ভোররাতে একটু বুঝি বুঁজে এসেছিল চোখ। কিন্তু সকল ইন্দ্রিয় ঘুমিয়ে পড়েনি। সকাল তখন সাড়ে ছয়টা হবে। তিন তলার হাসুদের থাকার কক্ষের দরোজায় হঠাৎ শব্দ। কেউ ডাকছেন। দরোজা খুলতেই দেখে এ্যামবাসেডর পত্নী। কী ব্যাপার। এতো সকালে তিনতলার সিঁড়ি ভেঙে তিনি নিজেই এসেছেন ডাকতে। হাসু আবার অন্তরের অন্তঃস্থলে কোথাও বিষণ্ণ ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেলো। নিরন্তর বেজে চলেছে ঘণ্টা। বুক ধক করে উঠলো।
মিসেস হকের মুখটা মলিন; শাদা শাড়ির মতো বিষণ্ন।
হাসুর চোখের দিকে না তাকিয়ে তিনি জানালেন, বন সিটি থেকে হুমায়ুন সাহেব ফোন করেছেন।
ফোন! এই ভোরে! এবার হাসুর মনে হলো, নিঝুম নীরব বাড়িতে ভোরের ফোন বেলের আর্তধ্বনি মিহি হয়ে তার কানেও পৌঁছেছিল। ভোরের কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল তখনি।
![](https://i0.wp.com/www.channelionline.com/wp-content/uploads/2024/02/Channeliadds-Reneta-16-04-2024.gif?fit=300%2C250&ssl=1)
দোতলায় ফোনটা গিয়ে ধরলো। হ্যালো হ্যালো বলে নিজের অস্তিত্ব জানালো।
কিন্তু কী বিচিত্র! ওপাশে কোনো শব্দ নেই। কলটা কেটে গেল নাকি! একটু বাদে লাইনের মধ্যে হু হু বাতাসের শব্দ শুনতে পেল সে। তারপর গহীন কোনো গুহায় জলপতনের শব্দ।
হাসু হ্যালো হ্যালো বলছিল। হুমায়ুন সাহেব নীরব নিশ্চুপ।
আবারো হু হু বাতাস আর জলপতনের শব্দ।
আশ্চর্য! এসব কি হাসুর মনের বিভ্রম? তার কান; অন্য ইন্দ্রিয়ও কি বিভ্রমের শিকার হয়েছে?
মুহূর্তগুলো অনন্ত ধারায় বয়ে যাচ্ছিল।
একটা সময় তার মনে হল, ওই বিচ্ছিন্ন অনুভূতি বিভ্রাট বিভ্রম কোনোটাই নয়।
অজ্ঞাত কোনো কারণে হুমায়ুন সাহেব ফোনের ওপাশে নির্বাক। তিনি হাসুর সঙ্গে কথা বলতে ইতস্তত করছেন।
এবার তিনি ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন, ওয়াজেদ সাহেব কই!
ভগ্নকণ্ঠ। এই ভোরে ফোনে ভগ্নকণ্ঠ কেন! মর্নিং সিকনেস?
ইংরেজিতে তিনি বললেন, আমি কি ওয়াজেদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে পারি!
তার শব্দ উচ্চারণ মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। তার কণ্ঠ বিপদ মাখানো। তিনি যেন আতঙ্ক উদ্বেগে ডুবে আছেন। কী হয়েছে অ্যামবাসেডরের!
কোথাও কি কোনো গুরুতর কিছু ঘটেছে? কী ঘটতে পারে! আমাদের প্যারিস সফর প্রসঙ্গে কোনো বিপত্তি।
কিন্তু হুমায়ুন সাহেবের কণ্ঠের দুঃসংবাদবহ বিষণ্নতা হাসুর কান এড়িয়ে গেল না।
হাসু তাকে প্রশ্ন না করে পারে না। কী এমন মন্দ সংবাদ, যা তাকে বলতে চাইছেন না অ্যামবাসেডর।
ফোনের সেই মুহূর্তগুলো মহাকালের মহাগহ্বরে অনন্ত বিরতি দিয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গে নেমে যাচ্ছিল!
