সাংবাদিক জামাল খাশোগির মৃত্যুর ঘটনায় সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বাদশাহর সিংহাসনে আরোহণ ঠেকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবে এর ফলে তার পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্কধারী ‘আধুনিক’ ইমেজের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
হুট করে ক্ষমতার প্রায় শিখরে উঠে যাওয়া ৩৩ বছর বয়সী যুবরাজ মোহাম্মদের অবস্থানের ওপর খাশোগি ইস্যু হয়ে উঠেছে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সংকট; যে অবস্থান আগেই ভয়াবহ ইয়েমেন যুদ্ধ আর সৌদি ব্যবসায়ী ও অ্যাক্টিভিস্টদের আটক-গ্রেপ্তারের ঘটনায় নড়ে উঠেছে।
তবে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবেন বলেই ধারণা করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।
ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটে ব্যক্তিগত কাজে গিয়ে ২ অক্টোবর খাশোগির নিখোঁজ হওয়া, সৌদি আরবের অস্বীকার করে মিথ্যা দাবি, সরকারের পক্ষ থেকে যুবরাজ মোহাম্মদের বিবৃতি, তুরস্কের হাতে খাশোগি হত্যার প্রমাণ থাকার দাবি এভাবে চলতে চলতে এক পর্যায়ে সৌদি সরকার বাধ্য হলো কনস্যুলেটের ভেতর সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করতে।
যুবরাজ মোহাম্মদ ও একজন খাশোগির মৃত্যু
মৃত্যুর ঘটনা স্পষ্ট হওয়ার পর ‘দুঃখপ্রকাশ’ করে জামাল খাশোগির পরিবারের কাছে যুবরাজ চিঠি লিখেছিলেন বলে জানিয়েছিল ওয়াশিংটন পোস্ট। সৌদি আরবের পক্ষ থেকে প্রকাশিত বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, যুবরাজ মোহাম্মদ খাশোগিকে ‘জিজ্ঞাসাবাদ ও এক পর্যায়ে মৃত্যু’র ব্যাপারে কিছু জানতেন না।
কিন্তু এতে আসলে খুব একটা লাভ হয়নি। কেননা পুরো বিশ্ব জানে, সৌদি সাম্রাজ্যের অনুগত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোনো কাজ করবেন আর বাদশাহ-যুবরাজ সে ব্যাপারে কিছুই জানবেন না – এটা অসম্ভব।
বাদশাহ সালমানের পর সৌদি সাম্রাজ্যের উত্তরসূরি হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই দেশটির প্রচলিত বিভিন্ন কট্টরপন্থি নিয়মনীতিতে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন এনেছেন মোহাম্মদ। খুব দ্রুতই দেশটিতে একের পর এক ক্ষমতার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠেছেন তিনি। এত দ্রুত সৌদি আরবের মতো একটি রক্ষণশীল দেশে লক্ষণীয় পরিবর্তন আনার মধ্য দিয়ে তিনি নিজের বাড়তে থাকা আধিপত্যেরই পরিচয় দিয়েছেন।
যুবরাজ মোহাম্মদের রয়েছে সৌদি আরবের জন্য অনেকগুলো উচ্চাভিলাষী সংস্কার পরিকল্পনা। আর এ কারণে তিনি পশ্চিমা দেশগুলোর সরকার ও বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার প্রক্রিয়া শুরু করেন।
সম্পর্ক ভালোভাবে এগিয়েও যাচ্ছিল। দেশের তেল-বাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে বিশ্বনেতাদের সমর্থন পাবার আশাও দৃঢ় হচ্ছিল তার। কিন্তু জামাল খাশোগির মৃত্যুর ঘটনায় এখন উল্টো নানারকম অবরোধ আর নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকিতে আছে সৌদি সাম্রাজ্য।
সৌদি আরব অবশ্য হুমকি দিয়েছে, কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলে তারাও পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। তবে বিশ্লেষকদের মতে তা হবে সৌদির জন্য হিতে-বিপরীত। যদি সৌদি এক্ষেত্রে তার তেল উৎপাদনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, হয়তো যুবরাজের অর্থনৈতিক স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে যাবে, বা সেগুলো সত্যি করতে তাকে আরও অনেক বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে।
পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিক্রিয়া
লন্ডনের রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ-এর মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মাইকেল স্টিফেনস বার্তা সংস্থা এপি’কে বলেছেন, এই মুহূর্তে মূল বিষয় হচ্ছে খাশোগি হত্যাকাণ্ড ইস্যুটিতে পশ্চিমা সরকারগুলোর সমন্বিত প্রতিক্রিয়া কী হয় এবং তারা সম্মিলিতভাবে তারা এটিকে কোন পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যেতে চায়।
