আকুল হয়ে দোয়া-খায়ের করেন তিনি। নির্জন সেল। মুজিব পরিষ্কার সুললিত উচ্চারণে তিলাওয়াত করেন। মন্দ্রকণ্ঠের আওয়াজে গম গম করে কক্ষটি। দোয়াও করেন ব্যাকুল ভাষায়। একজন জেলর তত্ত্বাবধান করছিল শেখ মুজিবের। আড়াল থেকে অনুসরণ করে মুজিবকে। একা একা কী কাজ করে এই পাকিস্তান লণ্ডভণ্ড করা মানুষটা। কী বলছে সে আল্লাহর কাছে। সে বিস্মিত হয় মুজিবের বীররসে। মৃত্যুর দড়ি একরকম গলায় ঝুলিয়েও দুর্বল হচ্ছে না মানুষটা। এখনও সে তার দেশ-কওমের দুশ্চিন্তায় কাতর। মুজিবের আচার আচরণে শ্রদ্ধাবনত হয়ে পড়ে লোকটা।
ওদিকে জেলখানার মধ্যে নানা রহস্যজনক তৎপরতা শুরু হয়েছে। মুজিবের সেলের পাশেই মাটি খোঁড়ার শব্দ। কবর খোঁড়া হচ্ছে। কবর খোঁড়া শেষই হচ্ছে না। খাবার দেওয়ার লোক আসে। সেই হুজুর আসে। মুজিবের কৌতুহল হয় – কিসের শব্দ। কী খোদাই হচ্ছে ওখানে। খোঁড়াখুড়ি শেষ হচ্ছে না কেন। জবাব দেয় না তারা। তাদের মুখ গম্ভীর। থমথমে। তাদের মধ্যেও আতঙ্ক। মুখে কুলুপ আঁটা। ভাবভঙ্গিতে তারা বুঝিয়ে দেয় – কথা বলতে মানা। হুজুরটা এসে আবার বলে যায়, কবরের অন্ধকারের কথা। মাত্র সাড়ে তিনহাত জমি। এক বিঘৎও বেশি না। আপনার বুকের ওপর মাটি। পিঠের নীচে মাটি। আপনার ডাইন কাইতে মাটি। বাঁও কাইতেও মাটি। বাত্তি নাই। চাটাই নাই। বিছানা নাই। কোল বালিশ নাই। তক্তপোষ নাই। খালি সাপ খোপ কিলবিল করবে সেখানে। অজগরের চাইতে বিশাল পর্বত সমান সাপ। মাটির প্রেশার সবদিকে। বুকের ওপর আর পিঠের নীচে এমন চাপাচাপি করবে – হাড্ডিগুড্ডি সব গুঁড়া গুঁড়া হয়ে যাবে।
মুজিব বুঝতে পারেন না – কী হচ্ছে এসব। কেন তাকে প্রতিদিন এসব বলা হচ্ছে। কী চাইছে ইয়াহিয়া। সে কি আতঙ্কগ্রস্ত করতে চাইছে তাকে। সে কি ভাবছে – কবরের ভয়ে, আজাবের ভয়ে কাবু হয়ে যাবে শেখ মুজিব। প্রাণভিক্ষা চাইবে!
ওরে ও ইয়াহিয়া। তুমি এই মুজিবকে চেনো না। তুমি পাঞ্জাবি চেন, পশতু চেন – তুমি বাঙ্গালীকে এখনও চেনো নাই। তোমার এই জীবনে আর চেনা হবে না। ওরে ইয়াহিয়া – আমি তো সেই যৌবন থেকেই মরণের জন্য প্রস্তুত। যখনই আমার মাথায় ঢুকছে বাঙালির কথা; আমার দেশের দুঃখি মানুষের কথা – সেদিন থেকেই তো আমি মাথায় কাফনের কাপড় বাইন্ধা নিয়েছি। তুমি যতই ছলাকলা করো; বদমায়েশি করো – বাংলার মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না।
খোন্তার শব্দ, কোদালের শব্দই বা কেন! তাকে কি কবর দেয়া হবে এই জেলখানার মধ্যেই। নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলার ষড়যন্ত্র। তার জানাজাও কি পড়তে দেয়া হবে না! এইখানে কোনোভাবে হত্যা করে পুঁতে রাখতে চাচ্ছে নাকি এরা। ভাবছে, তাহলে মুজিবের নাম ও নিশান রইল না।
আল্লাহর দরবারে আবার দুই হাত তোলেন শেখ মুজিব – হে পরওয়ার দিগার, হায়াত-মওত আমি তোমার হাতে সোপর্দ করলাম। বাংলার মানুষের জন্য আমি জীবন কুরবানি করতে প্রস্তুত। হে রব্বুল আলামিন, আমারে ইয়াহিয়া মারে মারুক – ফাঁসি দিক; বিষের ইনজেকশন দিক – হে মাওলা আমার মৃতদেহ যেন সোনার বাংলায় যায়। আমার মায়ের দেশে যায়। আমার এই অন্তিম ফরিয়াদ তুমি কবুল করো আল্লাহ। আমার বাঙ্গালি যেন আমায় শেষ দেখাটা দেখতে পায়।
মাঝে মধ্যে গভীররাতে আরেক তাণ্ডব। অনেকগুলো লোক মিলে চিৎকার করতে করতে ছুটে যাচ্ছে তার সেলের কাছেপিঠে দিয়ে। তিনি বিকট সেই আওয়াজ শুনতে পান। হৈ হট্টগোল করতে করতে তারা ছুটছে। কখনও তাদের আওয়াজে মনে হয় কোথাও দাঙ্গা হাঙ্গামা করতে চলেছে। কিংবা কাউকে খতম করে এলো। জেলের মধ্যেই তারা খতম খতম বলে শ্লোগানও দিচ্ছে। কিসের খতম, কাকে খতম!
একদিন সেই জেলর আসেন মুজিবের কাছে। সজ্জন লোক। জানান, আপনার জান নিরাপদ নয়। নানারকম রহস্যময় ঘটনা ঘটছে জেলখানার ভিতরে। তিনি জেলার হয়েও নিরুপায়। আর্মি এজেন্সির লোকজন নানা পরিচয় নিয়ে ঢুকেছে। তারা কয়েদি সেজে ঢুকেছে। জেলরদের কিছু করার নেই। কিন্তু একজন ঈমানদার দেশপ্রেমিকের হেফাজত করা তিনি তার ডিউটি মনে করছেন। নয়তো আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবেন তিনি। মুজিব তার কাছে পবিত্র আমানত।
জেলরের কথা শুনে মুগ্ধ হন শেখ সাহেব। সত্যি আশ্চর্য। দাজ্জালের দেশেও দুয়েকজন সৎ ও সাহসী মানুষ তাহলে অবশিষ্ট আছে। জেলর তাকে আরেকটি গোপনীয় সেলে নিয়ে রাখেন। অতি সংক্ষেপে জানান, তাকে জেলখানার মধ্যে হত্যার কথা তিনি গোপন সূত্রে জেনেছেন। এজন্য জেলরকে না জানিয়ে ট্রেইন্ড ট্রুপস ঢোকানো হয়েছে জেলের ভেতরে। এরা মুজিবকে জেলের মধ্যেই খতম করে দিলে জেলরের কিছুই করার থাকবে না। এরা নানা হাঙ্গামা ঘটাচ্ছে। আগে এমনটা কখনওই হয় নাই।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহটা ইয়াহিয়ার। দম্ভ আর অহঙ্কারে একটা পা সে দিব্যি আকাশে তুলে দিয়েছে। আর মাথাটা হেলান দিয়েছে রাওয়ালপিন্ডিতে। এখন যা ইচ্ছা তাই করবে। পুরো ওয়ারপ্ল্যান তার টেবিলে সাজানো। সে নিজেই তার জবরদস্তি জঙ্গিপনা দেখাবে। ইন্ডিয়া তার কাছে নস্যি। জেনারেল স্টারমার্কে আর তাকে মানাচ্ছে না। গায়ে চড়ানো খাকি উর্দি আর ব্যাজগুলো ছুড়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। এইসব এখন বাতিল মাল। তার নিউ ড্রেস চাই। প্যারিসের টেইলরের বানানো। তাতে থাকবে মালাউন রক্তের উষ্ণ সুরভি। নতুন ফিল্ড মার্শাল ব্যাজটা বানিয়ে দেবে নিক্সন। কিসিঞ্জার এসে নিজ হাতে পরিয়ে দিয়ে যাবে তাকে। ফিল্ড মার্শাল তকমাটা তারও চাই। আইয়ুব ছিল স্বঘোষিত ফিল্ড মার্শাল। সেল্ফমেইড ক্যারিকেচার। তামাশা। পয়ষট্টি সালে আসলে সে হিন্দুস্থানের কেশাগ্রও ছুঁতে পারে নাই। তাতেই কত লম্ফঝম্ফ। আর এখন ইয়াহিয়া সেই ইন্ডিয়াকে মাটিতে মিশিয়ে দিতে চলেছে। ফিল্ড মার্শাল তকমা তাই তারই প্রাপ্য।
রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তানের তাবৎ ফৌজী কসাই-বখতিয়ার-তুঘলকরা উপস্থিত। গোলাম পাকিস্তানিও সেখানে হাজিরান মজলিশ। ইস্ট পাকিস্তান , ওয়েস্ট পাকিস্তান সর্বত্র যুদ্ধের নিনাদ বাজছে। শেখ মুজিবকে নিয়ে দারুণ একটা সুবর্ণ সুযোগ পাওয়া গেছে। সব মালাউন, কাফেররা পাক-ই-স্থান ছেড়ে হিন্দুস্থানে গিয়ে উঠেছে। ইন্দিরা এই কোটিকে খাদ্য বস্ত্র দিতে গিয়ে ফতুর হতে চলেছে। ভুট্টো একটা জায়গায় অসম্ভব ক্যারিশমা দেখাচ্ছে। আমেরিকার নিক্সন-কিসিঞ্জার পাকিস্তানের সঙ্গে গাঁটছড়া বেধেছে। এই জায়গাটায় ঈমানী জজবা দেখাচ্ছে। কথা তারা রাখবেই। সপ্তম নৌবহর যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। শুধু শেখ মুজিব কেন – শুধু বাংলাদেশ কেন, সারে হিন্দুস্থানকে খতমের গোলাবারুদ, কামান, জঙ্গিবিমান সেই বিশাল জাহাজে থাকবে। এত বিশাল সেই নৌবহর – সাগরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত সেটার আয়তন। বঙ্গোপসাগরে এসে নোঙ্গর করল বলে। এর আগেই যতটা সম্ভব হিন্দুস্থানকে ফানা ফানা করে ফেলতে হবে। দুনিয়ার মানচিত্র থেকে ইন্ডিয়াকে চিরতরে মুছে ফেলতে হবে। সারে দুনিয়াজাহানকে দেখিয়ে দিতে হবে – ইস্ট এন্ড ওয়েস্ট, পাকিস্তান ইজ দি বেস্ট। পাকিস্তানের সার্চলাইট – হিন্দুস্থানের গলায় টাইট।
তেসরা ডিসেম্বর ভারতবর্ষে আচমকা কেয়ামত শুরু হল। পশ্চিম ফ্রন্টে অতর্কিতে হামলা চালাল পাকিস্তান। বিকেল পাঁচটা সাতচল্লিশ মিনিটে পশ্চিম ভারত লণ্ডভণ্ড। ফরাসি মিরেজ আর মার্কিনীদের তৈরি স্যাবর জেটগুলো পাকিস্তানি বিমানঘাটি থেকে আগুনের গুদাম হয়ে উড়ে এল ভারতে। টনকে টন বোমা ফেলতে লাগল তারা। আকাশ থেকে যেন গলন্ত আগুন ঢেলে দিচ্ছে। শ্রীনগর, অমৃতসর, ফিরোজপুর, চন্ডিগড়, অবন্তীপুর, ফরিদকোট, পাঠানকোট, সাদেখ, ওকহা, যোদপুর, উত্তর লাই, আম্বালায় বোমার পর বোমা ফেলতে লাগল। অমৃতসর হামলা নজিরবিহীন। দিল্লির কাছে আগ্রায় অবিরাম বোমাবর্ষণ।
ইয়াহিয়ার ফিল্ড মার্শাল হওয়া কে ঠেকায়। দিল্লির লাল ফোর্টে কফি পান এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইস্ট ফ্রন্টে আগরতলায় বিমান হামলা হলো।
পাকিস্তান পদাতিক বাহিনীও কম যায় কিসে। তারাও বন্দুক কামান ট্যাংক নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ল। পুঞ্চ, কাশ্মীর লাইন অব কন্ট্রোল দিয়ে ঢুকে পড়ার উচ্ছ্বাসে তারা বেসামাল। হিন্দুস্থান ওদের মুঠোর ভেতরে!
ভারত হতবাক। ইন্দিরা গান্ধী বিস্মিত। তিনি এসেছিলেন কলকাতায়। শরণার্থী শিবির দেখেছেন। কোটি মানুষের স্বাধীন হওয়ার উচ্ছ্বাস-আকুতি শুনেছেন। কয়েক মাস ধরে তার কোনো বিশ্রাম নেই। অবিরাম ছুটে চলেছেন বিশ্বের নানা দেশে। বাংলাদেশে গণহত্যা, মানবিক বিপর্যয় তুলে ধরেছেন ইউরোপে-জাতিসঙ্ঘে। বলেছেন, মানুষকে রক্ষা করতে হবে। লাখো কোটি মানুষকে এইভাবে নির্বিচার-নিষ্ঠুর-নির্মম হত্যার শিকার হতে দেয়া যায় না। বিশ্ববিবেক এভাবে চুপ করে বসে থাকতে পারে না।
হাজার হাজার মাইল ছুটতে ছুটতে অক্লান্ত ইন্দিরা বিকেলে এলেন বিগ্রেড ময়দানে। কলকাতাবাসী তথা ভারতবাসীর উদ্দেশে কিছু বলবেন। বিষণ্ণ। বাংগালি গণহত্যার উপর্যুপরি দুঃসংবাদে তিনি মুহ্যমান। তার কণ্ঠ শোক-ভারাতুর। ঠিক সেই সময়ে হাতে এলো চিরকুট। পড়লেন মঞ্চে দাঁড়িয়েই। আকাশ দেখলেন। বিগ্রেডভরা মানুষের দিগন্তরেখা দেখলেন। চিরকুট নিয়ে কিছু বললেন না। কেবল বক্তৃতা সংক্ষেপ করলেন। দ্রুত তিনি ছুটে চললেন দিল্লি।
মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য পাকিস্তান বাহিনীর ভয়ঙ্কর বীরত্ব। মর্দানি আর কাকে বলে। কিছুতেই ভারতকে রেহাই দেবে না। টুটি চেপে বিনাশ করবে। নিঃশ্বাস প্রশ্বাস বন্ধ। পশ্চিম ফ্রন্টে নিঃশ্বাস বন্ধ। পূর্ব ফ্রন্টে প্রশ্বাস বন্ধ। মর্দে পাকিস্তানের সঙ্গে লাগতে আসা! এই মচ্ছবে গোলাম পাকিস্তানি কি ভাগ না নিয়ে পারে। সেও তো আরেক ফিল্ড মার্শাল। জামাতি খতমী মার্শাল। তার প্রশিক্ষিত সৈনিকরা কম কিসে! ইস্ট পাকিস্তানে তার তিন তিনটা খতমী বাহিনী। তিন তিনটা শিবির খুলেছে সে। রেজাকার, আলবদর, আলশামস।
পিন্ডি থেকে সে গ্রিন সিগনাল দিয়ে দিল। রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলরা দখল নিচ্ছে হিন্দুস্থানের। গোলামের নেয়া চাই ইস্ট পাকিস্তান। গোলামের স্টাইল অবশ্য ভিন্ন। ছাত্রসঙ্ঘকে দিয়ে মাসের পর মাস জিল্লতি করিয়ে জবরদস্ত লিস্ট করেছে। এখন সেই লিস্ট কাজে দেবে। টিক্কা-নিয়াজির ভুল গোলাম করবে না। লাখ লাখ মানুষ কতল করা হয়ে গেছে। এবার মাথা কাটতে হবে। গোলামের টার্গেট এবার ভার্সিটির পন্ডিত – সব মালাউন দালাল। গোলামের টার্গেট ইনটেলেকচুয়াল।
গোলামের টার্গেট পলিটিশিয়ান,শিক্ষক,অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র। এদের সবাইকে খতম করা দরকার। বাঙ্গালির এই মাথাগুলো যদি কাটা যায় – তাহলে আর পুরো কওমটাকে কষ্ট করে হত্যা করতে হবে না। মাথা ছাড়া কতক্ষণ ছিন্নভিন্ন দেহটা টিকবে। এই হারামজাদাগুলোই নষ্টের গোড়া। ওরাই বাঙ্গাল জাতটাকে ক্ষেপিয়েছে। নষ্ট করেছে। বে-ঈমান করেছে। হারামজাদারা চেতনা ফুটায়। প্রগতিশীল চেতনা, অগ্রসর চিন্তা! এবার খুঁচিয়ে কুপিয়ে ওদের চেতনা বের করা হবে।
পাকিস্তানি জল্লাদদের কাছে ট্রেনিং নিয়েছে গোলামের আলবদর-আলশামস। ইয়াজুজ মাজুজের মত এরা বিকট-ভয়ঙ্কর। নৃশংসতায় রাতারাতি এরা টিক্কা-চাক্কাকে টেক্কা দিতে লাগল। তাদের স্টাইল হরর কিলিং। মইত্তা রাজাকার, জল্লাদ কামরুজ্জামান, কসাই কাদের, মুজাহিদ, সোবাহান, ইউসুফ, আবুল কালাম আজাদ, মেশিনম্যান সাইদী – এক একটা নিশানে এ হায়দার। রক্তে মাংসে বাঙ্গালি আওরতের পয়দা – কিন্তু কাজে কামে পশ্চিম পাঞ্জাবের সিংহ। বাঙ্গালাকে কয়েকটা সেক্টরে ভাগ করে নিল তারা। লারকানার হায়দারি হাঁক দিল। রক্তের বন্যা বইয়ে দিল তারা। ঢাকাতেই দু’শ বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করল। খুবই নিরীহ-টাইপ স্টাইল। কুলব্লাডেড কিলার। শিক্ষকদের বাসায় যায়। ডাক্তারের কোয়ার্টারে যায়। বলে, স্যারের সঙ্গে দেখা করতে আসছি। স্যার বেরিয়ে আসলেই ফরমান – ক্যাম্পে ডাক পড়ছে আপনার। আমাদের সঙ্গে চলেন।
তারপর মিরপুর লাশখোলা, মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ক্যাম্প। আলবদররা ধরে আনে বুদ্ধিজীবী। আলশামসরা উঠিয়ে আনে বুদ্ধিজীবী। ক্যাম্পে মইত্তা রাজাকার, কাদের মোল্লা, মুজাহিদ খতমের সিল মারে। কোনো কমিউনিস্ট দেখলে খ্যাক খ্যাক করে। হারামজাদা নাস্তিক, আল্লায় বিশ্বাস করিস না। এক্ষুণি তোকে আল্লাহর কাছে পাঠাইতেছি। আল্লায় তোর মুনকার নাকীরের হিসাব নিবে।