অজানা আশঙ্কায় হাসু আকুল হয়ে আবার জানতে চাইল। কী হয়েছে! তাকে বলা যাবে না কেনো!
অ্যামবাসাডর নিরুত্তর। আবার ভাঙা অনুরোধ-
আমি কি অনুগ্রহ করে ওয়াজেদ সাহেবকে পেতে পারি!
এবার কণ্ঠটা অশ্রু ভেজানো। তিনি কি কাঁদছেন!
কী হলো! কী হতে পারে এমন! হাসু তার গুরুগম্ভীর ভরাট আওয়াজে কান্নার অনুরণন শুনতে পাচ্ছিল কেনো!
ভীষণভাবে দুশ্চিন্তার মাঝে পড়লো। উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা, আবারও গ্রাস করল তাকে।
আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করেনি এতক্ষণ। উদ্বেগ আশঙ্কা মানুষকে বুঝি অন্ধ করে দেয় সাময়িক। সানাউল সাহেব, মিসেস হক কাছে পিঠেই ছিলেন। তাদেরও আচরণ অদ্ভুত, অস্বাভাবিক, অপ্রাকৃতিক, অবিশ্বাস্য লাগলো। দু’জনার মুখ অন্ধকার। তারা পাথরের মাঝে নিথর নিশ্চুপ। তাদের দেহে বুঝি প্রাণ নেই। সানাউল সাহেব দূরে এক ঠাঁয় দাঁড়িয়ে। মাথা নীচু। মাথা হেঁট। মিসেস হককে মনে হলো ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলবেন। এদেরই বা কী হল! কী হয়েছে বনে? ওয়াজেদ সাহেবের সঙ্গে অ্যামবাসেডরের কী এমন কথা! কী সেই গোপন কথা! যা বলতে তার কণ্ঠে অশ্রু সংবরণের আভাস! সেই গোপন কথা হাসুকেই বা বলতে তার কেনো এত সংকোচ!
হাসুর মাথাটা ভার ভার লাগছে।
তিনতলায় উঠে জয়ের আব্বুকে পাঠায় সে। বলে, কোনো গুরুতর সমস্যা হয়েছে। অ্যামবাসেডর তোমাকেই কেবল বলবেন।
হাতের আহত আঙুলগুলো সামলে দ্রুত ছুটে গেলেন তিনি।
হাসু বিছানার এক পাশে চুপটি করে বসলো। আকাশ পাতাল ভাবছিল! কী হতে পারে এমন! অদ্ভুত সব অনুভূতি হচ্ছে তারও। এতক্ষণ মাথাটাই ভার লাগছিল। এখন পুরো শরীরটাই ভারী হয়ে উঠছে। হাসু পাথর পাথর ভারী হয়ে পড়ছিল। আবার একটু বাদেই বিচিত্র বিপরীত অনুভব। ক্রমশ ওজনহীন হয়ে পড়ছে সে। তার কোনো ওজন নেই। অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে সে।
এমনটা হচ্ছে কেনো! ভয়ংকর কী ঘটলো, তার কিস্যুই জানা হল না তার। চারপাশের এই সুনসান নীরবতা। হঠাৎ নৈঃশব্দ – এর রহস্যও জানা নেই। হাসু ফ্যাল ফ্যাল করে চার দেয়ালকে দেখছিল। জানালায় আটকে গেল চোখ। জানালা ছাড়িয়ে দূরে সকাল বেলার প্রকৃতি। ওখানে এই ভোরবেলায় আকাশ অমন গাঢ় লাল কেনো? হাসুর চোখ ঝাপসা হয়ে পড়ছে রক্তাভ লালে। কিন্তু অমন তীব্র আবির কোত্থেকে এলো! হায় – জানালায় টিলার ওপর একগুচ্ছ বীচ ট্রি! কালও হলুদ, কমলা হালকা লাল পাতার সমারোহ দেখেছিল! আজ একটা রাত না পেরুতেই গাঢ় লাল!
অদ্ভুত! হাসু স্বপ্ন দেখছে না তো!
