বাবাকে নিয়ে যখন বলছিলেন, তখন মেয়ে দিবা নার্গিসের সামনে শোভা পাচ্ছিল চার চারটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সোনালী পদক। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে জানালেন তার ভাবনা। প্রখ্যাত নাট্যকার, নির্মাতা ও অভিনেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনের রেখে যাওয়া কাজ চর্চার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের উপকৃত হওয়ার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন মেয়ে দিবা নার্গিস। আজ বুধবার দুপুরে চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা যে কাজগুলো করে গেছেন মঞ্চ ও পর্দায়। তা চর্চার মাধ্যমে প্রজন্ম সমৃদ্ধ হতে পারে। এতে করে বাবার কাজগুলোও বেঁচে থাকবে। এখন যারা ভালো ভালো কাজ করছেন তারা যদি শুধু নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তাহলে তাদের অনুপস্থিতিতে আগামী প্রজন্মও তাদের স্মরণ করবেন না। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হারিয়ে যাবে এদেশের মেধাবী মানুষগুলো।’
তিনি জানান, কাগজ কলমে আব্দুল্লাহ আল মামুনের জন্ম ১৩ জুলাই হলেও ১২ জুলাই তিনি জন্মদিন পালন করতেন। এর কারণ হতে পারে, তার জন্মদিন আসলে আজ ১২ জুলাই। হয়তো সার্টিফিকেটে তারিখটা ভুল হয়েছে।
আব্দুল্লাহ আল মামুন একাধারে একজন প্রখ্যাত অভিনেতা, নাট্যকার, নির্দেশক ও চলচ্চিত্র পরিচালক। বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রযোজক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করা এই ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। অসংখ্য নাটক রচনার পাশাপাশি নিজের মেধা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন অভিনয় ও নির্মাণে। শহিদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস ‘সংশপ্তক’ পরিচালনা ও প্রযোজনা করে পেয়েছিলেন প্রবাদপ্রতিম খ্যাঁতি।
ঢাকার মঞ্চে পরিচিত ও জনপ্রিয় নাটক ‘সুবচন নির্বাসনে’, ‘এখন দুঃসময়’, ‘সেনাপতি’, ‘এখনও ক্রীতদাস’, ‘কোকিলারা’, ‘দ্যাশের মানুষ’, ‘মেরাজ ফকিরের মা’, ‘মেহেরজান আরেকবার’ ইত্যাদির লেখক তিনি। ‘সারেং বৌ’, ‘সখী তুমি কার’, ‘এখনই সময়’, ‘জোয়ারভাটা’, ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘দরিয়া পাড়ের দৌলতি’সহ তার নির্মিত ছবিগুলো দেশ-বিদেশে প্রশংসা কুঁড়িয়েছে। ৬৫ বছরের জীবদ্দশায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
বাবাকে নিয়ে মেয়ে দিবা নার্গিস বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবাকে শুধু বাবা হিসেবেই জানতাম। বাবা হিসেবে কতটা ভালোবাসতাম সেটা পরিমাপের বাইরে। যখন বুঝতে শুরু করলাম উনি কে, দেশের প্রতিটি মানুষের কাছে উনার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা কী তখন বাবাকে নিয়ে আমাদের গর্ব হতো। এখনো হয়। উনি যে দেশের জন্য কত বড় সম্পদ সেটা আমরা, আমার বাকি ভাই-বোনরা প্রতি মূহুর্তে বুঝতে পেরেছি।’
তিনি আরও জানান, জন্মদিন নিয়ে আলাদা কোনো অনুভূতি বা উত্তেজনা তার মাঝে কাজ করত না। আর দশটা সাধারণ দিনের মতোই তিনি কাজে কর্মে কাটাতেন। তার ৫০তম জন্মদিন বেশ আয়োজন করে উদযাপন করা হয় থিয়েটারের পক্ষ থেকে। আব্দুল্লাহ আল মামুন মারা যাওয়ার পর গত দুই বছর জন্মদিন নিয়ে কোনো আয়োজন করা হয় না থিয়েটারের পক্ষ থেকে। থিয়েটারের লোকজন তাকে ভুলে গিয়েছেন হয়তো।
বাবার স্মৃতি জানতে চাইলে দিবা নার্গিস জানান, বাবাকে নিয়ে স্মৃতির ভাণ্ডার মহাসমুদ্রের মতো বিশাল। সেখান থেকেই একটা স্মৃতি হাতড়ে হাজির করলেন চ্যানেল আই অনলাইনের পাঠকদের জন্য। খুব ছোটবেলায় পারিবারের সঙ্গে বাবার অভিনীত মঞ্চ নাটক দেখতে গিয়েছিলেন। নাটকের একটা পর্যায়ে বাবা আব্দুল্লাহ আল মামুনকে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। তখন তিনি দর্শক আসনে বসে চিৎকার করে বলতে থাকেন, ‘বাবাকে পানিতে ফেল না। বাবা তো সাঁতার জানে না।’
এমন আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল ‘এখনি সময়’ ছবি দেখতে গিয়ে। ছবির একটি দৃশ্যে আব্দুল্লাহ আল মামুন দারিদ্রের জাঁতাকলে পৃষ্ট হয়ে বেছে নেন অন্যায় পথ। শয়তানদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নীতি বিরোধী কাজ করতে বাধ্য হন। ছবির এমন একটা দৃশ্যে জখমের শিকার হন আব্দুল্লাহ আল মামুন। তার গা থেকে রক্ত বের হতে থাকে। সে সময় দিবা ও তার ভাই-বোনেরা কান্না শুরু করে দেন।
বাবাকে নিয়ে একটা আফসোস কাজ করে দিবা নার্গিসের। তার শেষ ছবি ‘দরিয়া পাড়ের দৌলতি’ শেষ করে যেতে পারেননি।
এই সিনেমার শুটিংয়ে প্রতি সন্ধ্যায় ব্যাডমিন্টন খেলার আয়োজন হতো। সবাই উৎসবমুখর পরিবেশে ব্যাডমিন্টন খেলে সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতেন। পরিবার ও চলচ্চিত্রের শিল্পীরা একত্রে খেলার সেই দৃশ্যগুলো এখনো চোখে লেগে আছে দিবা নার্গিসের।