মওতের হুকুম হলেই আজরাইল আসে। কাউকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা। কাউকে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার। হাতে সময় কম জল্লাদদের। পুরো বাঙ্গাল-মেরিটকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। গোলাম পাকিস্তানির দলিলি হুকুম। মদুদির হুকুমে আহকাম। সারাদেশে জেলায় জেলায় তালিকা করল ওরা। তালিকা ধরে ধরে হত্যা। কোথাও কাউকে রেহাই দেয়া হবে না।
তাদের মস্তিষ্কে গোলামের ব্লুপ্রিন্ট। এই ব্লুপ্রিন্টের উদ্দেশ্য বিধেয় ভিন্ন। সুদূরপ্রসারী। গোলামের আছে দুই চক্ষু। একটা শকুনের। অন্যটা ভুশুন্ডির। শকুনের চোখে সে আজকের কবরস্থান ইস্ট পাকিস্তানকে দেখছে। যেমন তীক্ষ্ণ চোখ। তেমনি সূঁচাল ঠোঁট। তেমনি ধারাল নখ। ঠোঁটে লাশ খুটছে। কলিজা খুবলে খাচ্ছে। ঘিলু উপড়ে খাচ্ছে। তার খাদ্য তালিকায় এখন আর আম আদমী নেই; আম বাঙ্গাল অনেক হয়েছে ভক্ষণ। বলাৎকার হয়েছে কয়েক লাখ। এখন চূড়ান্ত টার্গেট হলো খাস বাঙ্গাল।
পিন্ডি-লাহোর বসেই গোলাম তার শকুনী লম্বা ঠোঁট প্রসারিত করছে ফিজিক্যাল ক্যাম্পে। মিরপুরের লাশ খোলায়। বিহারী জল্লাদখানায়। অনেক দিনের সাধনা। অনেক সাধ্য সাধনা। জোর্তিময় গুহঠাকুরতা, মুনীর চেীধুরী, জহির রায়হান, আলতাফ মাহমুদ, শহীদুল্লাহ কায়সার – এরা ছিল তারই একান্ত ব্যক্তিগত টার্গেট। জোর্তিময় দর্শনগিরি মাড়ায়। মালাউন আবার ঈশ্বর-নিরীশ্বরের দার্শনিক হইছে। বহুর যোগাসনে একেশ্বর-সর্বেশ্বর! ঈশ্বর আছে কি নাই – ফিলসফি মাড়ায়।
বাংলা পড়াবি পড়া – আবার নাটক লেখস নোয়াখাইল্লার পো। বোনকে মঞ্চে নামিয়ে নাটকগিরি করস! মুসলমান জেনানাদের পর্দাপুশিদার বাইরে আনার ষড়যন্ত্র করস। কমিউনিস্ট। নাস্তিক। ফিল্ম বানাস! পাকিস্তান নিয়ে ঠাট্টামশকরা করস! জীবন থেকে নেয়া! তোর জীবন এবার নিচ্ছি। মাগীবেটির লগে আইয়ুব খানের মত মহৎ লিডারকে তুলনা করস। গান করস! রবীন্দ্র শতবার্ষিকী করস! মুসলমানের দেশে মালাউন কবির কবিতা এস্তেমাল করস! আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো… মূর্তিপুজার গান করস! কিসের বায়ান্ন। গোলামরে বায়ান্ন শেখাস! তিনটা পোলারে কোলে লইয়া মাতারি-মাগীর কান্নাকাটির মূর্তি বানাস!
সেই বায়ান্ন সাল থেকে গোলামের মনের মধ্যে তীব্র খায়েশ – এই হারামজাদাগুলোকে সাইজ করবে। ওদের রবীন্দ্রগিরি চিরতরে ছুটিয়ে দেবে। ওদের গানকবিতার কণ্ঠে গলন্ত সীসা ঢেলে দেবে। রবীন্দ্রপূজা-মিনারপূজার সাধ মিটিয়ে দেবে। এই মজিবরের জন্য কিছু পারা যায় নাই। মুজিবর সবাইকে বুকে আগলে রাখছে। আজ মুজিব খতম হচ্ছে। এই জশন-রোশনাই ক্ষণে খতম করতে হবে পাক-কওম ও মিল্লাতের এই দুশমনদের। গোলাম নিজ হাতে তাদের গলা কাটতে পারলে সর্বোত্তম সুখ পেত। কাদের-মইত্তা-মজাহেদদের কাছে সে কতলের হুকুম দিয়ে আসছে। ট্রাঙ্কলে সুখবর আসছে। খবর দিচ্ছে মীরকাসিম – খবর দিচ্ছে আশরাফ-আজহার। গোলামের শকুন ঠোঁট লম্বা দিয়ে পৌঁছে যায় লাশখোলায়। মুনীর-আলতাফ-শহীদুল্লার মাথার খুলি ঠুকরে ঠুকরে ফুটো করে।
তারপর প্রবল উল্লাসে, উম্মত্ত আনন্দে নাস্তিক-মালাউনদের ঘিলু খুবলে খায়। এই ভোজ উৎসবের সে অপেক্ষায় সেই বায়ান্ন সাল থেকে। গোলামের আরেকটা চোখ ভুশুন্ডির। দূর ত্রিকালদর্শী বহুদর্শী চোখে সে ভবিষ্যতকে দেখতে চায়। যদি পিন্ডি ব্যর্থ হয়, ইয়াহিয়ার পতন ঘটে, যদি অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলার। তখনও হারতে চায় না গোলাম। আগামীকালের পরের কালে আবার হয়তো চানতারা নিশানের দিন আসবে – সেদিনের জন্য বিষবীজ সে রোপণ করতে চায় আজই। ইয়াহিয়ার মত দোনোমনা করলে তার চলবে না। এখনই উত্তপ্ত সময় আর হত্যার উৎসবের ডামাডোলে সে মগজশূন্য করবে বাংলাকে। পাকিস্তান যদি ধসেও যায় – গোলাম-জামাতিরা যেন মস্তিষ্কহীন বাংলায় নতুন করে নিজেদের বিষবৃক্ষ রোপণ করতে পারে। গোলাম তার খতম বাহিনীকে হুকুম দিয়েই রাওয়ালপিন্ডি গেল – খতম শেষে মর্দে আলশামস, আলবদররা যেন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায়। যখন যেমন অবস্থা – সেই মতন ব্যবস্থা।
দরকারে যেন তারা মুখোশ বদলে ফেলে। বৈরী সময়ে প্রয়োজনে তারা যেন শিক্ষকতা, ইমামতি, ওয়াজকেরাত, সামাজিক ব্যবসা-বাণিজ্য, জাকাত-হালাল-হারাম-সুদ-শরীয়ার ব্যবসা – এইসব পেশায় জড়িয়ে পড়ে। গোলাম পুরো ব্লুপ্রিন্ট দিয়েই গেল অনুজ ঘাতকদের হাতে।
ইতর প্রাণীর উত্তেজনা বেশি হয়। হঠাৎ উত্তেজনার প্রাবল্যে তারা বিকট-ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। ইয়াজুজ মাজুজের চেয়েও কদর্য-জানোয়ারি শুরু করল তারা। আলবদর-আলশামস যাদেরকে উঠিয়ে নিয়ে গেল, তাদেরকে পাঠাল চির নিরুদ্দেশের দেশে। খতমের তরীকা তাদের উদ্দীপনা-উদ্ভাবনায় ভরা।
মুজিবভক্ত মশিউরের বাসায় পাওয়া গেল বাংলাদেশের পতাকা। শিকারকে ধরে এনেই হত্যা করল না। তার মাথায় বাংলাদেশের নবীন পতাকা বেঁধে দিল। তারপর হাত কাটল। পা কাটলো। চোখ উপড়াল। আরেকদিন আরেকটা হাত। আরেকটা পা। মশিউর লাশ হয়ে গেল। ওদের খুনের উৎসব থামল না। লাশকেও মত্ত উল্লাসে কেটে চলল তারা। রগ কাটল। কান কাটল। সোনালী রঙ্গে ছাপ দেয়া ছাপ্পান্ন বর্গমাইলের মানচিত্র খচিত লালসবুজ পতাকা মশিউরের রক্তের সাগরে ভিজে গেল।
বাইগার নদীর জল কাকচক্ষু কালো। নদীর তীরের বৃক্ষরাজি বড় ম্রিয়মান। বিপন্ন, বিষণ্ণ। ছোট্ট রাঙ্গা হালতি পাখিটা চুই চুই করে আকুল হয়ে ডাকছে। বড় নিঃসঙ্গ। বড় একা। কোথাও যেন কেউ নেই। পাখিটি আকুল হয়ে খুঁজছে। পাচ্ছে না। বৃক্ষবনের শ্যামল-গভীরে ঝরে পড়ছে পাতারা। আশ্চর্য নীরব সব শব্দ। দূর দক্ষিণে, আরও দক্ষিণে বাইগারের জলকাকলিতে কেবলি অশ্রুধারা। গভীর রাতে নিঝুম আকাশের ধ্রুবতারা ঝাপসা ম্লান হিমালয়-মেঘে।
খোকাকাকার সঙ্গে কথা হয়েছে হাসিনার। লন্ডন থেকে ফোন করেছিলেন তিনি। কথা তেমন বেশি কিছু নয়। কেমন করেই বা হাসুকে সামলাবেন খোকাকাকা। ঢাকার খবর কেমন করেই বা তিনি বলবেন। কী বলবেন। ফোনের মধ্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলেন হাসিনা। কী খবর ঢাকার। কী হয়েছে বাড়িতে!