পাথুরে ভারী শরীর; দেহহীন আত্মার মতো উন্মুখ-ওজনহীন এই অনুভবের বা কী রহস্য! একবার মাধ্যাকর্ষণ যেন তাকে পৃথিবীর কেন্দ্রে তীব্র চুম্বকে টানছে। হাসু এই পাথুরে বাড়ি, পৃথিবীর মৃত্তিকার সঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আবার মাধ্যাকর্ষণহীন ছন্নছাড়া। কোনো অচিন লোকে ভেসে ভেসে হারিয়ে যেতে চলেছে! কোথাও যেন ডুবে যাচ্ছিল হাসু। কোথাও নিঃসীমে হারাতে চলেছে সে।
এই অনুভূতি, এই অনুভব কোন অনন্ত গ্রন্থির অপার অনিবার্য টানে! হাসুর শরীরে-ইন্দ্রিয়ে চোখের আলোয় ও নিঃশ্বাসে কিসের অদম্য অনুভব! কী তার রহস্য – কেউ জানে!
কিছুক্ষণ বাদে ওয়াজেদ সাহেব রুমে ফিরলেন।
তাকে দেখে সম্বিৎ ফিরে পেলো সে।
তার মুখটাও বিপর্যস্ত শুকনো। গত কয়েকটা মিনিট তিনি যেন কোনো তীব্র জলোচ্ছাসের মুখে ছিলেন। এতটা বিপর্যস্ত মুখ কখনো আর দেখেনি হাসু।
বাঁ হাতের পিষ্ট আঙুলগুলো সামান্য নাড়াতে গিয়ে তিনি আর্তি প্রকাশ করলেন। কিন্তু আর্তিতে শোনা গেল প্রচণ্ড কাতরতা।
এতটা ব্যথা কাতর মানুষ নন তিনি।
হাসুর মনের অজানা আশঙ্কা দূর পাহাড়ের ঘন নীরবতায় ঘণ্টা বাজাতে লাগল। পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিল নিরন্তর সেই শব্দ।
ওয়াজেদ সাহেবের কাতর মুখ দেখে তার চোখে কোত্থেকে পানি আসতে লাগল। একটু একটু জল। ফোঁটা ফোঁটা। আসছে তো আসছে।
আশ্চর্য! হাসু কাঁদছে কেনো! তার কান্নার কী হলো! এত জল চোখের ভেতর কোথায় লুকিয়ে আছে!
অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে জানতে চাইল – হুমায়ুন সাহেব কী বললেন! ঢাকার কোনো খবর?
জবাব দেন না তিনি।
বরং দেখা গেল, তার মুখ চোখ আরও গাঢ় বিষাদে ঢাকা পড়েছে। মেঘের কৃষ্ণ ছায়া।
হাসু প্রবলভাবে জানতে চাইল – কী ব্যাপার! জবাব দিচ্ছ না কেনো! কেউ কি অসুস্থ?
আব্বার কিছু হয়েছে? আম্মার কি শরীর খারাপ?
ওয়াজেদ সাহেব নিরুত্তর। বিষণ্ন মুখ।
হাসু আরও আকুল-ব্যাকুল হয়ে পড়ে। নিশ্চয়ই বড় অঘটন ঘটেছে। গুরুতর অসুস্থতার চেয়েও বড় কিছু একটা ঘটেছে হয়তো। হুমায়ুন সাহেব, সানাউল হক, মিসেস হক সেটা জানেন। তারা অল্প বিস্তর নিশ্চয়ই জানেন। সবাই তা লুকাচ্ছেন। ঘটনা যাই ঘটুক – এরা লুকোচ্ছেন কেনো! বললে হাসু সহ্য করতে পারবে না এমন কোনো দুঃসংবাদ!
কী সেটা! কী হতে পারে! ওয়াজেদ সাহেবও সেটা জেনে এলেন। তারও বা লুকোবার কী হল! এই গোপনীয়তা, এই নিরুত্তর কষ্টকণ্টকিত মুখ!
