতে ধরা খাবে নাকি! সভয়ে খোন্দকার বলে কেন! কেন! চাকতি দিয়া কি হবে! আমার মেডেল আছে অনেকটি। আর মেডেল রাখার জায়গা নাই।
কায়েদ সাব এইটা মেডেল না।
কি ওটা!
এইটা রক্ষাকবজ। এটা কোমরে বান্ধা যতক্ষণ থাকবে আপনার মরণ নাই। স্বয়ং আজরাইলও আপনার জানকবজ করতে পারবে না।
লা হাওলা ওয়ালা কুয়াত। ছি ছি। কি বলছে খোনকারের পুত। এটা তো মালাউনের মত কথা বলতেছে। আর জন্মিলে মরিতে হইবেই। এ তো দেখা যায় রক্ষা কবজ দিয়া চিরজীবী হইতে চাইতেছে। এটা তো নমরুদের বংশধর। এটা তো আস্ত দাজ্জাল।
খোন্দকার মনের কথা বিশেষ কিছু রশীদকে বলে না। বরং আলগোছে জানতে চায় এই রক্ষাবন্ধনী কোথায় পাইলা।
রশীদ জানায় আন্ধা পীরের কেরামতি। সে আমারে অবশ্য আরও একটা রক্ষাকবজ দিয়েছে।
কী সেটা।
সেটা আরও স্পেশাল। শত্রুরা যদি সবাইরেও বিনাশ করে ফেলে আমারে খুঁজে পাবে না। আমার খান্দানও যদি খতম হয় আমার কন্যা যদি প্রস্টিটিউটবৃত্তি করেও বেড়ায় আমারে খতম করতে পারবে না। আন্ধাপীর আমারে লুকানোর রক্ষাকবজ দিয়েছে। আল্লা রসুলের পর আমি তার উপর ঈমান এনেছি। তাই সে পুরস্কার হিসেবে গোল্ডিচাকতি দিয়েছে।
গোল্ডি চাকতি! ওইটা কি সোনার!
না। এইটা সোনায় ওয়াশ করা।
খোন্দকার মনে মনে হাসে। বড় ভক্তি দেখিয়ে পিতলের চাকতিটা রাখে। পাগলকে খেপানো ঠিক না। রশীদ তাকেও পীরের দরগায় যেতে বললে খোন্দকার রাজি হয় না। বলে আগে তোমার কথা মত সদরে বাঙ্গালা হই।বাংলাদেশ জিন্দাবাদটা বলি। তারপর ঘটা করে যাব। আর্মিও কনভয় নিয়া যাব।
পীর-মুরশিদের দরগায় বিশেষ করে জিন্দা পীরের দরবারে বিশেষ কারণে খোন্দকার যায় না। পীরবাবারা বেশীরভাগই ভবিষ্যতবানী করে। আর ভবিষ্যৎবানী মানেই কয়দিন আয়ু। কোথায় কোন বিপদ। তারা খালি মৃত্যুর কথা বলে। জন্মিলে মরতে হবেই। সেই মরণের বিবরণ সে পীরের মুখ থেকে অগ্রিম শুনে মৃত্যুভয়ে কাতর হতে চায় না।
রশীদের পাল্লায় পড়ে খোন্দকারের অতি হভাজন চাষীও নাকি পীরের দরবারে গিয়েছিল। গিয়ে সে তার মৃত্যুর আগাম ধারাবিবরণী জেনে এসেছে। পীর বলেছেন তার ইন্তেকাল ঘটবে নবীর দেশে। মক্কা কিংবা মদীনায়। হজের মকসুদ নিয়ে সে তখন সৌদী আরব যাবে। খুবই খোশ খবর। নবীর দেশে ইন্তেকাল সে তো প্রত্যেক মুসলমানের পরম কাঙ্খিত। কিন্তু পরের বিবরণ শুনে চাষীর প্রাণ খাঁচাছাড়া। চক্ষু চড়কগাছ। পীর তাকে বলেছেন তার ইন্তেকাল হবে রানিং গাড়িতে। চাষী মরু প্রান্তরে তখন দ্রুত ধাবমান প্রাইভেট কারে থাকবে। এয়ার কন্ডিশনড। গ্লাস আটকানো। হঠাৎ সেই গাড়ির মধ্যেই সে আটকা পড়ে দমবন্ধ হয়ে নির্মম পীড়ার কবলে মারা পড়বে। গাড়ি থেকে শত চেষ্টা করেও বের হতে পারবে না। জানালার কাচও খুলতে পারবে না। আগুন লাগবে গাড়িতে। পুড়ে চাষী সাহেব কালো কয়লার মত অঙ্গার হয়ে যাবে।