কাকা জবাব দিতে পারেননি। অনিরুদ্ধ ক্রন্দন তাকে বাষ্পরুদ্ধ করে ফেলছিল। কাকা নিজেকে সম্বরণ করতে পারছিলেন না। হাসিনা অনুভব করছিলেন কাকা কাঁদছেন। কিন্তু কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না কেন কাকা! নীরবতা গ্রাস করে নিচ্ছে সব অনুভূতি। কাকা কেবলি বলছিলেন, লন্ডন আয় মা। কতকাল তোদের দেখি না।
তিনি বলছিলেন আর ভেঙ্গে পড়ছিলেন কান্নায়।
হাসিনাও কেমন অবুঝ-অনুভূতিহীন। তার কেবলি মনে হচ্ছে এই বুঝি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবেন তিনি। বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও আর বুঝি বাবার সঙ্গে দেখা হবে না। পিঠের ভাই কামালের সঙ্গে দেখা হবে কি!
একাত্তরের পুরোটা বছর ঠিক এমনটাই গাঢ় বিষণ্ণ কষ্ট হয়েছিল। কামাল-জামাল দুই ভাইয়ের সঙ্গে এক জীবনে আর দেখা হয় কিনা – দুশ্চিন্তায় কেটেছে কত শোকার্ত মুহূর্ত। ওরা মুক্তিযুদ্ধ থেকে কবে বিজয়ী হয়ে ফিরবে – সে কি ব্যাকুল অপেক্ষা। আম্মা কত কেঁদেছেন। চোখ মুছেছেন সন্তানদের মুখটি দেখার জন্য। রণাঙ্গনে ওরা কেমন আছে – নানা রকম খবর আসত। ধানমণ্ডির বন্দিশিবির থেকে জামাল উধাও হয়ে পৌঁছেছিল লড়াইয়ের মাঠে। কাউকে না বলেই হঠাৎ একদিন নেই। আম্মা কি যে উৎকণ্ঠা। জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি। জ্ঞান ফিরতেই খোদার কাছে আকুল হয়ে দোয়া করছিলেন। ধুলোময় মেঝে পরিষ্কার করে নফল নামাজ পড়ছিলেন। কত রকম উড়ো খবর। কতরকম গুজব। কেউ বলছিল জামালকে গুম করে দিয়েছে আর্মিরা।
কামালকে নিয়ে উড়ো খবর ছড়ানো হয়েছিল কম নয়। রাজাকার আলবদররা সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল মুজিব পরিবারের হত্যা-কল্পনায়। ওরাই রটিয়েছিল – জামালের লাশ মিরপুর লাশখোলায়। কামালকেও কতবার পাকিস্তানি আর্মি হত্যা করেছে বলে ওরা রটিয়েছে – তার ইয়ত্তা নেই।
বন্দিশিবিরের পাহারায় যে ফৌজীরা ছিল, কড়া গন্ধের গরুর মাংসের ভুনা; কখনও ঝোল-কাবাব দিয়ে ওরা মোটা মোটা রুটি খেত। ওদের মধ্যে ছিল অহোরাত্র উল্লাস। আর সেই উল্লাসের মধ্যমণি কখনও কামালের মৃত্যু। কখনও বাবার ফাসির খবর। ওরা উল্লাসে নানা তিক্ত কথার বাণে অনেকবার মেরেছে বাবাকে।
উনিশে ডিসেম্বর মায়ের কাছে ফিরেছিল কামাল জামাল। অক্ষত। বিজয়ী মুক্তিসেনা। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরাসরি আসা। ওদের পরনে ছিল রণাঙ্গনের পোষাক। উস্কোখুস্কো চুল। কামালের বাজখাই গোঁফ। সেই মুক্তির গোঁফ কামাল পরে খুব একটা ছাঁটছাঁটাই করেনি। আম্মার চোখে সেদিন ছিল অপার্থিব আনন্দ অশ্রু। মায়ের অশ্রু। একাত্তরের আগুন দিনগুলোয় বাবা বেঁচে আছেন, এমন আশ্বাসও ছিল না। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুবরণের পূর্ব মুহূর্তে বাংলা ও বাঙ্গালির অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের বার্তা দিচ্ছেন পিন্ডির খুনীদের – এমন একটা শোকঘন এবং বীরব্যাঞ্জক দৃশ্য মনের পাতায় রেখাপাত করছিল বার বার।
বিজয়দীপ্ত বাহাত্তরের শুরুর দিনগুলোয় রাওয়ালপিন্ডি বা লয়ালপুর জেলে বাবা আদৌ বেঁচে আছেন কিনা কেউই নিশ্চিত ছিল না। সারা দুনিয়াও ছিল বিভ্রান্ত। কোনো পাকা খবর তখন মেলেনি। ইয়াহিয়া বাবাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে কিংবা কোন ষড়যন্ত্র করে মেরে ফেলেছে – এমন আশঙ্কাই ছিল প্রচন্ড। রাওয়ালপিন্ডি ও ভুট্টোর রহস্যময় নীরবতা সেই ভয়ঙ্কর আশংকাকেই প্রকট করে তুলছিল। জানুয়ারির শুরুতে এমনও দিন গেছে, হাসু রেহানা কামাল জামাল রাসেল-আম্মা; সবাই প্রত্যাশায় দিন গুনছিলেন – কাল সকালেই যেন খবর আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মরে নাই। তারপরও অজানা আশঙ্কায় পেয়ে বসছিল সবাইকে। বাঙ্গালির ঘরে ঘরেও সেকি ব্যাকুল প্রত্যাশা।
বনের অ্যাম্বাসেডর হাউস থেকে আর লন্ডন নয় – হাসিনার উদ্বিগ্ন চিত্ত উড়ে যেতে চাইছিল ঢাকাতে। কী হয়েছে বাড়িতে – নিজের চোখে দেখা বড় দরকার। যা শুনছে – যা ধারণা পাচ্ছে; তা অবিশ্বাস্য। কোনোক্রমেই এমনটা হতে পারে না। কেউ খোলাসা করে কিছু বলছেও না। ঠিক যেন সেই শেষ একাত্তর। ঠিক যেন সেই উদ্বেগমুখর বাহাত্তর।
কত শঙ্কা; কত দুশ্চিন্তা। তারপরও কেউ আশা ছাড়েনি। এবারও নিশ্চয়ই তেমনটাই হবে। কিছু হয়নি বাবার। স্বাধীন বাংলায়, লালসবুজ সোনার বাংলায় তার ক্ষতি কেমন করে হয়।
ষোলই ডিসেম্বর বিশ্বের পূর্ব দিগন্তে নতুন সূর্য উঠেছিল বাংলার; পূর্ব দিগন্তে আকাশের মেঘের মিনারে ভেসে উঠেছিল শেখ মুজিবের গগনচুম্বি অবয়ব। তার পেছনে লাল সবুজ সোনালী মানচিত্রের অমর পতাকা বিশ্ব-বাতায়নে উড্ডীন। দুনিয়া কাঁপানো দিনেও ইয়াহিয়া মুজিব কতলের শেষ চেষ্টা করতে ছাড়েনি। ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা দিয়েও বাংলার প্রাণভোমরা হত্যার গজালবুদ্ধি তার মাথা থেকে যায়নি। পরাজয়ে সে হয়ে উঠেছিল আরও বিভৎস। আরও ভয়ঙ্কর। আরও প্রতিশোধ পিপাসু।
একটা জাতির উত্থানের শোধ নিতে চেয়েছিল চিরতরে মুজিবকে বধ করে। ভুট্টোশাহীর কাছে ক্ষমতা যখন তুলে দিচ্ছিল ইয়াহিয়া – তখনও পরাজিত জেনারেলের খেদ ও দরখাস্ত মুজিবকে ফাঁসিতে লটকাতে হবে। ব্রাশফায়ার করে ঝাঁঝরা করে দিতে হবে। মুজিবকে ঝাঁঝরা করে দিলে ঝাঁঝরা হবে বাঙ্গালি। ঝাঁঝরা হবে বাংলাদেশের হৃদয়।
তখন কেমন করে সেটা সম্ভব। দুনিয়ার হৃদয়ে তখন বাংলাদেশ জন্মের অভূতপূর্ব বিস্ময়। দুনিয়ার হৃদয়ে শেখ মুজিব এক রক্তাক্ষর ভালবাসা। সেই ভালবাসাকে কেমন করে ভুট্টো লটকাবে। কেমন করে ফৌজীশাহীর খেদ সে মেটাবে। উভয় সঙ্কটে লারকানার শৃগাল-বুদ্ধি মানুষটা।
গোবরবুদ্ধি ইয়াহিয়া তাকে বোঝাল – যেন তেন ভাবে দিয়ে দিলেই তো হয়। গোপনে ফাঁসিতে লটকে তারপর পেছনের তারিখে ইয়াহিয়ার জমানায় মোকদ্দমা রুজু করলেই হয়। কেউ আর ভুট্টোকে দুষবে না। কেউ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেও কোনো সুবিধা করতে পারবে না। মরা লাশ কখনওই কথা বলে না।