ওরা কি বুঝতে পারছেন না – এতে আরও বেশি উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ভাঙ্গন হাসুর মধ্যে। কিন্তু হাসু যে চোখের অশ্রু সামলাতে পারছে না।
ওয়াজেদ সাহেবের দৃষ্টিও ঝাপসা। তিনি খুব কষ্ট করে নিজেকে সামলাচ্ছেন। এক পর্যায়ে তিনি জানালেন, আমরা আজ আর প্যারিস যাচ্ছি না। হুমায়ুন সাহেব আজই বনে তার বাড়িতে ফিরে যেতে বলেছেন।
আর কিছুই বললেন না তিনি। দ্রুত বাথরুমে ঢুকে পড়লেন। তারপর অনেকক্ষণ বাথরুমে। বেরুচ্ছেন না।
ঘুম ভেঙেছে রেহানার। কিছু একটা আন্দাজ করতে পারছে সেও। অ্যামবাসেডর হাউজের পরিবেশ গুমোট; নিঃশ্বাস নেবার বাতাসটুকুও যেন বন্ধ। এটা নিশ্চয়ই রেহানা টের পেয়ে থাকবে।
ওকে দেখে হাসু অশ্রু সামলাতে চাইল। কিন্তু আপন বোনের মন। হাসুর মুখ দেখে ভীষণ উদ্বিগ্ন বোনটি।
কী হয়েছে আপু! তুমি কাঁদছো কেনো! দুলাভাই কোথায়!
হাসু বাথরুমের দিকে ইশারা করে দেখায়। রেহানার হতভম্ব মুখ। এর মধ্যে জয় ও ছোট্ট পুতলীর ঘুম ভাঙলো।
ওরাও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাচ্ছে।
রেহানার কথার কোনো জবাব দিতে পারে না হাসু। নিজের কান্নাকে আর সামলাতেও পারে না। বরং আরও কান্নায় ভেঙে পড়ে।
দেখে রেহানাও কাঁদছে। অবুঝ শিশু জয়েরও চোখে জল। দু’সন্তানকে বুকের কাছে টানল। ওদের স্পর্শে একটু উত্তাপ পেলো হাসু।
রেহানাকে প্যারিস যাত্রা বাতিলের কথা জানানো হলো। আস্তে করে বলল, বনে ফিরে যাচ্ছি আমরা।
হাসু কাঁদছিল। রেহানাও কাঁদছে। কান্না বড় সংক্রামক। প্রিয়জনের কান্না কাঁদায় অন্যদেরও। সেই কান্নায় জয়ের চোখের পানিও মিশছে। এই কান্নার কী রহস্য! কারও কিছুই জানা নেই। কোনো কারণের কথাই হাসু রেহানাকে বলতে পারল না; সে একদম নির্বাক।
প্রচণ্ড উদ্বেগাকুল রেহানাও।
ওয়াজেদ সাহেব বেরুতেই ওরা দু’বোন জানতে চাইল – কী হয়েছে সেটা বলতে হবে। নিশ্চয়ই কোনো বড় দুঃসংবাদ।
রেহানা বলল, যাই ঘটুক দুলাভাই, আমরা জানতে চাই।
ওয়াজেদ এবার ভয়ংকর কোনো প্রশ্নের মুখোমুখি। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি যেন কখনোই পড়েননি।
হাসুকে দেখছেন, রেহানাকে দেখছেন। জয়ের কান্না থামাতে গিয়ে বললেন, না না বাবা কাঁদে না।
আবার তিনি বাকরুদ্ধ।
হাসু বলল, আমার দিকে তাকিয়ে বলো – কী হয়েছে! রেহানাও ব্যাকুল বিহ্বল।
ওয়াজেদ সাহেবকে ওরা বলল – যা ঘটনা, না বললে ওরা এই বাসা ছেড়ে কোথাও যাবে না। এক পাও নড়বে না। বনে কারও বাসায় যাবে না।
কান্না ভেজা প্রশ্নের পর প্রশ্নের মুখে ওয়াজেদ বিপর্যস্ত। কী বলবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। হাসুরা নাছোড়বান্দা।
অবশেষে তিনি জানালেন, ঢাকায় মারাত্মক কোনো ঘটনা ঘটেছে।
-এ্যাকসিডেন্ট না অঘটন! মারাত্মক ঘটনা মানে কী! কী ঘটনা? কী হয়েছে?