চাষীর অত্যন্ত শক্ত মনোবল। ধীরস্থির। তারপরও নাকি সে কয়েকদিন দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারে নাই। খালি স্বপ্ন দেখে গাড়ির মধ্যে দমবন্ধ হয়ে আটকা পড়েছে। দাউ দাউ দোজখের আগুন। ঘুমের মধ্যেই ইন্না লিল্লাহ হয় হয় এমন অবস্থা।
এই চাষীও আছে রশীদ ফারুক গং-এর শিবিরে। সে ইন্টারন্যাশনাল কানেকশনগুলো দেখছে। তার সঙ্গেও রশীদ ফারুক সমভিব্যাহারে বার্ডের গেস্ট হাউজে ,দাউদকান্দির বাড়িতে স্পেশাল সিটিং মিটিং হয়েছে খোন্দকারের। ঠাকুরও ছিল তাদের সঙ্গে। সেখানে চাষীর কয়েকটা কথা খুবই তত্ত্ব সমৃদ্ধ মনে হয়েছে। চাষীর যত মাথা ব্যাথা বাকশাল নিয়ে। তার কথা হল আমেরিকা, বৃটেনসহ পুজিবাদী বিশ্ব বাকশাল সিস্টেম একদমই চায় না। কেননা এইটা সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারনার ফসল। তাই তাদেরকে গেলানো সম্ভব হয়েছে বাকশাল রুশ-হিন্দুস্থানি সেমি-কমিউনিস্টদের ব্লুপ্রিন্ট।
আরব তথা মুসলিম ওয়ার্ল্ডও বাকশালের বিপক্ষে। গোলাম আযম তাদের খাইয়েছে বাকশাল একটা কমিউনিস্ট কারবার। ধর্ম থাকছে না। মুসলমানের দেশ রাতারাতি নাস্তিক কাফেরের দেশ হতে চলেছে। সুতরাং বাকশালকেই শেখ মুজিবের গলার ফাঁস বানাতে হবে। এই জন্য প্রোপাগান্ডার কোন বিকল্প নাই। গুজবের টাইফুন বইয়ে দিতে হবে সারাদেশে।
শেখ মুজিবে ধর্মনাশ। শেখ মুজিবে মানুষের ব্যাক্তিগত ধনসম্পদের সর্বনাশ। সব জায়গাজমি কলকারখানা বাড়িঘর রাষ্ট্রের নামে কুক্ষিগত করে সে রাজতন্ত্র কায়েম করার নীল নকশা করছে। সবকিছু হবে মহাসম্রাট মুজিব আর ক্রাউন প্রিন্স শেখ কামালের সম্পদ।
বেদুঈন শেখ ইবনে সৌদ যেমন আরব মুল্লুকের নাম নিজের নামে সৌদী আরব রাখছে। সেখানে তার খান্দানি বাদশাহী রাজতন্ত্র কায়েম করেছে আমাদের শেখও তেমনি বাকশালের নামে মুজিবশাহী কায়েম করতে চলেছে। একাত্তরে মেহেরপুর চুয়াডাঙ্গায় অস্থায়ী রাজধানির নাম মুজিবনগর রাখা হয়েছিল। এখন ঢাকার নাম পাল্টানোর চেষ্টা চলছে। যে কোন সময় ঢাকা পাল্টে হবে মুজিবনগর।
ওরা পারলে দেশটার নামই মুজিবিবাংলা রাখে। বাঙ্গালি পাবলিক এইসব হুজুগে গালগল্প বেশ খাবে। গুজবের বড় টেস্ট। এই জিনিস পেট ভর্তি করে ঢেঁকুর তুলে আকন্ঠ ভক্ষণের জন্য বাঙ্গালি সদা প্রস্তুত। মুজিবকে যদি নির্বংশ করা সম্ভব হয় তারপরও গুজবের বন্যা বইয়ে দিতে হবে। বলতে হবে মুজিব রাজবংশের পতন ঘটিয়েছে বীর সেনাবাহিনী। থামলে চলবে না। গুজব গীবৎ থামালেই পাল্টা অভ্যুত্থান। আর যতক্ষণ বাঙ্গালিকে গুজব-গীবৎ প্রোপাগান্ডার মধ্যে চুবানি দিয়ে রাখা যাবে ততদিন বাঙ্গালি টু শব্দটিও করবে না। আইয়ুব ইয়াহিয়া যে কাজটা পারে নাই সেই কাজ এবার আর কঠিন হবে না। চলবে…
অলংকরণ: শিল্পী শাহাবুদ্দিন ও উত্তম সেন