ইয়াহিয়া গোবর-বুদ্ধি। ভুট্টো নির্বোধ নয়। তখন ছিয়ানব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈনিক ঢাকায় যুদ্ধবন্দি যৌথ মিত্র বাহিনীর কব্জায়। মুক্তিযোদ্ধা দাবড়ে বেড়াচ্ছে ঢাকাতে। বিজয় পতাকা প্রতিটি বাঙ্গালি প্রাণে পত পত করে উড়ছে। এই অবস্থায় শেখ মুজিবের মৃত্যু সংবাদ ঢাকায় পৌঁছালে একটা আর্মিও জিন্দা ফেরত আসবে না। মুক্তিবাহিনী খুনের দরিয়া বইয়ে দেবে ঢাকায়। মাতাল জেনারেল একলাখ সৈনিকের প্রাণ নিয়ে ফিকির না করলেও পাবলিকশাহীর জেনারেল ভুট্টো তা আমলে না নিয়ে পারে না। বরং এই মুহূর্তে ঢাকায় এই খবরটাই যাওয়া দরকার – শেখ মুজিব মরে নাই।
রাখে আল্লাহ মারে কে! ইয়াহিয়ার কতল-চিন্তার শত ঝুঁকির পরও খোদা তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
ইয়াহিয়ার সেবার কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। নির্বোধ একটা জেনারেল। বুদ্ধিশুদ্ধি সব বুটজুতোয় আর গন্ধ মোজায় ভর্তি করে সে কেবল দুর্বুদ্ধির ফিকির করে বেড়াচ্ছিল।
সারা বাংলা তখন আগুন। ইস্পাতের মতন প্রত্যয়ে মুক্তিবাহিনী প্রতিটি জনপদে মুক্তির পতাকা তুলে দিয়েছে। নিশানে হায়দার পাঞ্জাফৌজ পানিতে মরছে। জলেডাঙ্গায় খাবি খাচ্ছে। একটার পর একটা জেলা মুক্তাঞ্চল হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। টিক্কা নিয়াজি জাঞ্জুয়ার গলায় ফাঁস আটসাট হয়ে পড়ছে – মাতাল পাঞ্জাবির তখন প্রবল খায়েশ – ভারত বিজয় করবে। সুলতান মামুদ হবে। বখতিয়ার খিলজি হবে। লাইব্রেরী পোড়াবে। সোমনাথ মন্দির আগুনে পোড়াবে। লুট করবে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে দিল্লির লালকেল্লায় লুটের উৎসব করবে। বড়ই মশকরার মতলব ছিল। অচিরেই তা তামাশা-মশকরায় পরিণত হতে সময় নিল না।
পূর্ব পশ্চিম দুই ফ্রন্টেই অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে ইয়াহিয়া আত্মাহুতি দিতে বসল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বড় বিচিত্র। বড় ক্যারিকেচার। জিন্নাহ অনেক কষ্টে কীটদষ্ট একখণ্ড ভূখণ্ড লুটমার করে এনে সাধের নামজারী করেছিল। পাকিস্তান। আইয়ুব ইয়াহিয়া ফৌজী-কিসিঞ্জারি করে সেটাকে ফোকলা বানাতে কোন কসুর করেনি। ইয়াহিয়ার অগ্নি-আস্ফালন বাস্তবের এক ফুৎকারেই নিভে গিয়েছিল। ডিসেম্বরের গোড়াতেই বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর মুক্তাঞ্চল। পূর্ব পশ্চিম দুই সীমান্তে তামাশার দামামা বাজিয়ে ইয়াহিয়া ও তার হায়দারি ফৌজ রীতিমত প্রহসন। ষোল ডিসেম্বর পাকিস্তান নামক দাজ্জালাস্থানের হৃদপিণ্ডে শেষ গজালটি ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল।
সারা বাংলাদেশ মুক্ত। বাঙ্গালি মুক্ত। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে পরম কাঙ্খিত মুক্তি করায়ত্ত। মুক্তি হাতের মুঠোয়। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। স্বাধীনতার পরম অর্জন লাখো পায়রার ডানায় ছড়িয়ে গেল ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে। এই পরম প্রাপ্তিও অপূর্ন রয়ে গেল ।শেখ মুজিব বাংলাদেশের হৃদয়। মুজিব বাংলাদেশের প্রানভোমরা। বাবাকে ছাড়া কেমন করে নি:শ্বাস নেবে বাংলাদেশ। দশ জানুয়ারি আকাঙ্খা সত্য হল। বাংলাদেশ জেনে গেছে পিতা মরে নাই। মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব তেজগাও বিমানবন্দরে ফিরছেন তার প্রানপ্রিয় স্বদেশে। স্বপ্নের আরাধ্য স্বাধীন দেশে। জন্ম ভুমি স্বর্গাদপি গরিয়সী। জন্মভূমি জান্নাতের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। বিমান বন্দরে রেসকোর্স ময়দানের সেই মানবসমুদ্র।
বঙ্গবন্ধুকে প্রাণঢালা সংবর্ধণা জানানোর জন্য ভোর থেকে মানুষ অপেক্ষায়। বাবা ফিরলেন। কবরের গহবর থেকে আবার সবুজ শ্যামল বাংলায় অবগাহন। প্রচন্ড আবেগ আপ্লুত তিনি। মানুষকে দেখছেন। গাছপালা দেখছেন। পাখি ও প্রকৃতি দেখছেন। আলোয় ভরা ভূবনে চোখ মেললেন। হাওয়ায় নিঃশ্বাস নিচ্ছেন প্রাণভরে।বাবা কান্না সম্বরণ করতে পারলেন না। বার বার চশমা মুছছিলেন। লাখ লাখ বাঙ্গালি সেই বিমানবন্দর থেকে বাবার সঙ্গে। শেখ মুজিববাহী শকট-বহরের সঙ্গে লাখো মানুষের বহর পিছন পিছন যাচ্ছে। তারা কোনভাবেই নজরছাড়া করবে না বঙ্গবন্ধুকে। বাবা ধানমন্ডির অস্থায়ী বাসায় গেলেন। মানুষ আছে সঙ্গে। এ যেন এক ইন্দ্রজাল। এমন ইন্দ্রজাল কেমন করেই বা সম্ভব। তার কথা না শুনে কেউ আজ আর ঘরে ফিরে যাবে না। বিকেলেই বাবা রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে।
ভাইয়েরা ও বোনেরা আমার, আমি প্রথমে স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, সৈনিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, সেপাই, পুলিশ, জনগণকে। হিন্দু-মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করে এবং তাদের উপর পুষ্প নিবেদন করে আমি আপনাদের সাথে দুটো কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের স্বাদ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। অনলবর্ষী বাবা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছেন।
আমি আজ বক্তৃতা করতে পারবো না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে, আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম। ফাঁসী কাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু আমি জানতাম, আমার বাঙ্গালীকে কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না। প্রায় তিরিশ লক্ষ লোককে মেরে হয়েছে বাংলায়, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও, এবং প্রথম মহাযুদ্ধেও এতো লোক, এতো সাধারণ নাগরিক মৃত্যুবরণ করে নাই, শহীদ হয় নাই, যা আমার এই সাত কোটির বাংলাদেশে হয়েছে। আমি জানতাম না, আপনাদের একজন হয়ে আমি ফিরে আসবো। আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও আমার আপত্তি নাই। মৃত্যুর পরে আমার লাশটা আমার বাঙ্গালীর কাছে দিয়ে দিয়ো, এই একটা অনুরোধ রইলো।