ওয়াজেদের শ্যামলা মুখ শাদা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
তিনি মাথা নাড়েন।
বিস্তারিত কিছু তিনি জানেন না। কেমন করে আন্দাজে তিনি বলবেন।
কী জানো না?
কিস্যুই জানি না। অ্যামবাসেডর বিস্তারিত কিছু বলেননি। কেবল বললেন, সামথিং হ্যাজ হ্যাপেন্ড।
তবে যে বললে মারাত্মক ঘটনা!
ওয়াজেদ উদভ্রান্ত। তার মুখের সব রক্ত কেউ শুষে নিয়েছে!
বিড় বিড় করে বললেন, কই কিছু কি বলেছি আমি? ডিটেইল কিছু আমার জানা নেই। হুমায়ুন ভাই যা বললেন, তাতে আমরা সেইফ নই। প্যারিস যাওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না। তিনি আমাদের সেফটির কথা ভাবছেন বড় করে।
সেইফ নই মানে!
ওয়াজেদের হাত ধরে প্রবলভাবে জানতে চাইল হাসু। উদভ্রান্ত সে নিজেও। এতক্ষণ শঙ্কা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলো। কিন্তু এখন সেইফ-নিরাপত্তার কথা এলো কেন! আকাশ পাতাল যা ভাবছিল; তার চিন্তাশক্তি থেমে যাচ্ছে বার বার। প্যারিস যাত্রা তাদের জন্য সেইফ নয় কেন! বিচিত্র এই প্রশ্ন মাথায় ঠিক ঢুকছে না। উত্তর খুঁজবে, সেজন্যও তো ঢের ফুরসৎ চাই।
ওয়াজেদের হাত চেপে যতই জানতে চায় – তিনি ততই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ছেন। তিনি যেন ওই সব কথা কিছুই বলেননি।
এরই মাঝে রেহানা ডুকরে কেঁদে উঠে। হাসুও ওকে জড়িয়ে ধরে আকুল কাঁদতে থাকে।
তবে কি আব্বুর কিছু হয়েছে! তিনি কি প্রচন্ড অসুস্থ? কিন্তু মারাত্মক ঘটনার কথা ওরা কী বলছেন! যাই ঘটুক ওদের তো ঢাকা ফিরবার আয়োজনের কথা! কী এমন ভয়ংকর কারণে বনে ছুটবে ওরা!
আব্বা, আম্মা, কামাল, জামাল, রাসেল; ভাই-বৌদের দিব্যি সুস্থ দেখে এলো। বড়কন্যা হিসেবে অবশ্য অন্তরে অন্তরে টের পাচ্ছিলো – প্রচন্ড পরিশ্রম, রাত জাগায় বাবা ক্লান্ত। একটা সবুজ স্বাধীন ভূখন্ডের জন্ম হয়েছে বিশ্ব মানচিত্রে – হাজারো চ্যালেঞ্জ, হাজারো সমস্যা, শত্রুদের শত দুরভিসন্ধি; এইসব ধকল হাসিমুখে বয়ে ফিরছিলেন বাবা। কিন্তু ভেতরে নানাভাবে অন্তক্ষরণ, রক্তক্ষরণ ছিল। কেউ তা দেখতে না পেলেও হাসু মরমে মরমে অনুভব করছিল। স্বাধীন উৎফুল্ল বাঙালি জাতি আশায় ভালোবাসায় আকাশচুম্বী স্বপ্ন দেখছে। খুবই স্বাভাবিক। এই মুহূর্তে অনেক প্রত্যাশাই ছিল আকাশ কুসুম। বাবা কারও মনে সামান্য ক্ষোভ থাকতে দিতে চান না। তিনি চাইছেন সবাইকে খুশি রাখতে। কেউ বিরূপ কিছু বললে তিনি কষ্ট পান। তখনও তাকে বিচলিত হতে দেখে যায় নি। পরক্ষণেই হাসিমুখে বলেছেন, বাঙালির ভালবাসাই আমার শক্তি। ভালবাসার শক্তিতে সব হয়। ভালবাসা পেলে, ভালবাসা দিলে, সুখ-দুঃখ সব কিছু ভাগ করে নিলে সবই সম্ভব হবে মাগো। কেবল খানিকটা সময় দরকার। ধৈর্য ধরতে হবে কিছুদিন। এটা যেমন ঘর-সংসারে, তেমনি জগৎ সংসারেও সত্য।