‘অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাই কি সৌদি আরবকে এমনটা যেন আর না হয়, তেমন সতর্কবার্তা দিতে পারবে? কেউ কেউ ভাবতে পারেন এটুকু যথেষ্ট শাস্তি নয়। আবার আমেরিকানদের মতোরা ভাবতে পারেন এটা খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে,’ বলেন স্টিফেনস।
জামাল খাশোগি হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে মোট ১৮ জনকে আটকের কথা জানিয়েছে সৌদি আরব। যুবরাজের অন্যতম উপদেষ্টা সৌদ আল-কাহতানিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। এতেই বোঝা যায়, পরিস্থিতি কতটা জটিল দিকে মোড় নিচ্ছে।
যুবরাজকে নিয়ে কী হচ্ছে সৌদি প্রশাসনে
যুবরাজকে অবশ্য রক্ষা করছেন তার বাবা বাদশাহ সালমান। খাশোগি ঘটনায় যে যুবরাজের উত্তরাধিকারী হওয়ার সিদ্ধান্ত বদলাচ্ছে না, তার ইঙ্গিত হলো: খাশোগি গুম হওয়ার খবরের পরেই তাকে সৌদি সাম্রাজ্যের গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড রিভিউ ও আধুনিকীকরণে গঠিত একটি কমিশনের দায়িত্ব দেয়া।
তবে যুবরাজ মোহাম্মদের ক্ষমতা গ্রহণের পথে যে কোনো সরাসরি বাধা পুরো সাম্রাজ্যকেই অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন গালফ স্টেট অ্যানালিটিকসের লন্ডনভিত্তিক অ্যানালিস্ট সিনিজিয়া বিয়াংকো।
‘কমবয়সী এবং বাবার খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ায় তার আচরণ বাদশাহ ও ক্ষমতাশালী বিশ্বনেতাদের প্রভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে,’ বলেন তিনি।
তবে এটার ততক্ষণই সত্য যতক্ষণ বাদশাহ সালমান ক্ষমতায় থাকছেন। যদি যুবরাজ মোহাম্মদ সিংহাহনে বসেন, বয়স হিসেবে বলা যায়, এ যাবতকালের সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকা বাদশাহ হবেন তিনি।
সুতরাং খুব দ্রুত হয়ে গেলেও এই সময়ে এসব চাকরিচ্যুতি আর গ্রেপ্তার থেকে এটাই ধারণা করা যায়, সৌদি সরকার তাদের ভুল সংশোধন করে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে, যেন মোহাম্মদ সার্বিকভাবে নিরাপদে থাকেন। এমনটাই মনে করছেন ইউরেশিয়া গ্রুপের মধ্যপ্রাচ্য ও নর্থ আফ্রিকা বিষয়ক গবেষণা প্রধান আয়হাম কামেল।
‘যদিও মনে করা হচ্ছিল এই সংকট মোহাম্মদ বিন সালমানের স্বপ্নের ধ্বংস বয়ে আনবে, সৌদি সরকারের সাম্প্রতিক ঘোষণা ও পদক্ষেপগুলোই প্রমাণ করে যে, বাদশাহ এখনো তাকেই উপযুক্ত উত্তরসূরি মনে করেন,’ বলেন তিনি।
বড় দুশ্চিন্তা যুক্তরাষ্ট্র
সৌদির সবচেয়ে বড় চিন্তা আপাতত যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে। কারণ দেশটি ইরানের বিরুদ্ধে সৌদির গুরুত্বপূর্ণ একটি সামরিক বন্ধু দেশ। একই সঙ্গে দেশটি সৌদি আরবের যুদ্ধ ও অস্ত্র বিষয়ক বিনিয়োগের বড় একটি উৎস, যে বিনিয়োগ সৌদির অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য খুবই প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি কঠোর প্রতিক্রিয়া বাকি পশ্চিমা দেশগুলোকেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী করতে পারে। যার ফলে সৌদি আরও বড় সংকটে পড়বে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য এ ব্যাপারে দ্বিধায় ফেলে দিয়েছেন।একদিকে তিনি জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের কঠোর শাস্তির প্রতিজ্ঞা করেছেন; অন্যদিকে আবার বলেছেন তিনি সৌদির রাজতন্ত্রের সঙ্গে আমেরিকান অস্ত্র ব্যবসা নষ্ট করতে চান না।
শুধু তাই না। প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্পের প্রথম বৈদেশিক সফর ছিল সৌদি আরবে। তার উপদেষ্টা হিসেবে জামাতা জ্যারেড কুশনারও যুবরাজ মোহাম্মদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
তাই এখন দেখার বিষয় যুক্তরাষ্ট্র ও তার দেখাদেখি বাকি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো খাশোগি ইস্যুতে কী সিদ্ধান্ত নেয় আর তা সৌদি আরবের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে। তবে এটা বোঝাই যাচ্ছে, আসন্ন বাদশাহী না হারালেও অন্য অনেক কিছু হারানোর আশঙ্কায় আপাতত ঝুলন্ত অবস্থায় আছেন যুবরাজ মোহাম্মদ।