বাবা চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারছেন না। তার বাংলাদেশ অবশেষে স্বাধীন হয়েছে। বললেন, মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে, বাংলাদেশকে কেউ দাবাতে পারবে না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন সাত কোটি বাঙ্গালীরে, হে বঙ্গজননী রেখেছো বাঙ্গালী করে মানুষ করো নি। কবিগুরু কথা মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেছে, আমার বাঙ্গালী আজ মানুষ হয়েছে। আমি জানতাম না, আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছে। আমি প্রস্তুত হয়েছিলাম। বলেছিলাম- আমি বাঙ্গালী ! আমি মানুষ ! আমি মুসলমান ! একবার মরে, দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম- আমার মৃত্যু এসে থাকে যদি, আমি হাসতে হাসতে যাবো, আমার বাঙ্গালি জাতকে অপমান করে যাবো না। তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইবো না। এবং যাওয়ায় সময় বলে যাবো, জয় বাংলা। স্বাধীন বাংলা। বাঙ্গালী আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।
সেদিন রেসকোর্সে মুজিবের কন্ঠে ছিল শোক কষ্ট বেদনার অন্তহীন ফল্গুধারা। তিনি খেই হারিয়েও ফেলছিলেন। শেখ মুজিবের এক একটি উচ্চারণ; আর লাখোকোটি প্রানের হর্ষধ্বনি। তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ। তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা। ঢাকা প্রকম্পিত হচ্ছিল শ্লোগানে শ্লোগানে। মিছিলে মিছিলে। অবিনাশী সেইসব ছবি। চলচ্ছবির মত হাসুর চোখের সামনেই যেন ভাসছে। এই তো সেদিনের ছবি। এখনও কী জীবন্ত। সেই বাবার কিছু হয়েছে কেমন করে বিশ্বাস করবে হাসিনা। এমন পাষাণ হৃদয় তো তার নয়। ইয়াহিয়া-টিক্কার চেয়েও ভয়ঙ্কর জল্লাদকে সে! কারা তারা! ইয়াহিয়া খান , টিক্কা খান , নিয়াজী , জাঞ্জুয়া ওরা কি আবার দখল করে নিয়েছে ঢাকা।
এবার কি তারা মহাশ্মশান বানিয়েই তবে ছাড়বে। গোলাম আযম কি আবার ফিরে এসেছে ঢাকাতে! আলবদর আলশামস, রাজাকার রাতের প্রবল অন্ধকারে ওরা কি আবার হেনেছে হায়েনার হানা! আবার ডালকুত্তার দল খুনপিয়াসি জিহবা ঝুলিয়ে দৌড়ে দাবড়ে বেড়াচ্ছে ঢাকার রাজপথ। আবারও কি অপারেশন সার্চলাইট! কালরাতে ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর ছত্রখান। বাহাত্তর সালেও মুক্ত বাংলাদেশেও বত্রিশ নম্বরের বাড়ি বাস করার মতন ছিল না। জানুয়ারির শুরুতে হাসুরা যখন প্রথম গিয়েছিল কী নৃশংস তান্ডবের ক্ষতচিহ্ন। পাক-জল্লাদরা বাড়িটাকে পরিত্যক্ত কবরস্থান বানিয়ে ফেলেছিল।
সেখানে কোনদিন মনুষ্যবাস ছিল তার সবচিহ্ন মিটিয়ে ফেলেছিল। কেবল ধ্বংসস্তুপের দীর্ঘনি:শ্বাস। আসলে পাকিস্তানিরা তো মানুষ নয়। কতগুলো ঠগ,দস্যু উম্মাদ অমানুষ আর অসভ্য জানোয়ার। বাড়িটা যেন আগুনে পোড়ানো পোড়া বাড়ি। সেইসব দগ্ধস্মৃতি হাসু কেমন করে ভুলবে। সেদিনের দু:সহ স্মৃতি বাবার কাছেও সে শুনেছিল। হানাদার দস্যুগুলো প্রথমে বাড়ির ওপর মেশিনগানের গুলি চালায়। ইটকাঠ গাছ পাথর ফুললতা পাাখির বিরুদ্ধে জন্তুগুলোর কী প্রবল বিদ্বেষ। বাবা তখন শোবার ঘরে বসেছিলেন। সেদিক থেকেই মেশিগানের গুলির বহর। ঠা ঠা শব্দ থামবারই নয়। তারপর এদিক সেদিক। বাড়ির জানালা লক্ষ্য করে গুলি। গুলির খোসা ছিটকে ঢুকে পড়ছিল বাড়িতে। শোবার ঘরে। রাসেল ছিল বিছানায় ঘুমিয়ে। উদ্বিগ্ন আম্মা বসেছিলেন। জামাল ছিল সঙ্গে। ভয় পান নি আব্বা। বেরিয়ে এলেন তিনি বাইরে।
জল্লাদদের তিনি বললেন তোমরা গুলি করছ কেন! কি তোমরা চাও! গুলি বন্ধ করো। আমি তো এখানেই দাঁড়িয়েই আছি। তখন ওরা হিস হিস কওে চারদিক দিয়ে বেয়োনেট উচিয়ে ছুটে এলো। এই বুঝি তারা বেয়োনেট ঢুকিয়ে দেয় বাবার বুক বিদীর্ন করে। একটা কমান্ডার উদ্যত খুনীকে থামাল। বলল এই ওকে মেরো না। ওকে জিন্দা পাওয়া গেছে। এখনই মুর্দা বানিও না। তখন ওরা টেনে নামাল বাবাকে। উদ্ধত দস্যুগুলোর বেপরোয়া হিংসা কমে নি। বাবার গায়ে পেছন থেকে পাশ থেকে আক্রমন করে যাচ্ছিল। গায়ে পায়ে বন্দুকের কুদোঁ দিয়ে মেরেই চলছিল।
আবার কি ঢাকায় সেই জানোয়ারগুলো ফিরে এসেছে।পাকিস্তানি কোন গর্ভ-গুহা থেকে; কোত্থেকেই বা ওরা আবার ফিরে এলো। তারা কি ঘাপটি মেরে লুকিয়েছিল ঢাকাতেই। মুখোশ পরেছিল। কেউ তাদের চিনতে পারে নি। কেমন করেই বা তা সম্ভব! সত্যিই কি বাংলাদেশ আবার রক্তাক্ত। সত্যিই স্বদেশ আবার একাত্তরের রক্তাক্ত বাংলা। জানোয়ারগুলো বড়ই জাহাবাজ। দজ্জাল ধড়িবাজ। একটা বিষ-কেউটে কেউকেটা জাদরেল টু স্টার হয়ে লুকিয়েছিল মুজিবের পায়ের তলায়।তার হৃদয়ে কেবলই জিয়ো পাকিস্তান। তার অন্তরাত্মা জুড়ে কেবলই জিন্দাবাদ পায়েন্দাবাদ। জিয়ো পাকিস্তান শুনলে তার কি যে আনন্দ।
লোকটার দুচোখে সবসময় সানগ্লাস। কেউ যেন তার শৃগাল-চক্ষু দেখতে না পায়। স্বাধীন বাংলাদেশে শেষ ছোবলটা মারতে সে মুক্তিযোদ্ধা সাজতেও দ্বিধা করে নি। কোনদিন সম্মুখ সমরে যায় নি। রনক্ষেত্রে যায় নি। কিন্তু যুদ্ধের লাগাম ধরে বেশ ধড়িবাজি-বাহাদুরি দেখিয়েছে। মুজিবের কাছে থেকে বাগিয়ে নিয়েছে বীরোত্তম খেতাব। বাহাত্তর থেকেই সে তার মিশন নিশান-ই-পাকিস্তান কায়েমের লক্ষ্যে ছিল তৎপর। মুজিব মানেই অমর পুস্তিকার খোলা পাতা। তার বঙ্গভবনের বাতায়ন খোলা। গনভবনে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম থেকে খোলা পায়েই ঢোকা যায় অনায়াসে। গনভবনের দরোজা কখনও বন্ধ হয় নি কারো জন্য। টুস্টার জেনারেল ঘুর ঘুর করেছে সেখানে। ঢু মারতো সে কারণে অকারণে।
মুজিবের এসিস্ট্যান্টদের সঙ্গে বাতচিত করেছে। এসিস্ট্যান্টদের মধ্যে একজনের বাড়ি বগুড়ায়। আঞ্চলিকতার জের টেনেছে তার সঙ্গে। সখ্য করেছে। জানতে চেয়েছে কেমন করে সরকার চলছে। বঙ্গবন্ধু কি করছেন। কখন আসেন। কখন বাড়িতে ফেরেন। সরকারের ভেতরের খবর কি! মন্ত্রী মিনিস্টাররা কে কি করছে! কার কি মনোভাব! কেমন বুঝছেন ভায়া। নানা খুটিনাটি। সানগ্লাসের আড়ালে তার গোয়েন্দাবৃত্তি আর কুটকচালি দিব্যি চলছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে তার কায়কারবার জমজমাটি করেই চলছিল। বীরোত্তম বলে কথা।