বাবা জেদি। তার মুখে সেকি প্রবল আত্মবিশ্বাসের আভা দেখেছে হাসু। অপত্য স্নেহে যখন বাবা কন্যার কপালে হাত দিতেন, সেই হাতের তালুর উত্তাপে সে পরম নির্ভরতার আস্থা পেত। বাবার ঔরসজাত কন্যা না হলে, ওই অমোঘ স্পর্শ না পেলে কোনোদিনই এই অনুভব হতো না। হাসু বাবার কাছে ছোট্ট খুকিটিই আছে সারাজীবন। তার বিয়ে হলো, সংসার হলো, সন্তান হলো – বাবা তাকে প্রথমা কন্যার সেই আনন্দ আবর্ত থেকে কখনোই বের হতে দেননি। বের হতে চায়নি হাসুও। তার মাঝেই যে বাবা দেখেছেন সারাদেশের লাখো কোটি কন্যার মুখ। ছেলেবেলার দুষ্টমিষ্টি অনাবিল আদর সে সব সময় ভোগ করেছে। হাসুর জন্য তার কত স্নেহ বুকে তোলা – সেই ফল্গুধারার কথা তার কখনোই পুরোটা জানা হবে না।
বাবাকে যখন খুব কাহিল পরিশ্রম-ক্লান্ত মনে হয় কন্যার অগ্রাধিকারে সে খানিক রুষ্ট হয়। অনুযোগ করে।
বাবার মুখে তখন অকৃত্রিম এক আকাশ আলো ভরা হাসি। তার মননে মস্তিষ্কে মানুষ ও দেশ ভাবনার বাইরে কিস্যুটি নেই।
বাবার একটাই কথা আমি খুব সুস্থ আছি মা রে। মানুষের ভালবাসাই বাঁচিয়ে রাখবে আমাকে। আমি যতদিন বাঁচবো বাঙ্গালির ভালবাসায় বাঁচবো। যখন মরে যাব তখনও এই বাংলায় বাঙ্গালির ভালবাসায় বেঁচে থাকব।
হাসু তখন কান পেতেছিল বাবার বুকে। ভেবে রেখেছিল – কোনো ধুকপুকানির শব্দ টের পেলে কঠিনভাবে কিছু বলবে।
স্টেথিসকোপ-কন্যা, এই আচরণ পিতার কাছে খুব উপভোগ্য। তিনি লম্বা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মৃদু হাসি। দ্যাখ, দ্যাখ-ভালো করে দেখে নে। মা রে মা, আমি একটুও কাহিল হয়ে পড়িনি।
বাবার বুকে কান পাতার সেই অনুভূতি কখনো কাউকে বলেনি হাসু। আশ্চর্য এক অভিজ্ঞতা। বাবা কি বুকের মধ্যে কোনো সাগর ধারণ করে রেখেছেন। কান পেতে শুনতে পাচ্ছিল সাগরের জলরাশির শব্দ। চোখ বুঁজে দেখতে পাচ্ছিল প্রশান্ত এক সাগরের পাড়ে প্রফুল্ল নীল আকাশ। অথৈ পানি। অতলান্ত।
এই অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা তার জানা নেই। হয়তো এমনটাই হবে বাবার বুকে কান পেতে চোখ বুজলে পৃথিবীর সকল কন্যাই তার পিতার নির্ভরতায় এই অফুরন্ত সুখের ঠিকানা পায়। যে কন্যা তার পিতার বুকে কান পেতে এই সুখের সাগরের অখণ্ড অনন্ত গভীরতা অনুভব করে দেখেনি তার এক্ষুনি পরীক্ষা করে দেখা উচিত। খুব বুঝি আবেগ আক্রান্ত হয়ে পড়ছে হাসু।
আবেগ নিশ্চয়ই, কিন্তু বিভ্রম নয়। ওই অতলান্ত পানি ভালবাসারই দিব্যি – তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।
বাবা তবুও বয়স ও শ্রমভারে একটু একটু কাবু হয়ে পড়ছেন।
গেল মাত্র দুই বছরের মধ্যেই তিনি বড় ধরনের স্বাস্থ্য সঙ্কট সামলেছেন। তাকে গোপনে বিষাক্ত ওষুধ বা ভয়ংকর কোন জীবাণু-ভাইরাস দিয়ে হত্যার ষড়যন্ত্রও একটা হয়েছিল। এমন ষড়যন্ত্রের বেফাঁস চিঠিও হাসুদের হাতে এসেছে। বাবা সব হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। তার কথা আমাকে বুকে আগলে রাখছে কোটি বাঙালি। উপরে আছেন আল্লাহ। আমাকে কে মারবে বলতো!