গনভবনের এসিস্ট্যান্টরা কেউ ঘুনাক্ষরেও সন্দেহ করে নি। সদ্য মুক্ত বাংলাদেশ। আকাশ খোলা। দখিনা দুয়ার খোলা। তখন সন্দেহ করার দিন নয়। সানগ্লাসের বড্ড খেদ। সে সেনা সদর হতে পারে নি। হতে পারলে কত সহজ হত কাজকাম। ডেপুটি সদর হয়েও কাজ চালিয়ে নিচ্ছে দিব্যি। চিফ সাহেব বড্ড দিলদরিয়া স্বভাবের। হাসি খুশি সুদর্শন। তার সব কিছুতেই আনন্দ। কেউ তার হুকুম তামিল করলেও আনন্দ। না করলেও আনন্দ। সানগ্লাস ঠিক এই মওকাটাই কাজে লাগিয়েছে। বাহাত্তর তেহাত্তর চুয়াত্তর পচাত্তর দেখতে দেখতে সময়টা পার হয়েছে। মাত্র কয়েকটা বছর । শেখ মুজিব উদার হাতে প্রমোশনগুলো বিলিয়েছেন। স্টারগুলো বেশ দৌড়ে ছুটেই সানগ্লাস বাগিয়ে নিয়েছে। শেখ সাহেবেরও ভালবাসার শেষ নেই। এই ছেলে পিলেদের নিয়েই সংসার। এদেরকে দিয়েই সাজাতে গুছাতে হবে সোনার বাংলা। এরাই বড় হবে। জাদরেল হয়ে দেশ রক্ষা করবে। এদেরকে যদি তিনি বড় না করেন দায়িত্ব নেয়ার লোক কই।
কিন্তু ফুলের বাগানে কালকেউটে ঢুকে পড়েছিল। ফুলের পাপড়ির মধ্যে বিষ ঢালছিল সঙ্গোপনে। গাদ্দার কখনওই দেশপ্রেমিক হয় না। সানগ্লাস , মেজর ফারুক রশীদ সব একাত্মা। হরিহর আত্মা। কিন্তু ওরা ঘুরছে ফিরছে নানা পরিচয়ে। সানগ্লাসের নজর ছিল দূরদর্শনে। মুজিবকে কোন অবস্থাতেই বাঁচতে দেয়া যাবে না। কামালকে তো নয়ই। জামালকেও নয়। বেচে থাকলে ক’দিন বাদে গজিয়ে উঠবেই। মুজিবের রক্তধারায় নবীন মুজিব হয়ে উঠবে। আর টেনশন ছিল তার ইন্ডিয়াকে নিয়ে। মুজিবকে বিনাশ করলে সবচেয়ে বেশী শোকার্ত হবে ইন্ডিয়া। কাঁদবে ইন্দির। সানগ্লাসের বড় ভয় যদি ইন্ডিয়া ঢুকে পড়ে চৌদ্দগ্রাম দিয়ে। মুজিবকে হত্যা করেও ফায়দা তোলা যাবে না।
সে মনেপ্রানে চাইছিল তাদের মাস্টারপ্লানে সরকারের লোকরাও থাকুক। তাহলেই সোনায় সোহাগা। একাত্তর থেকেই নজরদারি করছিল। বাহাত্তরে গনভবণ বঙ্গভবনেও রেকি করেছে। দাউদকান্দির খোন্দকার ইজ দি পারফেক্ট পারসন। মুজিবনগর সরকারে থেকে দুর্দান্ত পিন্ডি-সার্ভিস দিয়েছে। কিসিঞ্জার লবি সানগ্লাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যুগপৎ রক্ষা করছিল। দারুন চাল চেলেছিল খন্দকার শেষ মুহুর্তে। তার সঙ্গে চাষী-ঠাকুর গং। কিসের মুক্তিযুদ্ধ। কিসের স্বাধীনতা। সব বানচাল করার মাস্টার-ব্লাফিং হচ্ছিল। ব্লাফ-মাস্টার ওই ছুপারুস্তম চাষী। স্বাধীনতার লাল সূর্য আর দিগন্তে উঠত না। পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন ইস্ট পাকিস্তানকে বলির বন্দোবস্ত হয়েছিল। তাজউদ্দীন শেষ মুহুর্তে টের পেল। নইলে কেল্লা ফতে হত তখনই। মুজিবকেও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় ফাসিতে লটকানো যেত সহজেই।
আজ আর নতুন করে হত্যার আয়োজন করতে হত না।মাশাল্লা একটা চয়েজ হচ্ছে এই খন্দকার। দ্য পারসন মোস্ট পারফেক্ট। এই গোপন মিশন একটা যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। কত ফ্রন্টে ভাগ হয়ে চোরাচুপটি কাজ চালিয়ে যেতে হয়। যুদ্ধের শত্রু থাকে সামনে। আর এই মিশনে ছায়া ছাড়া আপন কেউ নয়। অনেক সময় ছায়াও শত্রুকে দিতে পারে ইশারা।
সানগ্লাসের সঙ্গে যে ফারুক রশীদ লম্বা বৈঠক হল তার খবর কেমন করে দিল্লিহিল্লি পৌছাল। কাও কেমন করে জানল। মিটিং-এর পেপার ওয়ার্ক পর্যন্ত কাওদের হাতে পৌছে গেল। কী বেমক্কা ঘটনা। মুজিবকে জানান হল। ভাগ্যিস! লোকটা তা বিশ্বাস করে নি। উল্টো দুর দুর করে তাড়িয়েছে কাওটাকে। কাউডাং-এ মুখ বর্নিল করে সে ফিরেছিল। সবখবরই যথাসময়ে সানগ্লাসের কাছে আসছিল। ইন্ডিয়া ঘট উল্টে দিতে পারে। সানগ্লাস ঠিক করেই রাখলো মুজিব মরলেই খন্দকারকে ভজিয়ে সদর প্রমোশনটা বাগিয়ে নিতে হবে সঙ্গে সঙ্গে। শফিউল্লাহকে কোন অবস্থাতেই ঢাকায় রাখা যাবে না। ওকে পাঠানো হবে বর্ডারে। ইন্ডিয়ান আর্মির সঙ্গে বসে পাকিস্তান আর্মিকে সারেন্ডার করিয়েছে। এবার ইন্ডিয়ান আর্মি ঠেকাতে সে গিয়ে বর্ডারে বসে থাকবে। এটাই হবে নয়া ফৌজী সদরের প্রথম অফিস অর্ডার। জিয়ো পাকিস্তানী ক্ষণ গুনছে অপেক্ষায়। মুজিব খতমের খবর কখন আসবে। তার টুস্টার পরানো ফৌজী পোষাক কড়কড়ে কওে ইস্তিরি করে রাখা হয়েছে। কড়া অর্ডার দিয়েছিল আর্দালীকে। ধোয়া ফকফকা হওয়া চাই। খতমের খবর এলেই প্রথমে ক্লিনশেভড হবে জিয়ো পাকিস্তানি। তারপর কেতাদুরস্ত হয়ে অফিসিয়াল জীপে চড়ে ধীর-স্থির চিত্তে যাবে ফৌজী সদরে। কোন তাড়াহুড়া করবে না।
শাহীন শিবিরেও চলছিল নিঝুম প্রস্তুতি। গুটি কয়েক শাহীন ফৌজ তারা পথভুলে পিন্ডি ফেরত যেতে পারে নি। তোয়াব খুব ঈমানে পাকিস্তান। তারা সাঙ্গপাঙ্গরা তাবলীগ জামাত ধরল। খুব আল্লাহ বিল্লাহ করছে। জিকির আজকার করছে। তাদের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ধর্মভক্তি। জিকির করতে করতে যখন তাদের ফানাবিল্লাহ অবস্থা। তাদের মধ্যে তখন নতুন জজবা। তারা কেউ কেউ গিয়ে রমনা পার্কের মধ্যে জিকির করছে। কাকরাইল মসজিদের পেছনে বেশ খানিকটা ভেতরে ঢুকে বসছে তাদের কর্মপরিকল্পনাসভা। জিকির চলছে। তার ফাঁকেই দুনিয়াবি বাতচিত। মুজিব খতম হলে ইন্ডিয়া আসতে পারে। এয়ার ফোর্স আসতে পারে আবারও। কেমন করে তারা আকাশ রক্ষা করবে তার সওয়াবি কথাবার্তা। কখনও সেখানে আওয়াজ উঠছে তোয়াব ভাই তোয়াব ভাই/ চানতারা পতাকা চাই।
নানা খেলাই চলছিল। কখনও জঙ্গলে , কখনও পার্কে শলাপরামর্শর শেষ নেই। রেজিমেন্টের লাইন থেকে উঠিয়ে আনা হয়েছে দোসরদেরকে।রাতের পার্কে বসে নির্জনে জোসনার আলোয় সাজানো হচ্ছে কিলিং-গেম প্লান। একটা গ্রুপ গিয়ে ঘুম থেকে জাগাবে মুজিবকে। ক্যান্টনমেন্টে নেয়ার কথা বলে বের করে আনা হবে বাড়ি থেকে। ঠিক সেই টিক্কা-চাক্কার গেম-প্লান। শেখ সাহেব কেন যেতে চাইবেন ক্যান্টনমেন্ট। তিনি বলবেন কেন যাব! আমি পাকিস্তানি হানেয়াদের বন্দি শিবিরে থাকি না। এটা কি পাকিস্তান। না। আমার বাংলা স্বাধীন হয়েছে। এখানে আবার পাকিস্তানিরা কেমন করে আসল। তিনি হয়তো ফোন লাগাবেন এখানে সেখানে। তখন কি একশন!