কিন্তু পরপর দুইবার ভয়ংকর অসুখের কথা কেমন করে মাথায় না নিয়ে পারে হাসুরা? বাহাত্তর সালের মাঝামাঝি হঠাৎ এক রাতে আব্বা ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তলপেটের ব্যথায় প্রচন্ড কাতরাচ্ছেন। কয়েক রকম মেডিক্যাল টেস্ট করা হলো। তখন আব্বার একান্ত ডাক্তার নুরুলকাকা। জানা গেল গলব্লাডারে পাথর ধরা পড়েছে। ছড়িয়ে পড়ছে তার ইনফেকশন। ডাক্তারকাকা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছিলেন। মেডিকেল রিপোর্ট দেখে তিনি খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। বললেন, শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে এত উদাসীন হলে কি চলে?
কী ব্যাপার?
উদ্বিগ্ন আম্মা ও হাসুরাও।
নূরুল কাকা বললেন, অবিলম্বে অপারেশন দরকার। অন্যথায় বাঁচানো যাবে না মুজিব ভাইকে।
কিন্তু বাবা মন ভোলা । তার ব্যথা ক্লিষ্ট মুখেও ‘কিছু হয়নি’ হাসি।
যেন হাসিই সুস্থ করে তুলবে বাবাকে। আশ্চর্য তার মনোবল।
মাকে নূরুলকাকা জানালেন, পাথরের কারণে গলব্লাডারের ক্ষতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, নিবিড় মেডিকেল কেয়ার এবং দক্ষ অস্ত্রোপচার প্রয়োজন।
অপারেশন হবে কোথায়!
ধ্বংস বিধ্বস্ত দেশ। পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম ভালো বিশেষ নেই।
রোগী যখন বঙ্গবন্ধু – বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা খুবই ইতস্তত করছেন। শেষে যদি কোন অঘটন হয়। তার দায় নেবার সাহস কারও হচ্ছে না। নুরুলকাকাও বললেন, দ্রুত দেশের বাইরে নেয়া দরকার। সময় ক্ষেপনের সুযোগ নেই।
বেঁকে বসলেন আব্বা। তিনি দেশের বাইরে কোথাও যাবেন না!
নূরুলকাকা যতোই বোঝান; তিনি কানেই নিচ্ছেন না। যেখানে দরকার অতি জরুরি অপারেশন; সেখানে বাবার চিত্তে অনাকাঙ্ক্ষিত টানাপোড়েন চলছে। দেশ ছেড়ে তিনি কোথাও যাবেন না। মরা-বাঁচা এখানেই। বাঁচলে তিনি দেশের ডাক্তারদের হাতেই বাঁচবেন। শিশুর মত সরল তার আবদার।
আম্মা বললেন, যাই হোক, ভালো একটা কিছু হোক – খোদা আছেন সঙ্গে। (চলবে…)
অলংকরণ কৃতজ্ঞতায়: শিল্পী শাহাবুদ্দিন