জোরজবরদস্তি করা হবে তার সঙ্গে। সেবার তাকে বেয়োনেট কুদিয়ে নেয়া হয়েছিল। এবারও গাই গুই করলে একই ট্রিটমেন্ট দেয়া হবে।বেয়োনেটের খোচাখুচির ওপর কোন ওষুধ নাই। অফিসার দিয়ে বেয়োনেট কুদানোর কাজটা ভাল হয় না। এজন্য চাই ননকমিশন্ড। সেপাই কিংবা হাবিলদার। ওরা অর্ডারলি। অর্ডার পেলে মেশিনগানের মত তুরন্ত কাজ করে।
কিন্তু ইয়াহিয়া টিক্কা খাদিম রাজা সেবার মস্ত ভুল করেছিল। মুজিবকে ধরেই তলোয়ারের কতল-কোপ তারা দেয় নি। ইয়াহিয়া সারা জীবন সেজন্য পস্তিয়ে মরেছে। তার মৃত্যুর দীর্ঘশ্বাসও হবে শেখ মুজিব। এবার এই ভুল করা যাবে না। মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব হবে আরও ভয়ঙ্কর। প্রথম টিমটা তাদের মত কাজ করুক। মুজিবকে ওরা টেনে নামাতে না পারুক; অন্তত শোবার ঘর থেকে বের করতে পারলেই হল। দ্বিতীয় গ্রুপটা গিয়ে ফিনিশিংটা দিয়ে আসবে। দ্বিতীয় টিমটা গিয়ে কোন আধ্যাত্মিক সঙ্গীত গাইবে না। নো ডায়ালগ। তারা যাবে আর সামনে মুজিবকে পেলেই ডাইরেক্ট একশন। নো মার্সি।
ফারুক নানারকম মুখোশ পরে ঘুরছিল। সেও মওকা মুক্তিযোদ্ধা। কোথাও যুদ্ধ করে নি। কিন্তু শেষ মুহুর্তে বাগিয়ে নিয়েছে তকমা। ওসমানীর ক্যারিশমার শেষ নেই। তিনি অকাতরে বিলিয়েছেন সনদ। নানা ফ্রন্টেই খতমের গেম-প্লানিং-এর কাজ চলছিল। তারা খন্ড খন্ড কাজ করছিল। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের কর্মতৎপরতা জানত না। ফারুক রশীদ সবার মধ্যে সুতোর কাজটা চালিয়ে যাচ্ছিল। রমনা পার্ক ওদের জন্য সুন্দরবনের গহীন অরন্য হয়ে উঠল।
রশীদ একদিন রেজিমেন্ট লাইনে মহিউদ্দিনকে পেয়ে তার প্রাইভেট গাড়িতে ওঠাল। হোটেল ইন্টারকনের পেছনে সেই ঘন বনানী। ঢাকার প্রানকেন্দ্রের পার্ককেই বেছে নিল ওরা। জায়গাটা শলাপরামর্শেও জন্য আদর্শ। কারও মাথাতেই আসবে না ভয়ংকর কোন ষড়যন্ত্রের জাল বিছাচ্ছে ওরা আপাত নির্জন এই পার্কে বসেই। এখানে আরও কয়েকবার প্লান চকআউট করেছে। টের পায় নি কেউ। আজ রাতে হবে ক্রস-একজামিন। ডালিম ও নূরও আসে। চারজন গিয়ে ঝোপের আড়ালে বসে। এদিনও কথাবার্তা চলে অনেক রাত অব্দি। কার কোথায় পজিশন হবে সেসব আলোচনা পর্যালোচনা করে ওরা।
শেখ মুজিবের বাড়িতে কে রেকি করবে সেটাও ঠিক করা হয়। শাহরিয়ারের জজবা একটু বেশী বেশী। সে বললো ক্যুটা একরকম হয়ে গেলে ইসলামি জোশকে লাগাতে হবে। বলতে হবে এটা প্রোইসলামি ফোর্সের ক্যু। আর্মিতে যারা খুব নামাজি ও রোজাদার। তারাই মুসলিম তমুদ্দুন রক্ষায় কাজটা করেছে। তাহলে প্রোইসলামি পিপল ও ফোর্সগুলোর সমর্থন সহজেই পাওয়া যাবে। জামাতে এসলামী তো এক পা খাড়া করেই আছে। মুজিবের কিছু একটা হলেই গোলাম আজম পিন্ডি লন্ডন বসেই সোল্লাসে কাপড় মাথায় তুলে নাচবে।
তেরই আগস্ট। রাত সাড়ে দশটা। ডালিম নূর শাহরিয়ার রশিদের সেনাপল্লীর বাড়িতে উপস্থিত।শাহরিয়ারকে তারা রশিদের বাসায় নিয়ে যায়। রশিদ উৎফুল্ল। আবার উত্তেজনায় অস্থির। শাহরিয়ারকে বলল ডোন্ট ওরি, ফারুকও আমাদের সঙ্গে । বেশ কয়েকমাস ধরেই শাহরিয়ার জবর মুখোশ পরেছিল। পুরানা ফ্রিজ এসির দোকান খুলেছিল। দিনের বেলা বেশ কয়েকটা কর্মী সারাইয়ের কাজ করে। আর রাতে বসে মজলিশে শুরা। চৌদ্দ আগস্ট বিকেল। ঢাকায় তখনও গাড়ি ঘোড়া হাতে গোনা। জ্যাম নেই। গাড়ি থাকলে কথাই নেই। এখান থেকে সেখানে কয়েক মিনিটেই যাওয়া যায়। রশিদ ও নূর একটি কারে ছুটে চলেছে।
ফ্রিজবিপনী থেকে শাহরিয়ারও জুটল। তাকে সঙ্গে নিয়ে খন্দকারের আগামসির বাড়িতে । অনেকক্ষণ কথা হয়। শেরাটনের কাছে নূর ও শাহরিয়ার গাড়ি থেকে নামল; সেরনিয়াবাত আর শেখ মনির বাড়িটা ফাইনাল রেকি করা দরকার। ডালিম গেল বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বর বাড়িতে। ফাইনাল চেকটা দরকার। আগের দিন অবশ্য ফারুকও গিয়েছিল। বাদামঅলা সেজেছিল। চাই বাদাম, চাই বাদাম বলে বেশ সরগরম করেছে। ডালিমও আশপাশটা ভাল করে ঘুরে দেখল। রাত দশটা। ডালিম, আজিজ পাশা, বজলুল হুদা এবং নূর চৌধুরী সেনাপল্লীর ভেতরে।
শাহরিয়ার রশিদের বাসায় মহড়া। সেখানে ডালিম জানায়, সে চিফ অব জেনারেল স্টাফের কাছ থেকে আসছে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য আর্মি তলব করা হয়েছে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আর্মি মুভ করবে। মুক্তিযোদ্ধা অফিসার হিসেবে চিফ তাদের সহযোগিতা চেয়েছে। জবর একটা মওকা পাওয়া গেল। এরপর সে মেজর রাশেদ চৌধুরীকে নিয়ে আসে। শাহরিয়ারের বাসায় খাওয়া-দাওয়া।
তারপর চুড়ান্ত চিত্রনাট্য যাচাইবাছাই দরকার। ডালিম বলল অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ডিউটিতে অংশ নিতে হবে অবশ্যই। এই ডিউটির ফাক গলিয়ে মিশন ইমপসিবলকে পসিবল করতে হবে। এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না। ওদেও মিলিটারি ফ্রেমওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে ক্যুপটা করা গেলে কেউ সন্দেহ করবে না। সাধারণ মানুষ ; এমনকি সৈনিকরাও ভাববে এটা আর্মি ক্যু। বিভ্রান্তিটা সবার মধ্যে ছড়িয়ে ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে হবে। মাছ একবার ডাঙ্গায় তুলতে পারলেই কেল্লাফতে। মুজিব নেই। না থাকবে বাঁশ। না বাজবে বাশরী। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ন সিদ্ধান্ত নেয়া হল।
রশিদের দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির টেকনিক্যাল হেডকোয়ার্টারে ইয়াজুজ মাজুজরা মিলবে।রাত দেড়টায় আবশ্যিক হাজিরা। এই আর্টিলারি কুর্মিটোলায় নিউ এয়ারপোর্ট এলাকায় নাইট ট্রেনিং করছিল। দুপুরেই রশিদ কমান্ডিং অফিসার হিসেবে তার অফিসে আরেকটা কাজ সেরে রেখেছে। অফিসারদের ডেকে রাতে নাইট ট্রেনিং হবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। অর্ডারশীট ফাইনাল।
(চলবে…)
অলংকরণ: শিল্পী শাহাবুদ্দিন